গত দেড় দশকে বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র শুধু একটি প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে নয়, বরং ক্ষমতার অন্যতম প্রধান আধার হিসেবে গড়ে উঠেছে। এ সময়টিতে আমলাতন্ত্র শুধু তার প্রশাসনিক কর্তৃত্বই বিস্তার করেনি, বরং রাজনৈতিক পক্ষপাত, সীমাহীন দুর্নীতি এবং জবাবদিহিহীনতা দিয়ে একপ্রকার ‘ছায়া শাসনব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করেছে। জাতি যখন একটি আমূল পরিবর্তনের প্রত্যাশায় অন্তর্বর্তী সরকারের দিকে তাকিয়ে ছিল, তখন এই সরকারের কাছ থেকে আমলাতন্ত্র সংস্কারে কার্যকর পদক্ষেপ আশা করেছিল মুক্তিকামী মানুষ। কিন্তু বাস্তবে সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। বরং, কিছু ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা কাঠামোগত পরিবর্তন বা দীর্ঘ মেয়াদে কতটা প্রভাব রাখবে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলার পরিবর্তে সেগুলোর ওপর দোদুল্যমান মনোভাব বজায় রাখা বর্তমান সরকারের নৈতিক ভিত্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে নীরবতাইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র নিয়ে নীরবতা

জুলাই বিপ্লব ছিল একটি যুগান্তকারী রাজনৈতিক মুহূর্ত যেখানে সাধারণ মানুষ, তরুণ প্রজন্ম এবং পেশাজীবীরা রাস্তায় নেমে একটি দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এই গণঅভ্যুত্থানে বহু মানুষ শহীদ হয়, শত শত মানুষ আহত হয়, যাদের কেউ কেউ চিরতরে পঙ্গু হয়ে পড়ে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এই বিপ্লবের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এখনো আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের মতো মৌলিক দায়িত্ব পালনে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। শহীদদের পরিবারগুলোর ক্ষতিপূরণ বা সম্মানজনক সহায়তা, আহত ও পঙ্গু বিপ্লবীদের সঠিক চিকিৎসার সুযোগ, পুনর্বাসন বা কর্মসংস্থানের মতো মৌলিক বিষয়গুলো অবহেলার শিকার হয়েছে। অনেকেই নিজের খরচে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে, অনেকে পরিবারসহ অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। এই অবহেলা শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; এটি একটি নৈতিক বিচ্যুতি।

জুলাই বিপ্লবের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার ও সন্ত্রাস নির্মূলে অন্তর্বর্তী সরকার ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে একটি বিশেষ অভিযান শুরু করে। লক্ষ্য ছিলÑআওয়ামী শাসনামলে সৃষ্ট দলীয় সন্ত্রাসী চক্র, ক্যাডার বাহিনী এবং চাঁদাবাজ গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে দমন করা। কিন্তু এই অভিযানকে সফল হতে দেয়নি ফ্যাসিবাদের দোসররা।

সরকারের পথচলায় নীতিগত অগ্রাধিকার নির্ধারণের আগেই নানামুখী বিভ্রান্তি ও মতানৈক্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দলগত হিসাবনিকাশ, ব্যক্তিগত প্রভাবÑএসব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অভ্যন্তরে এক গভীর রাজনৈতিক সংকট দানা বাঁধছে। এতে সরকারের স্থিতিশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়া আশঙ্কাজনকভাবে থমকে যাচ্ছে।

‘স্বৈরাচার যেন আর কখনো ফিরে আসতে না পারে’‘স্বৈরাচার যেন আর কখনো ফিরে আসতে না পারে’

৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনার আবহ তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে—যেখানে ভারতের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের বক্তব্য এবং কূটনৈতিক মনোভাব বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতি অসন্তোষ ও বিরূপতা প্রকাশ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দেশটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা একযোগে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কটূক্তিপূর্ণ ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছেন। ভারতের মূলধারার কয়েকটি গণমাধ্যম ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারবিরোধী একপক্ষীয় প্রচার চালাচ্ছে । ‘গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া, সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পিত গল্প ছড়ানো, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল এবং সর্বশেষ সীমান্তে উত্তেজনা বাড়িয়ে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ ঘটনার মাধ্যমে ভারত যেন পরিকল্পিতভাবে ঢাকা সরকারকে চাপে ফেলতে চাচ্ছে।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায়, সরকারের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপগুলো মিলিয়ে এক ধরনের ধারাবাহিক বিভ্রান্তি ও ভুলের চক্র বা ‘চেইন অব এরর’ সৃষ্টি হয়েছে। এখনই এই প্রবণতার লাগাম টেনে ধরা না গেলে, অপার সম্ভাবনাময় এই রূপান্তর পর্বটি ‘রেন অব এরর’ নামে ইতিহাসে স্থান করে নেওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

লেখক : শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র, আমার দেশ