ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করার আগেও ইরান একটা উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিল। ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানÑইরানের এই তিন প্রধান পরমাণু স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র হামলা করার পর কীভাবে এর জবাব দেওয়া যায়, তা নিয়ে সোমবার সকালে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের জরুরি বৈঠকে আলোচনা হয়। এই তিনটিসহ ইরানের অন্য পরমাণু স্থাপনাগুলো এর আগে ইসরাইলের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর প্রধান তিনটিতে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী বোমা হামলা, সেগুলোর আরো বেশি ক্ষতি করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরানের পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।

ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিগুলোয় পাল্টা আঘাত করার নির্দেশ দেন। ইরানের যুদ্ধ পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চারজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নিজেদের পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব কর্মকর্তা আরো জানান, আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোয় হামলার নির্দেশ দিলেও হামলার মাত্রা যেন সীমিত আকারের হয়, সেই নির্দেশনাও দেন তিনি। কারণ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো সর্বাত্মক যুদ্ধ চান না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ইরানি কর্মকর্তারা। ইরানের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে যাতে নতুন করে হামলা এড়ানো যায়, সেটাও মাথায় রেখেছিলেন খামেনি।

এ কারণেই ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) কাতারের আল-উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিকে বেছে নিয়েছিল। আইআরজিসির দুজন কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন, তারা দুটি কারণে কাতারের আল-উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিকে টার্গেট করে। এটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। ইরানের পরমাণু স্থাপনায় সপ্তাহান্তে মার্কিন বি-২ বোমারু বিমান যে হামলা চালায়, তাতে সমন্বয়ের কাজটি করা হয়েছে এই ঘাঁটি থেকেই।

কিন্তু কাতার ইরানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় হামলায় ক্ষয়ক্ষতি যতটা সম্ভব কম হয়, তা নিশ্চিত করতে চেয়েছে ইরান। এ কারণে, হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই ইরানের পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করা হতে থাকে যে, মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা আসন্ন। এ ছাড়া, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে হামলা বিষয়টি অবহিত করা হয়। এরপরই কাতারের আকাশসীমা বিমান চলাচলের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রকেও হামলার ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়, যাতে সেখানে তাদের সেনাসদস্যরা হতাহত না হন।

কিন্তু ইরানি জনগণকে খুশি করার জন্য প্রকাশ্যে বলা হতে থাকে, পরমাণু স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিশোধ কঠোরভাবে নিয়েছে ইরান। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত দেওয়া ভাষণে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেন, বিপ্লবী গার্ড বাহিনী কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে এ হামলা করেছে। মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা আমাদের শত্রুদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছি যে, আঘাত করে পালিয়ে যাওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে।’

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর সেটি কাতারের আকাশে পৌঁছার ভিডিও ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভিতে প্রচারের সময় জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। এ সময় টিভির উপস্থাপক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানের গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাসও তুলে ধরেন। কিন্তু এসবের অন্তরালে ইরানের নেতারা আশা করেছিলেন, কাতারে সামরিক ঘাঁটিতে সীমিত হামলা এবং এ ব্যাপারে আগাম সতর্কবার্তা প্রদান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সংযত আচরণ করতে সহায়তা করবে। তারা আরো আশা করেন, ইরানে ইসরাইলের বিমান হামলা বন্ধ করতেও চাপ দেবে ট্রাম্প প্রশাসন।

এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে অস্ত্রবিরতি চুক্তি হওয়ার ঘোষণা দেন। ট্রাম্পের এই আকস্মিক ঘোষণায় তার প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও বিস্মিত হয়েছেন। কূটনীতিকরা বলছেন, চলমান যুদ্ধ বন্ধে কাতার হস্তক্ষেপ করে এবং অস্ত্রবিরতি চুক্তি মেনে নিতে ইরানকে রাজি করায়। এখন সবকিছুই পরিকল্পনামতো সামনে এগোচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দেওয়ার পর ট্রাম্প বলেন, কাতারের আল-উদেইদ ঘাঁটিতে ইরানের ছোড়া ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ১৩টিই ভূপাতিত করা হয়েছে। সেখানে কোনো মার্কিন সেনা হতাহত হননি এবং ঘাঁটির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে খুব সামান্যই। ওখানে হামলার আগাম বার্তা দেওয়ার জন্য ট্রাম্প ইরানকে ধন্যবাদ জানান। কারণ আগাম বার্তা দেওয়ায় মার্কিন সেনাদের হতাহত হওয়ার বিষয়টি এড়ানো সম্ভব হয়েছে। ট্রাম্প বলেন, ‘ইরানিরা তাদের সিস্টেমের মধ্য থেকেই সবকিছু করেছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে ঘৃণা বা বিদ্বেষমূলক সম্পর্কের অবসান ঘটবে।’ এরপরই ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ইরান এবং ইসরাইলের মধ্যেও অস্ত্রবিরতি আসন্ন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি অস্ত্রবিরতির জন্য চমৎকার একটি সুযোগ তৈরি করেছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানি পরিচালক আলি ভায়েজ বলেছেন, পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, এখন এই সংঘাতে জড়িত প্রতিটি পক্ষই নিজেদের বিজয়ী দাবি করার বয়ান তৈরি করতে পারবে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও বাইরে বৃহত্তর সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে মারাত্মক পরিণতির ঝুঁকি এড়ানোর পথও পরিষ্কার হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

মার্কিন সাম্রাজ্য এবং অতঃপরমার্কিন সাম্রাজ্য এবং অতঃপর

আলি ভায়েজ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন বলতে পারবে যে, তারা পরমাণু কর্মসূচি থেকে পিছু হটতে ইরানকে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছে। ইসরাইল দাবি করতে পারবে, তারা তাদের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ ইরানকে দুর্বল করে দিতে পেরেছে।’ অন্যদিকে, ‘ইরান বলতে পারবে, তারা অনেক বেশি সামরিক শক্তিধর দেশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ে তাদের প্রতিহত করেছে।’ তবে যুদ্ধ প্রলম্বিত বা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার যে ধারণা ইরানের ছিল, এর সম্ভাবনা কমে গেছে।

হামলার মাধ্যমে ইরানের ইসলামপন্থি সরকারের পতন ঘটানোর যে পরিকল্পনা ইসরাইলের ছিল, তার কিছুই ঘটেনি হামলার পর। বরং ইরানিরা দল-মত নির্বিশেষে তাদের জাতীয় পতাকার নিচে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তারা সম্মিলিত কণ্ঠে ইসরাইলি সামরিক আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে। সপ্তাহব্যাপী ইসরাইলি হামলায় ইরানের অর্থনীতির কতটা ক্ষতি হয়েছে, তার একটি চিত্র সামনে আসবে কিছুদিনের মধ্যেই। কারণ ইসরাইলি হামলায় হাজার হাজার মানুষ রাজধানী তেহরান ও অন্যান্য এলাকায় তাদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। সাধারণ কর্মজীবী মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল প্রায় সর্বত্রই। সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোও খুলেছে সীমিত সময়ের জন্য। ফলে সবারই চাওয়া ছিল যত দ্রুত যুদ্ধ বন্ধ হয়, ততই দেশের জন্য মঙ্গল।

এ সম্পর্কে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পার্টির চেয়ারম্যান সাদেগ নোরুজি তেহরানে নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘এই যুদ্ধ অব্যাহত রাখার মতো সামর্থ্য আমাদের দেশের নেই। আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা আছে। এ ছাড়া ইসরাইল ও আমেরিকার মতো সামরিক শক্তি এবং প্রযুক্তি সক্ষমতাও আমাদের নেই।’ অন্যদিকে, বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক করিম জাফরি তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, ‘ইরানের উচিত যুদ্ধকে ইসরাইলের সঙ্গে সীমিত রাখা, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া উচিত হবে না।’

পশ্চিমা কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরও ইরানের ইউরেনিয়ামের মজুতের কী হয়েছে, সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত নন। তাদের প্রশ্নÑইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সক্ষমতা এখনো ইরানের আছে কি? তারা কি আবার গোপনে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে, নাকি নতুন নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য আলোচনায় বসবে?

ভারতীয় নৌযানের বেপরোয়া চলাচলে বিপর্যস্ত সুন্দরবনভারতীয় নৌযানের বেপরোয়া চলাচলে বিপর্যস্ত সুন্দরবন

এদিকে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি কূটনৈতিক সফরে তুরস্ক, রাশিয়া ও তুর্কমেনিস্তান ভ্রমণ করছেন। কাতারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলার পর তিনি ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তার দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা আমাদের ক্ষতি করতে পেরেছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তারা আমাদের সক্ষমতাকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং আমাদের প্রধান লক্ষ্য অর্জন করার পথ থেকে সরাতে পারেনি।

লেখক : জাতিসংঘে নিউইয়র্ক টাইমসের ব্যুরো চিফ

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে অনুবাদ: মোতালেব জামালী

বিষয়: যুক্তরাষ্ট্র ,ইসরাইল, ইরান

সূত্র, আমার দেশ