আমরা কি ভুলে গেছি ‘মায়ের ডাকের’ সেই দুঃসাহসী মায়েদের ভূমিকার কথা? জুলাই বিপ্লবের পর এক বছর কেটে গেলেও রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনটির কাউকে কোথাও দেখছি না। অথচ তারা সবাই রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। আর তাদের আপনজনরা রাজনৈতিক কারণেই শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। একবার ভাবুন সেসব পরিবারের সদস্যের কথা, যাদের মা হারিয়েছেন স্বামী, সন্তান হারিয়েছেন বাবা, বোন হারিয়েছেন ভাই। তাদের প্রিয়জনরা আর কখনো ফিরে আসবেন না আপন পরিবারে।
অথচ এই মায়ের ডাক সংগঠনটিই প্রথম ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে গুম-খুনের নৃশংস ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিকীকরণ করেছিল। যার ফলে বিশ্বের সব মানবাধিকার সংস্থা ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। শুধু রাজনৈতিক ভিন্নমত থাকার কারণে যারা গুম-খুনের শিকার হয়েছেন, তাদের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক, অর্থাৎ পাঁচ শতাধিক পরিবার। আর এই পরিবারগুলোর শোকের বোঝা কোনো রাজনৈতিক নেতার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। এই শোক পাহাড়ের থেকেও ভারী।
উল্লেখ্য, এই গুম ও খুনের শিকার অধিকাংশ মানুষই ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতা ও কর্মী। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির কোনো সমাবেশে কিংবা আলোচনা সভায় গুম-খুনের শিকার পরিবারগুলোর কাউকে সেভাবে দেখা যায়নি। অথচ এরাই ছিল আরেক বিপ্লবী গোষ্ঠী, যারা সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কর্মসূচি চালিয়ে গেছে। এরাই প্রথম ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে’ মামলা করে বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভীরুতার প্রতি ধিক্কার জানিয়েছে।
‘মায়ের ডাক’ হচ্ছে গুম ও খুনের শিকার পরিবারগুলোর একটি প্ল্যাটফর্ম, যারা খুব সফলভাবে সরকারের গুম ও খুনের বিরুদ্ধে এমনভাবে প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন, যা রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে তাদের স্বজন হারানোর আকুতি বিশ্ব বিবেককে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই সংগঠনটি সেসব পরিবারের সদস্যরা বানিয়েছেন, যাদের প্রিয়জন গুম-খুনের শিকার হয়েছিলেন। আর অন্যদিকে তারা এ রকম একটি সংগঠন তৈরির ধারণাটি নিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা থেকে।
Mayer-Dak
অনেকের এটি স্মরণ থাকতে পারে, ঠান্ডা যুদ্ধকালে লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে অপহরণ, গুম-খুন ইত্যাদি নানা রকম নির্যাতন ছিল একটি স্বাভাবিক ঘটনা। আর্জেন্টিনা তার ব্যতিক্রম ছিল না। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনায় সামরিক জান্তা শত শত নারী-পুরুষকে কমিউনিস্ট সন্দেহে অপহরণ করে গোপন স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করত। এমনকি বিমানে তুলে নিয়ে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় মানুষকে আটলান্টিক মহাসাগরে নিক্ষেপ করত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, সামরিক জান্তা ১০ থেকে ৩০ হাজার মানুষকে এভাবে হত্যা করেছে, যাদের শতকরা ৩০ ভাগ ছিল নারী। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শিশুসন্তানসহ মাকে অপহরণ করা হয়েছে। তখন এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সারা বিশ্বে ‘ডার্টি ওয়ার’ অর্থাৎ নোংরা যুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল।
এ রকম এক লোমহর্ষক নিষ্ঠুর শাসনের বিরুদ্ধে নিখোঁজ ব্যক্তিদের মায়েরা প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমে আসেন। সঙ্গে ছিলেন দাদিরাও। প্রতি বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩টায় মিছিল করে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের বিখ্যাত স্কোয়ার প্লাজা ডি মায়োতে তারা জড়ো হতেন নিখোঁজ সন্তানদের খবর জানার জন্য। যে সংগঠনটির ব্যানারে তারা মিছিল করতেন, তার নাম ছিল ‘মাদারস অব দ্য মায়ো’। ১৯৮৩ সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর জান্তা সরকারের বিদায় ঘটলেও ওই মায়েরা হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিলেন। আর আর্জেন্টিনার মায়েদের ওই অসাধারণ ভূমিকায় অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনটি সৃষ্টি করা হয়।
এ সংগঠনটি ২০০৯ সাল থেকে যারা নিখোঁজ হয়েছেন, তাদের খোঁজখবর নিয়ে লিপিবদ্ধ করা শুরু করেন। প্রথমদিকে তারা কোনো সাংগঠনিক কাঠামো ছাড়াই কাজ শুরু করেন। ২০১৪ সালের দিকে তাদের কার্যক্রম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর ২০১৬ সালের ১৭ মার্চ তারা ‘মায়ের ডাক’ নামে আত্মপ্রকাশ করেন। সংগঠনটির সমন্বয়ক হিসেবে মনোনীত হন ভাই হারানো এক বোন, যার নাম সানজিদা ইসলাম। তার ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমনকে সরকারের গোপন সংস্থা অপহরণ করে নিয়ে যায়। সে আর কখনো ফিরে আসেনি। আমরা কি সেই অসীম সাহসী নারী সানজিদা ইসলামের কথা মনে রেখেছি? অথচ সানজিদা ও তার দুঃসাহসী সাথিরাই ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির বিপ্লবী।
এখানে উল্লেখ করতে হয়, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পরপরই শুরু করে আর্জেন্টাইন স্টাইলে সেই ‘ডার্টি ওয়ার’-এর মতো ঘটনা অর্থাৎ রাজনীতিতে ভিন্নমত পোষণকারী নেতাকর্মীদের গুম-খুনের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার অভিযান, যাকে দলটির ঐতিহ্যগত নৃশংস কৌশল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেটি আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলে প্রত্যক্ষ করেছি। আর্জেন্টিনায় তথাকথিত কমিউনিস্টবিরোধী নোংরা যুদ্ধ শুরুর বেশ আগেই ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কমিউনিস্ট, নকশাল, সর্বহারা, জাসদের গণবাহিনীর সদস্য ইত্যাদি সন্দেহে শত শত ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতাকর্মী গুম ও খুনের শিকার হয়েছিলেন। তখন শেখ মুজিবুর রহমান নকশাল দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশ সম্পর্কে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেছিলেন, মুজিবুর, নকশাল কি গায়ে লেখা থাকে?
তৎকালীন বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের হিসাব অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ২৯ হাজারের মতো ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। তখন গুম হওয়া মানুষদের লাশ পড়ে থাকত বড় বড় সেতুর নিচে। তাই সে সময় কেউ অপহৃত বা নিখোঁজ হলে আত্মীয়স্বজন প্রথমে খুঁজতে যেতেন নগরীর আশপাশের সেতুগুলোয়।
আর শেখ হাসিনা তার ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে মূলত বাবার পথই অনুসরণ করেন। তবে তিনি যে ন্যারেটিভটি দাঁড় করান, সেটি পিতা শেখ মুজিবুর রহমান থেকে ভিন্ন ছিল। অর্থাৎ এবার আওয়ামী লীগ কমিউনিস্ট, নকশাল, কিংবা গণবাহিনী নয় : বরং আওয়ামী লীগবিরোধী সব রাজনৈতিক পক্ষকে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও ইসলামপন্থিদের জঙ্গি হিসেবে অভিহিত করে নির্মূল করার পন্থা অবলম্বন করেন। তাই সরকারের গোপন বাহিনী যখন-তখন স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গি হিসেবে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে তুলে নিয়ে যেত। তাদের আর কখনোই খোঁজ পাওয়া যেত না। যারা এর বিরুদ্ধে আঙুল তুলতেন, তারাই নিখোঁজ হয়ে যেতেন। এ রকম এক পরিস্থিতিতে মায়ের ডাকের সদস্যরা যে সাহস দেখিয়েছেন, তা ছিল তুলনাহীন। শেখ হাসিনার পতন হওয়ার পর তাদের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে কি না জানি না। তবে আমার মনে হয়, আর্জেন্টিনার মায়েদের মতোই খুনিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত মায়ের ডাকের আন্দোলন অব্যাহত থাকা উচিত।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক