ইসরাইলি বোমার আঘাতে আহত মৃত্যুপথযাত্রী গাজার শিশুদের যন্ত্রণার কাহিনি লিখতে বসে দুদিন আগে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনার শিকার আগুনে দগ্ধ বাংলাদেশি শিশুদের যন্ত্রণাকাতর চিৎকার যেন শুনতে পাচ্ছি। সন্তান হারানোর শোক কোনো জাতি, বর্ণ বা ধর্মভেদে ভিন্ন হওয়া উচিত নয়। কিন্তু বিশ্বের সব ক্ষমতাশালী দেশের শাসকশ্রেণি মানবিক শোকের মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টি করে ফেলেছে। পৃথিবীটাকেই বড় নিষ্ঠুর বলে মনে হচ্ছে। ঢাকার সেই দুর্ঘটনায় নিহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে শিরোনামের বিষয়ে ফিরে যাচ্ছি। কদিন আগে ইসরাইলের বর্বর বাহিনী গাজার একটি ক্যাথোলিক গির্জা লক্ষ করে ট্যাংকের গোলা নিক্ষেপ করেছে। সেই গির্জায় ইসরাইলি বোমা থেকে বাঁচতে কয়েকশ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন। গোলার আঘাতে তিনজন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের তালিকায় গির্জার পাদ্রি ফাদার গেব্রিয়েল রোমানেলিও আছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির প্রত্যক্ষ মদতে প্রায় দুই বছর ধরে চলমান গাজার গণহত্যায় এরকম হত্যাকাণ্ড দিনরাত চলছে। যেদিন জায়নবাদীরা গির্জায় আক্রমণ চালিয়ে তিনজন খ্রিষ্টানকে হত্যা করেছে, সেই একই দিনে পুরো গাজায় বোমা ও মিসাইলে নিহত মুসলমান শিশু, নারী ও পুরুষের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত গাজার জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ হতাহত হলেও যেসব পশ্চিমা সরকারপ্রধান কেবল চোখ বুজে এবং মুখ বন্ধ করেই থাকেননি, উপরন্তু ইসরাইলকে গণহত্যায় রসদ ও উৎসাহ জুগিয়েছেন, সেই তারাই এক ক্যাথোলিক গির্জায় গোলাবর্ষণ হতেই মৃদু হলেও প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছেন। ইতালির প্রধানমন্ত্রী মেলোনি এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। ইসরাইলের কট্টর সমর্থক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পর্যন্ত টেলিফোন করে আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যার দায়ে ফেরারি আসামি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কাছে তার অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু একই দিনে ইসরাইলি বোমাবর্ষণে গাজার শতাধিক মুসলমানের নিহত হওয়ার কথা তারা একবার উল্লেখও করেননি। সেখানে যে শিশুরা খেতে না পেয়ে কঙ্কালসার হয়ে কত কষ্ট পেয়ে মরে যাচ্ছে, তারও কোনো প্রতিবাদ করেননি। আমরা এই নির্মমতায় মোটেও বিস্মিত হই না। পশ্চিমা এস্টাবলিশমেন্টের কাছে ফিলিস্তিনের মুসলমানরা একেকজন সংখ্যামাত্র—নাম নেই, তাদের কোনো চেহারা নেই, তাদের প্রাণের কোনো দাম নেই। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত পশ্চিমা শাসকদের ভণ্ডামি সব সীমা অতিক্রম ছাড়িয়ে গেছে। গাজায় খ্রিষ্টানদের উপাসনালয়ের নিরাপত্তা নিয়ে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, অথচ সেই ছোট ভূখণ্ডে টার্গেট করে মুসলমানদের সব মসজিদ ধ্বংস করা হলেও এই বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক নেতাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছ থেকে টেলিফোনে ধমক শোনার পর যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহু গির্জায় হামলার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছেন। ট্রাম্পকে সন্তুষ্ট করার জন্য ইসরাইলি বাহিনী কয়েকজন পাদ্রিকে জেরুসালেম থেকে সাহায্যসামগ্রী নিয়ে গাজায় প্রবেশ করে ক্ষতিগ্রস্ত গির্জা পরিদর্শনের অনুমতিও দিয়েছে, কিন্তু গণহত্যা চালানোর অনুমতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। পাঠকদের গাজার পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝার সুবিধার্থে ইসরাইলের ধ্বংসযজ্ঞের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি। মসজিদের পরিসংখ্যান দিয়েই শুরু করি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ বছর ১৮ জুলাই পর্যন্ত ইসরাইল সহস্রাধিক মসজিদকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। সেসব মসজিদে আশ্রয় নেওয়া অসংখ্য ফিলিস্তিনি বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন। শুধু বোমাবর্ষণ করেই ইসরাইলি বাহিনী ক্ষান্ত থাকেনি। বোমা হামলার পর তারা অনেক মসজিদ বুলডোজার দিয়েও গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর মধ্যে রয়েছে—খালিদ বিন ওয়ালিদ মসজিদ, গ্রেট ওমরি মসজিদ, ওসমান বিন কাশকার মসজিদ এবং সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস মসজিদ। ইসরাইল গাজার ৮৮ শতাংশ স্থাপনা বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে এবং ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করেছে। জোরপূর্বক স্থানচ্যুত করে গাজার সব অধিবাসীকে ভূখণ্ডের মাত্র ১৬ শতাংশ জায়গার মধ্যে আবদ্ধ করেছে। এ পর্যন্ত গণহত্যায় নিহত ৬৮ হাজার জনের মধ্যে ১৯ হাজার শিশু এবং ১২ হাজার ৫০০ নারী রয়েছে। নিহতদের মধ্যে এক হাজার জনের অধিক শিশু, নারী ও পুরুষকে ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে ইসরাইলি সেনা ও মার্কিন ভাড়াটে বাহিনী। ইসরাইলি দখলদার বাহিনী ৩৮টি হাসপাতাল, ৯৬টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ২৬১টি আশ্রয়কেন্দ্র ও ১৫৬টি স্কুল ধ্বংস করেছে। রিয়াল টাইমে প্রতি মুহূর্তে এই সংখ্যা বাড়ছে। গাজায় স্বাস্থ্যসেবা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। স্যাটেলাইটে গাজার ধ্বংসযজ্ঞের চেহারা দেখলে মনে হয় যেন হলিউডের কোনো সাই-ফাই সিনেমায় আগামী বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর কোনো কাল্পনিক দৃশ্য দেখছি। এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে ২০ লাখ আদমসন্তানকে অনাহারে ও পিপাসায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার ঘটনা। নিষ্পাপ শিশুদের কঙ্কালসার চেহারা দেখলে চোখের পানি আটকে রাখা কঠিন। সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে দখলদার ইসরাইল গাজার ওপর এমন কঠিন অবরোধ আরোপ করেছে, যাতে কোনো খাদ্যদ্রব্য অবরুদ্ধ ভূখণ্ডে পৌঁছাতে না পারে। খাবারের জন্য অপেক্ষমাণ অসহায় মানুষদের মেশিন গান থেকে গুলি চালিয়ে প্রতিদিন হত্যা করা হচ্ছে। সেখানে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে, যাতে মানুষ পিপাসায় এবং বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও পার্শ্ববর্তী দখলকৃত কতিপয় রাষ্ট্রে হিটলারের নাৎসি বাহিনী ৬০ লাখ ইহুদিকে নানা উপায়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছিল। ইহুদিদের গরু-ছাগলের মতো গাদাগাদি করে মৃত্যু পর্যন্ত আটক রাখার জন্য কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ তৈরি করেছিল। অসহায় ইহুদিদের সেই চরম অমানবিক দুর্দশা নিয়ে হলিউডে শত শত সিনেমা নির্মিত হয়েছে। সেসব সিনেমায় ইহুদিদের ওপর জুলুমের দৃশ্য দেখে আমাদের চোখ ভিজে এসেছে। আজও লিখতে বসে এক পোলিশ পিয়ানোবাদকের করুণ কাহিনির ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ এবং হলিউডের বিখ্যাত পরিচালক স্পিলবার্গের ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’-এর কথা মনে পড়ছে। কী আশ্চর্য, সেদিনকার ভিকটিম ইহুদিদের এক বড় অংশ আজ গণহত্যাকারী জায়নিস্ট রূপে আবির্ভূত হয়েছে! সেই ইহুদিদের উত্তরপুরুষরাই ফিলিস্তিনে একই কায়দায় গণহত্যা চালাচ্ছে, গাজায় হিটলারের মতো ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ তৈরি করছে। ৯০ বছর আগে যে জার্মানি ইহুদিদের হত্যা করেছিল, আবার সেই রাষ্ট্রই ফিলিস্তিনের নাগরিকদের ওপর গণহত্যা চালানোর জন্য ইসরাইলকে রসদ জোগাচ্ছে এবং ইইউ ও জাতিসংঘে বাছবিচারহীন কূটনৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। অবাক লাগে, প্রায় শত বছরের ব্যবধানেও কোনো শিক্ষা না নিয়ে ইউরোপের বৃহৎ ও সমৃদ্ধিশালী দেশটি ইতিহাসের ভুল অংশেই দাঁড়িয়ে রইল। জার্মানদের দুর্ভাগ্য, গণহত্যার দায় থেকে তাদের মুক্তি নেই। পশ্চিমাদের এই নির্মম মানসিকতার উৎস খুঁজতে হলে আমাদের ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জানতে হবে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর যোগসাজশেই ১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল নামক একটি বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র বানানো হয়েছিল। ইসরাইলের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি, যার মধ্যে আরব মুসলমানের সংখ্যা ১৮ লাখ। দেশটির মুসলমান নাগরিকদের অধিকার ক্রমাগতভাবে সংকুচিত করে তাদের প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। এর ফলে অনেক বিবেকবান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইসরাইলকে একসময়কার শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার সমচরিত্রের ধর্মীয় বর্ণবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করেন। দেশটির ইহুদি জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আগত অভিবাসী। মূলত ইউরোপ থেকে আগত অভিবাসীরাই এখন ইসরাইল চালাচ্ছে। চরিত্রগতভাবে এরা ভয়ানক ইসলামবিদ্বেষী। এই অভিবাসীদের মধ্যে ১০ শতাংশ, অর্থাৎ সাত লাখ ইহুদি অধিকৃত পশ্চিম তীরে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ অবৈধ পত্তনিতে বসবাস করে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় ফিলিস্তিনের ৮০ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজস্ব জমি ও বাড়িঘর থেকে বিতাড়ন করা হয়েছিল। সেই জাতিগত উচ্ছেদের কোনো বিচার হয়নি। অবৈধ পত্তনির ইহুদিরা ফিলিস্তিনের জমি দখল করার আদি প্রক্রিয়া আজ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। এই অবৈধ বাসিন্দারা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরে হামলা চালাচ্ছে, জলপাই গাছের বাগান ধ্বংস করছে এবং সেখানকার চারণভূমিতে পশুহত্যা চালাচ্ছে। দখলদার সেনাবাহিনী ও অবৈধ ইহুদি অভিবাসী সন্ত্রাসীরা মিলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ বছরের ১৬ জুলাই পর্যন্ত দখলীকৃত পশ্চিম তীরে ২০৪ জন শিশুসহ ৯৬৮ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এই ৯৬৮ জন ফিলিস্তিনির মধ্যে পাঁচজন মার্কিন নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ওয়াশিংটন প্রশাসন এ ব্যাপারে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অর্থাৎ ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকের প্রতিও তাদের কোনোরকম দায়িত্ববোধ নেই। এদের পুরোপুরি মার্কিন নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। বাংলাদেশের যেসব তরুণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের স্বর্গভূমি মনে করে সে দেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে, তাদের বাস্তবতা জানা উচিত। বাস্তব বড় রূঢ়। প্রয়োজনীয় মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া পশ্চিমে গেলে অনেকেই বড়সড় ‘সাংস্কৃতিক ধাক্কার’ মুখোমুখি হতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামোফোবিয়া এতটাই বিস্তৃত এবং গ্রহণযোগ্য আচরণ যে, রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট দল নির্বিশেষে জায়োনিস্ট কংগ্রেসম্যান ও সিনেটররা গাজায় চলমান গণহত্যায় মিডিয়ায় প্রকাশ্যে উল্লাস প্রকাশ করতে কোনোরকম সংকোচবোধ করেন না। এর জন্য তাদের কোনো তিরস্কারের মুখোমুখি হতে হয় না। সে দেশে সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের মতো রাজনীতিবিদরা একেবারেই ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যকার ‘বিশেষ সম্পর্ক’ সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন সমাপ্ত করব। আল জাজিরায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, নেতানিয়াহু ২০০১ সালে এ মন্তব্য করেছিলেন—“I know what America is. America is a thing you can move very easily, move it in the right direction. They won’t get in the way.” (আমি আমেরিকাকে জানি। আমেরিকাকে সহজেই সরানো যায়, তাদেরকে ঠিক দিকে পরিচালনা করা সম্ভব। তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না।) Netanyahu: US easily manipulated, Al Jazeera, Jul 18, 2010. https://www.aljazeera.com ভূরাজনীতির স্পর্শকাতর বিষয়টি নেতানিয়াহুর দম্ভোক্তির মতো এতখানি সরল না হলেও এটা সত্য যে, পুরো ইসরাইল প্রকৃতপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি। ইসরাইলের চারপাশের প্রায় সব রাষ্ট্রেই জ্বালানির বিপুল মজুত রয়েছে। তারা সব ধনী দেশ। পার্শ্ববর্তী সব সমুদ্রপথও (সুয়েজ খাল, হরমুজ প্রণালি, লোহিত সাগর, আরব সাগর) বিশ্ব নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া ইসরাইলের প্রতিবেশী মুসলিম বিশ্বের ছোট-বড় রাষ্ট্রের মধ্যে অনেকগুলোতেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হেজেমনিক রাষ্ট্রের কৌশলগত চিন্তায় ইসরাইল তাই মধ্যপ্রাচ্যে তার অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য পাহারাদার। বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটন ইসরাইলকে যুদ্ধে কিংবা কূটনীতিতে কোনো অবস্থাতেই পরাজিত হতে দেবে না। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সর্বদা ‘ইসরাইল ফ্যাক্টর’ বিবেচনায় রেখেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে মুসলিম বিশ্বের লজ্জাজনক অনৈক্য ও স্বার্থপরতা ইসরাইলের এই অপ্রতিরোধ্য দানব হয়ে ওঠার একটি অন্যতম কারণ বলেও আমি মনে করি। প্রশ্ন করতে পারেন—এই অবস্থার কি পরিবর্তন হবে না? প্রধানত স্বৈরতান্ত্রিক মুসলিম বিশ্বের কাছে আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার কারণে সে দেশের ইসরাইল-সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তন কেবল তখনই সম্ভব, যখন অধিকাংশ জনগণ হঠকারী ও উদ্ধত ইসরাইলকে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় সম্পদের পরিবর্তে বোঝা হিসেবে দেখবে। খুব ধীরে হলেও সেই দিকে জনমতের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। মার্কিন সংবাদ সংস্থা সিএনএনের একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, গাজায় গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার অধিকাংশ তরুণ দেরিতে হলেও জালিম ইসরাইলের তুলনায় মজলুম ফিলিস্তিনিদের প্রতি অধিক সহমর্মিতা বোধ করছে। ওই জরিপ অনুযায়ী, ৩৫ বছরের কম বয়স্ক মার্কিন তরুণদের মধ্যে ৭২ শতাংশ ইসরাইলকে প্রদত্ত বিপুল সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য হ্রাস অথবা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। ইউরোপের জনমতও ক্রমেই ইসরাইলের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। সেখানকার শাসকশ্রেণি ইসরাইলের সব অপকর্মে চোখ বুজে থাকার নীতি গ্রহণ করলেও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে মানবতাবোধ জাগ্রত হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের জায়নবাদী সরকারগুলো শত চেষ্টা করেও এই ডিজিটাল যুগে ইসরাইলের মানবতাবিরোধী অপরাধ আর ঢেকে রাখতে পারছে না। ফলে পৃথিবীতে ইসরাইল ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়ছে। ইউরোপে স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক ও স্লোভেনিয়া ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করার জন্য ইইউ’র ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। জায়নবাদী ভাবধারা-নিয়ন্ত্রিত জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও হাঙ্গেরির বিরোধিতার কারণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা না গেলেও আমি আশাবাদী, বিশ্ববিবেক জাগ্রত হতে আর বেশি দেরি নেই। ইনশাআল্লাহ ইসরাইলি জুলুমের অবসান ঘটবে এবং ফিলিস্তিনের নিপীড়িত জনগণ তাদের সার্বভৌম অধিকার আদায় করতে সক্ষম হবে।
মতামত
গাজার রক্তপ্রবাহে ভেসে গেছে বর্ণবাদী পশ্চিমের নৈতিকতার মুখোশ
এখন পর্যন্ত গাজার জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ হতাহত হলেও যেসব পশ্চিমা সরকারপ্রধান কেবল চোখ বুজে এবং মুখ বন্ধ করেই থাকেননি, উপরন্তু ইসরাইলকে গণহত্যায় রসদ ও উৎসাহ জুগিয়েছেন, সেই তারাই এক ক্যাথোলিক গির্জায় গোলাবর্ষণ হতেই মৃদু হলেও প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছেন। ইতালির প্রধানমন্ত্রী মেলোনি এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন।