যেকোনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি মজবুত করতে হলে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা, বিশেষ করে নিম্নকক্ষে তা অপরিহার্য।

ফ্যাসিবাদ-উত্তর দেশে নির্বাচনী সংস্কারের যে দু’টি প্রস্তাব এখন আলোচনার কেন্দ্রে, একটি সেই পুরনো পরিচিত পথে, যেখানে ভোট বড়জোর গণনার বিষয়; কিন্তু জনগণের ইচ্ছা কখনো শাসনের ভিত্তি হয়ে ওঠে না। আসনভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা অনেকটা খেলাঘরের খেলা, যিনি আগে দৌড়াবেন, তিনি পাবেন আসন। কিন্তু এখানে যারা হোঁচট খান, তারা অনুপস্থিত থেকে যান দেশের আইনসভায়, যত সংখ্যায় বেশি হোন না কেন । একটি দল যদি মাত্র ৩০ শতাংশ ভোট পায়, আর বাকি ৭০ শতাংশ ছয় ভাগে ভাগ হয়ে যায়, তবে সেই ৩০ শতাংশের দল জয়ী হবে।

এ গণতন্ত্রের খেলায় একটি সুবিধা অবশ্য আছে, ‘স্থিতিশীল সরকার’। সরকার এতটা স্থিতিশীল হয় যে, জনগণ যত নাড়া দিক, সরকার টলে না। জনগণের সম্পদ বিদেশে যায়, কণ্ঠ রোধ করা হয়, বিরোধীদের কারাগারে পোরা হয়; কিন্তু সরকারের গদি থাকে অটল।

অন্য দিকে আছে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন পদ্ধতি। এখানে জনগণের প্রতিটি ভোট কিছু না কিছু হিস্যা পায়, অর্থাৎ একটি দলের ভোট শতকরা যতটুকু, তার ততটুকু সংসদে আসন। এখানে কেউ অবহেলিত নন, কেউ অদৃশ্য হয়ে যান না। কেউ কাউকে কনুই মেরে বাইরে ঠেলে দেন না। একে অনেকে বলেন ‘অস্থির সরকার’ কারণ এখানে সরকার টিকে থাকতে হলে জনগণের কথা শুনতে হয়, বিরোধীদের মতামত মানতে হয়, গলাবাজি নয়, সমঝোতার রাজনীতি করতে হয়। বস্তুত এ অস্থিরতা গণতন্ত্রের নিরাপত্তা। এখানে প্রধানমন্ত্রী জানেন, জনগণ বিরক্ত হলে পরদিন গদি হারাতে পারেন। এখানে ক্ষমতা মানে দায়, আর জনগণ মানে মালিক। এখানে কেউ একবার ক্ষমতায় গেলে ১০ বছর ধরে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে লুটপাট চালিয়ে যেতে পারেন না।

এখন প্রশ্ন হলো- আমরা কোনটি চাই? স্থিতিশীল শাসন যেখানে জনগণের কণ্ঠরোধ ‘স্থিতিশীলতা রক্ষা’র নামে জায়েজ হয়, নাকি এমন এক নির্বাচন পদ্ধতি যেখানে সরকার টিকিয়ে রাখতে হলে জনগণের মুখ চেয়ে থাকতে হয়?

আমাদের যদি লক্ষ্য হয় আমরা সত্যিকার গণতন্ত্র চাই, যেখানে ৩০ নয়, শতভাগ মানুষের ইচ্ছা সংসদে প্রতিফলিত হবে, তবে সবাইকে সাহস করে বলতে হবে- প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন আমাদের পথ। যারা স্বৈরতন্ত্র চান, তারা নিশ্চিন্তে আসনভিত্তিক নির্বাচনের জয়গান গাইতে পারেন। তবে গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে চাইলে, আমাদের দরকার সেই পদ্ধতি, যেখানে ‘স্থিতিশীলতার’ মুখোশ পরে কেউ জনগণের ইচ্ছা থামিয়ে রাখতে না পারেন।

এ যুক্তি কেবল নিম্নকক্ষ নয়, উচ্চকক্ষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে বিশেষভাবে নিম্নকক্ষে এর গুরুত্ব বেশি, কারণ জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন প্রণয়নের প্রাথমিক উদ্যোগ আসে নিম্নকক্ষ থেকে। উচ্চকক্ষ সেখানে মূলত একটি পর্যালোচনামূলক ভারসাম্যের ভূমিকা রাখে। অতএব, যেকোনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি মজবুত করতে হলে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা, বিশেষ করে নিম্নকক্ষে তা অপরিহার্য।

সূত্র, নয়া দিগন্ত