মুসলিম বিশ্বের জন্য ইসরাইল এক বিষফোড়ার নাম। গত দেড় বছরে ইসরাইল নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়ে ৫৬ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। গাজা এখন মৃত্যু উপত্যকা এবং এক বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে।

এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও পিপাসা মেটেনি নেতানিয়াহুর। এই নরপিশাচ মুসলমানদের আরো রক্ত চায়। বিনা উসকানিতে হঠাৎ ইরানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নেতানিয়াহুর ইসরাইল। বোমা মেরে, ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরানের ব্যাপক ক্ষতিই করেনি, প্রথমসারির অনেক পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে ইসরাইল। ইরান দাবি করেছে, ইসরাইল তাদের ৩০ জন সামরিক কমান্ডার এবং ১১ জন পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। ৭২০টির বেশি সামরিক স্থাপনা ইসরাইল ধ্বংস করেছে। ইহুদি ইসরাইলের হামলায় ইরানের ৬২৭ জন হত্যার শিকার হয়। শোক ও বেদনাবিধূর পরিবেশে তেহরানে জানাজা শেষে তাদের চিরবিদায় জানানো হয়েছে।

শুধু গাজা কিংবা ইরান নয়। এই জালেম নেতানিয়াহুর ইসরাইল ২০ মাসে মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচটি অঞ্চলে ৩৫ হাজার হামলা চালিয়েছে। আলজাজিরার খবরে বলা হয়, ইসরাইলের হামলার শিকার হয়েছে ইরান, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেন। আমেরিকাভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডাটা প্রজেক্টের (এসিএলইডি) নথিবদ্ধ তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইল সবচেয়ে বেশি অন্তত ১৮ হাজার ২৩৫টি হামলা চালিয়েছে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডকে লক্ষ্য করে। লেবাননে ইসরাইলি হামলা হয়েছে ১৫ হাজার ৫২০টি। এরপর যথাক্রমে সিরিয়ায় ৬১৬টি, ইরানে ৫৮টি এবং ইয়েমেনে ৩৯টি হামলা চালিয়েছে বর্বর ইসরাইলি বাহিনী। এই হামলাগুলো হয়েছে যুদ্ধবিমান ও ড্রোন ব্যবহার করে, গোলাবর্ষণ, ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ, দূরনিয়ন্ত্রিত বোমা বিস্ফোরণ এবং সুপরিকল্পিতভাবে সম্পত্তি ধ্বংস করে। ইরানে ১৩ জুন থেকে টানা ১২ দিন যুদ্ধ চালিয়েছে ইসরাইল। তবে ইরান যুদ্ধে ইসরাইলকে ছেড়ে দেয়নি। ইসরাইল লক্ষ্য করে ৫৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান। ১৩ জুন ইসরাইল ইরানে হামলা চালায়। পরে ২১ জুন সংঘাতে যোগ দেয় আমেরিকা।

সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস কেন নয়সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস কেন নয়

মুসলিম বিশ্ব কেন পারমাণবিক বোমা বানাবে, এটা বড় মাথাব্যথার কারণ ইসরাইলের। তাই ইসরাইলের অভিলাষ ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দিতে হবে। ইরানের পর পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করে মুসলিম বিশ্বকে পঙ্গু করে দিতে হবে।

ইসরাইল জানে, একা সে ইরানকে কাবু করতে পারবে না। কৌশলে আমেরিকাকে যুদ্ধে জড়াতে হবে। সেই চেষ্টায় সফলও হয়েছে ইসরাইল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সম্মত করাতে পেরেছেন কসাই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তাই পুরো বিশ্ব দেখেছে আমেরিকা দুই সপ্তাহের সময় দিয়ে হঠাৎ করে রাতের আঁধারে দুদিনের মাথায় আক্রমণ করল ইরানের ফোর্দোসহ তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায়। আমেরিকার বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান উড়ে গিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা মেরেছে। আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ দাবি করেছেন, ৩০ হাজার পাউন্ডের একডজনের বেশি ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা তারা ইরানের ফার্দো ও নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলোয় ফেলেছেন। এত বড় বোমা হামলার পর তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার কথা। কিন্তু এমন আলামত অবশ্য দেখা যায়নি। ইরান আমেরিকার হামলায় তাদের পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে। তবে তারা বলেছে, ইউরেনিয়াম নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এ সম্পর্কে বিশ্ব মিডিয়ায় খবরও বের হয়। কিন্তু আমেরিকা এসব খবরকে নাকচ করে দিয়ে বলছে ইরান ইউরেনিয়াম সরাতে পারেনি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

শহীদের স্বীকৃতি প্রদানে বৈষম্য কেন?শহীদের স্বীকৃতি প্রদানে বৈষম্য কেন?

শুধু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিই নয়, দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হত্যা করতে চেয়েছিল ইসরাইল। ১২ দিনের যুদ্ধের সময় ইসরাইল একটির পর একটি চেষ্টা করেছে। আমেরিকাও তাকে হত্যার চেষ্টা চালায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বেঁচে যান। ইসরাইলের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ইরানের সরকার পরিবর্তনের চেষ্টাও সফল করতে পারেনি ইসরাইল ও আমেরিকা।

ইসরাইলের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হচ্ছে আমেরিকাকে দিয়ে ইরানকে পঙ্গু করা, আবার ভারতকে দিয়ে পাকিস্তানকে শেষ করা। দুই জায়গাতেই মার খেয়েছে ইসরাইল ও ভারত। চার দিনের যুদ্ধে পাকিস্তান যেমন ভারতকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে, তেমনি ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইসরাইলের মাজা ভেঙে দিয়েছে। তবে ইরান-ইসরাইল এবং ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক দুটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর মুসলিম দেশগুলোর জন্য শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু আছে। মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যুদ্ধের সময় মুসলিম দেশগুলোকে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যকে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে দেখা গেছে। টুঁ শব্দটি তারা করেনি। তাদের বোঝা উচিত আজ ইরান হামলার শিকার। কাল-কুয়েত, কাতার, সৌদি আরবও হামলার শিকার হতে পারে। মুসলিম দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ না হলে, একসঙ্গে আওয়াজ না তুললে সামনে আরো বিপদ অপেক্ষা করছে। তাই একের বিপদে অন্যকেও ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি দেশ নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির যুগে আকাশে যুদ্ধই সব নিয়ন্ত্রণ করে। সে জন্য আধুনিক ও শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি প্রমাণ করেছেন তিনি একজন যোগ্য ও দূরদর্শী নেতা। মৃত্যুর ভয়কে তিনি পরোয়া করেননি। ধীরস্থির ঠান্ডা মাথায় তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিপদে তিনি ভেঙে পড়েননি। আমেরিকার এত বড় হামলার পরও তার মনোবলে এতটুকু ঘাটতি ছিল না। ইরানের যোদ্ধাদের তিনি সাহস জুগিয়ে গেছেন।

আমেরিকা ইসরাইলকে বাঁচাতে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে। ইরান কৌশলগত কারণেই যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে। যুদ্ধবিরতির পর আলি খামেনি যে ভাষণ দিয়েছেন, তাও অসাধারণ।

তার ভিডিও বার্তা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচার করা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার ২৬ জুন। তিনি ইরানের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে ইসরাইলের পাশাপাশি আমেরিকারও কড়া সমালোচনা করেছেন। খামেনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে ইরান। এর মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটনের গালে ‘সজোরে চপেটাঘাত’ করেছে তেহরান। তিনি বলেন, এই অন্যায় যুদ্ধে আমেরিকা হস্তক্ষেপ করেছিল। কারণ আমেরিকা বুঝতে পেরেছিল তাদের হস্তক্ষেপ ছাড়া ‘জায়নবাদী’ ইসরাইল ধ্বংস হয়ে যাবে। ইসরাইল প্রায় ধসে পড়েছে। ইরানের হামলায় তারা প্রায় চূর্ণবিচূর্ণ’ হয়ে গেছে। ইরানের ওপর হামলার জন্য শত্রুদের চড়া মূল্য দিতে হবে। আমেরিকার হামলায় ফার্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানÑতিন পরমাণু স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তারও জবাব দেন খামেনি। তিনি বলেন, ইরানে আমেরিকার হামলা ছিল নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের জন্য। তাদের বোমা ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। তবে খুব বেশি কিছু অর্জন করতে পারেনি আমেরিকা। আলি খামেনির বক্তব্যের পর গত শনিবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার ইরানকে হুঁশিয়ারি দেন বলে রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে। ট্রাম্প বলেন, ইরান যদি পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে, তাহলে দেশটিতে নতুন করে আমেরিকা বোমা হামলা করবে। তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনিরও কড়া সমালোচনা করেন। আবার হামলা করবেন কি নাÑসাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দম্ভ প্রকাশ করে ট্রাম্প বলেন, ‘অবশ্যই, কোনো প্রশ্ন ছাড়াই।’ ইরান এ বক্তব্যেরও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বলেছে, খামেনিকে নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্য অসম্মানজনক। আলোচনার টেবিলে ফিরতে হলে আমেরিকাকে অবশ্যই ইরানের জনগণকে সম্মান করতে হবে। শাবাশ ইরান, শাবাশ খামেনি। প্রতিটি মুসলিম দেশে একজন করে খামেনি গড়ে উঠুক। ইরানের মতো দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়াক প্রতিটি মুসলিম দেশ।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমার দেশ

বিষয়: ইরান

সূত্র, আমার দেশ