আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানামুখী মেরূকরণ চলছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিকে ঘিরে একাধিক রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রক্রিয়া দৃশ্যমান। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে একাধিক ইসলামপন্থি দলের পক্ষ থেকে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার ঘোষণা আগেই দেওয়া হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে বাম ধারার ও ইসলামপন্থি কয়েকটি দলের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতা নিয়ে আলোচনা চলছে। এর মধ্যে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাবি করা হেফাজতে ইসলামের সমর্থন পেতে বিএনপি ও এনসিপির নেতারা তৎপর হয়েছেন। আবার হেফাজতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দলের নেতারা জামায়াতে ইসলামীর জোটেও আছেন।

এনসিপি নেতারা বলেছেন, তারা তরুণদের নিয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে চান। কিন্তু এরপরও প্রশ্ন থেকে যায় এই প্ল্যাটফর্ম বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে কার সঙ্গে সমঝোতায় যাবে? স্বতন্ত্র ধারায় শেষ পর্যন্ত এনসিপির প্ল্যাটফর্মে একা নির্বাচনে যেতে পারবে না। বড় দুই জোটের যেকোনো একটির সঙ্গে হয়তো তাদের আসন সমঝোতা করতে হবে। এ নিয়ে তরুণদের এই দলের মধ্যে বিভাজনও তৈরি হতে পারে।

এছাড়া এবারের নির্বাচনে জাতীয় পার্টিও অংশ নেবে। জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশ নেওয়ার পক্ষে। জাতীয় পার্টির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাঠে থাকবে।

ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের পর জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে থাকা জোটের নেতারা অনেক বেশি চাঙা। অন্যদিকে বিএনপির মধ্যে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফল আগামী নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও একটি বিষয় স্পষ্ট, তরুণ ভোটারদের মধ্যে বিএনপির ভাবমর্যাদা খুব একটা ভালো নয়। তারা তরুণদের আকৃষ্ট করতে পারছেন না। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তরুণদের নিয়ে এক দফা লিটমাস টেস্ট হয়ে গেছে।

এবারের নির্বাচনে প্রায় চার কোটি তরুণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এদের বড় অংশ হাসিনা উৎখাতের আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। ফলে রাজনৈতিকভাবে তারা অনেক সচেতন। এই ভোটাররা তাদের পরিবারের সদস্যদেরও প্রভাবিত করবেন। চার কোটি ভোটার যদি একজন ভোটারকে প্রভাবিত করেন, তাহলে তা দ্বিগুণ হয়ে আট কোটি হবে। এবার ভোটার প্রায় ১২ কোটি। অর্থাৎ তরুণরা ঠিক করবেন কোন ধরনের প্রার্থী বিজয়ী হবেন। একটি বিষয় স্পষ্ট, এই তরুণ ভোটাররা মার্কা দেখে ভোট দেবেন না। তারা ভোট দেবেন প্রার্থী দেখে। এখানেই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান চ্যালেঞ্জ।

প্রায় দেড় দশকের বেশি সময় ধরে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেতে যাচ্ছে। ফলে আগের নির্বাচনের হিসাবনিকাশ দিয়ে এবারের ভোটারদের মনস্তত্ত্ব বোঝা যাবে না। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ। তিনি খানিকটা সুস্থ হওয়ায় হয়তো আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন। কিন্তু তার পক্ষে সম্ভব হবে না নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নেওয়া। দলের খুবই পরিচিত মুখ ও সাংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন অনেক নেতা এখন নেই। মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, এম কে আনোয়ার, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মতো নেতাদের অভাব পূরণ করার মতো নেতৃত্ব বিএনপিতে গড়ে ওঠেনি।

বিএনপি নেতারা মনে করেন, তারেক রহমান দেশে ফিরে নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিয়ে এই ঘাটতি অনেকটা পূরণ করতে পারবেন। কিন্তু তারেক রহমান কবে ফিরবেন, তা এখনো নিশ্চিত নয়। এছাড়া দেশে ফিরে তাকে প্রার্থী ঠিক করা ও জোটের সঙ্গে সমঝোতার মতো বিশাল এক কর্মযজ্ঞ শেষ করতে হবে। বিএনপিতে প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থী নির্বাচন করতে চাইবেন। নির্বাচনের সময় বড় দলগুলোর জন্য এটি বড় সমস্যা।

এছাড়া বিএনপি নেতাদের অনেকে মনে করেন, এবার হয়তো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পড়তে হবে না। ফলে নির্বাচনে অংশ নিলে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এ অবস্থায় আগ্রহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়বে। এ নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে দলের মধ্যে বিভেদ ও বিভাজন বাড়তে পারে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, এবারের নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশ নেবেন। এরা নির্বাচনের ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।

বিএনপির আরেকটি সমস্যা হচ্ছে ন্যারেটিভ নির্মাণ। বিএনপি নেতারা আওয়ামী লীগের বহুল চর্চিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে চাইছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতির ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

সম্প্রতি কলকাতার ‌‘এই সময়’ ওয়েব পোর্টালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা বলেছি আওয়ামী লিগ ও তাদের শরিকরা সবাই, এমনকি জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে অংশ নিক। একটা সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট হোক। এ জন্য অনেকে আমাকে ভারতের এজেন্ট, আওয়ামীর দালাল বলে গালাগাল দিচ্ছে। কিন্তু শেখ হাসিনার অপকর্ম আমরাও কেন করব? হাসিনা ১৫ বছর প্রতিপক্ষকে ভোটে দাঁড়াতেই দেননি, তার শাস্তি পেয়েছেন। একই কাজ করলে আমরাও তো প্রতিফল পাব। তবে মানুষ এত রক্ত দেখেছেন, এত প্রাণহানি তাদের মধ্যে আওয়ামীবিরোধিতা রয়েছে।’ অবশ্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই সাক্ষাৎকার দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী জনগোষ্ঠী হচ্ছে বিএনপির ঐতিহাসিক ভোটব্যাংক। ভারত ও আওয়ামী লীগ নিয়ে বিএনপির অবস্থান তাদের বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। অনেকে বিএনপিকে একটি ভারতপন্থি দল হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন। বিএনপি নেতারা এমন আবহ তৈরি করেছেন।

নেতৃত্বের শূন্যতা জামায়াতে ইসলামীতেও রয়েছে। মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, আবদুস সুবহান, আবদুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান বা ব্যারিস্টার রাজ্জাকের মতো নেতৃত্ব দলটিতে এখন আর নেই। তবে ক্যাডারভিত্তিক দল হওয়ার কারণে জামায়াতের নেতৃত্বে কোনো শূন্যতা দৃশ্যমান হয় না। যে তরুণ নেতারা দলটির দায়িত্ব নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে আগের নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ভিন্ন ধরনের হতে পারে। বিএনপির সঙ্গে আগের নেতাদের সম্পর্ক যে মাত্রায় ছিল, বর্তমান নেতাদের তেমনটা নেই। রাজনৈতিক বোঝাপড়ার জায়গায় ভিন্নতা আছে।

তবে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান দ্রুত একজন জাতীয় নেতা হিসেবে পরিচিত পেয়েছেন। তার জনসম্পৃক্ততা আগের জামায়াত নেতাদের থেকে ভিন্ন চরিত্রের। শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে জামায়াত একধরনের গণমুখী দলে পরিণত হওয়ার চেষ্টা করছে। ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের অন্তর্ভুক্তিমূলক ও উদারনীতির সাফল্যের প্রভাব জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী নির্বাচনেও পড়তে পারে। আগে প্রার্থী নির্বাচনে যে দলীয় বিধিনিষেধ ছিল, তাতে ছাড় দেওয়া হতে পারে। এমনকি দলটি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও নারীদের নির্বাচনে প্রার্থী করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। জামায়াতের এ ধরনের সিদ্ধান্ত রাজনীতির মাঠে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসতে পারে।

নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ ভোটের হিসাবনিকাশ অনেকখানি পাল্টে দিতে পারে। বিএনপির অনেক নীতিনির্ধারক মনে করেন, জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণ করতে পারলে উত্তরাঞ্চলকেন্দ্রিক জামায়াতের আসন কমে আসতে পারে। এতে জামায়াত নয়; বরং আওয়ামী ভোটের জোরে বিরোধী দলের আসনে বসতে পারে জাতীয় পার্টি। তবে ভোটের মাঠে পরিস্থিতি ভিন্নরূপ নিতে পারে। এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টি বৃহত্তর রংপুরে তেমন আবেদন সৃষ্টি করতে পারবে না। মূলত উত্তরাঞ্চলের মানুষ এরশাদকে ভোট দিতেন, জাতীয় পার্টিকে নয়। দলটি হয়ে উঠতে পারে আওয়ামী লীগ প্রভাবিত এলাকার রাজনৈতিক শক্তি।

সে ক্ষেত্রে দেশের মধ্যাঞ্চল গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, খুলনার কিছু এলাকা ও ময়মনসিংহসহ বেশ কিছু এলাকায় জাতীয় পার্টি ভালো ফল করতে পারে। নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না যথার্থই বলেছেন, জাতীয় পার্টি এখন আওয়ামী লীগের লেজ নয়, মাথা। বাস্তবতা হচ্ছে, পতিত আওয়ামী লীগের শক্তিতে বলীয়ান হতে পারে জাতীয় পার্টি। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিএনপি। কারণ আওয়ামী লীগ প্রভাবিত এই এলাকাগুলোয় বিএনপি প্রার্থীরা বিজয়ী হয়ে আসতে পারতেন, জামায়াত নয়। ফলে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ বিএনপির আসন কমে আসতে পারে।

বাস্তবতা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন ঘিরে ভোটের রাজনীতিতে কোন ধরনের সমীকরণ সাফল্য পাবে, তা অনুমান করা কঠিন। এর প্রধান কারণ ভোটারদের মনোজগতে বড় পরিবর্তন। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইনারির বাইরে নতুন এক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের নীতির ব্যাপারে এ দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ। আওয়ামী লীগের দেড় দশকের নিপীড়নমূলক নীতি ও হত্যাকাণ্ডের ক্ষত এখনো শুকায়নি। আওয়ামী লীগ ও ভারতের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ভোটের মাঠে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ

সূত্র, আমার দেশ