এই সবুজ গ্রহের সবুজ একটা দেশ বাংলাদেশ। ছোট্ট এ দেশটিতে উদ্ভিদ বৈচিত্র্য অঢেল। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ছাড়া আর খুব কম দেশই আছে, যেখানে আমাদের মতো উদ্ভিদ ঐশ্বর্য আছে। এ দেশে প্রায় ৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ৫৪ প্রজাতির সংরক্ষিত উদ্ভিদ। বাংলাদেশের সংরক্ষিত উদ্ভিদ বলতে বোঝানো হয় সেসব উদ্ভিদকে, যেসব প্রজাতির উদ্ভিদ বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ আইনের চতুর্থ তফসিলে ৫৪ প্রজাতির উদ্ভিদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

এই তালিকা অনুযায়ী তালিপাম, হাতিশুড়, সিভিট, বইলাম, চুন্দুল, কুম্ভি, প্রশান্ত আমুর, ধুপ, কাটালাল বাটনা, কর্পূর, তেজবহুল, মনিরাজ, অনন্তমূল, পুদিনা, বাঁশপাতা, উড়ি আম, পাদাউক, রিটা, কুসুম/জয়না, উদাল, হাড়জোড়া, ত্রিকোণী বট, লতা বট, গয়া অশ্বত্থ, উর্বশী, উদয়পদ্ম, জহুরী চাঁপা, কুঁচ, কামদেব, কির্পা, কুর্চি, খলশী, গলগল, জইন, টালি, তমাল, বুদ্ধ নারকেল, হরিণা, সিংড়া, সমুন্দর ফল, বর্মি মাইলাম, পশুর, কোথ, খাসি পিচার প্লান্ট, বড় ভেন্ডপসিস অর্কিড, নীল রাস্না, লেডিস স্লিপার, রেড ভ্যান্ডা, বালবোফাইলাম, ডুথি, কুনছিছিরি, বেসক ডেনড্রোবিয়াম, মহা ডেনড্রোবিয়াম ও বাসন্তীরঙা ডেনড্রোবিয়াম। এসব উদ্ভিদ প্রজাতির তালিকার মধ্যে অবশ্য হাতিশুড়, লতা বট, কুর্চি, সিংড়া, পশুর গাছ থাকার যৌক্তিকতা কতখানি সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। তাই তালিকাটি পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে। সরকার ২০২৪ সালে ১০০০ উদ্ভিদ প্রজাতির বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করে ৩৯৫ প্রজাতির উদ্ভিদকে সম্মিলিতভাবে হুমকিগ্রস্ত বা বিলুপ্তির আওতাভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু সে তালিকায় সংরক্ষিত উদ্ভিদ প্রজাতি বলে কিছু নেই।

উক্ত আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী এসব প্রজাতির উদ্ভিদকে ইচ্ছাকৃতভাবে উঠানো, উপড়ানো, ধ্বংস বা সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ধারা লঙ্ঘনে দণ্ডের বিধানও রাখা হয়েছে। বারবার এ অপরাধ করলে দণ্ড বাড়বে। কিন্তু এরূপ গর্হিত কাজ বা অপরাধের জন্য কেউ কখনো দণ্ড পেয়েছেন বলে শুনিনি। রংপুর আরডিআরএসের দেয়ালভরা যে লতাবটের আচ্ছাদন, তা ছেঁটে না রাখলে তার সৌন্দর্যহানি হয়। মালিরা তা নিয়মিত ছাঁটছেন, কিন্তু ওদের কেউ কখনো দণ্ড পেয়েছেন কি না জানি না। প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষেরা কি এসব সংরক্ষিত প্রজাতির উদ্ভিদগুলো চেনেন যে তারা সেগুলো রক্ষায় সদা সতর্ক থাকবেন? এ আইন সম্পর্কে জানা তো পরের কথা। আর সেগুলো চিনলেও, কেন সেগুলো রক্ষা করা দরকার, সেসব কথা বুঝতে হবে, সেসব উদ্ভিদ প্রজাতির গুরুত্ব বুঝলে তারপর আসবে সেগুলো রক্ষার প্রয়াস। এক বাক্যে তাই বলা যায়, বাংলাদেশের সংরক্ষিত উদ্ভিদ মোটেই সংরক্ষিত না। এসব উদ্ভিদ প্রজাতির রক্ষণ এ দেশের উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ও পরিবেশের স্বার্থেই করা দরকার।

সংরক্ষিত উদ্ভিদগুলোর প্রধান আশ্রয়কেন্দ্র হতে পারত দেশের রক্ষিত বনগুলো। কিন্তু সেসব বনের বর্তমান অবস্থা আমাদের হতাশ করে। বাংলাদেশে ৫৩টি সংরক্ষিত বন রয়েছে। সেসব বনে সংরক্ষিত উদ্ভিদের চিত্রটা যদি দেখি, তাহলে সেখানেও উদ্ভিদকে সংরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে বেশ অপরিকল্পনা, অব্যবস্থাপনা ও গুরুত্বহীনতা ফুটে ওঠে। যেমন চট্টগ্রামে ৭ হাজার ৭৬৪ হেক্টরের চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে একসময় প্রায় ১ হাজার ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ ছিল, বর্তমানে (২০২৪) তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৯১ প্রজাতিতে। শতবর্ষী মাদার গর্জন গাছ চুনতি বনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। আজ সেসব গাছ আর সেখানে দেখা যায় না। এ বনের তেলিয়া গর্জন, বাইট্টা গর্জন, ধুলি গর্জন, তেলশুর, হিজল ইত্যাদি গাছ অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। সংরক্ষিত উদ্ভিদগুলোর একটিও সেখানে আছে কি না সন্দেহ। অথচ এসব রক্ষিত বনই হতে পারত সংরক্ষিত উদ্ভিদগুলো একটি বড় রক্ষণকেন্দ্র। উল্টো সেখানে আশ্রয় গেড়েছে বিদেশি আগ্রাসী উদ্ভিদ, যা সেখানে রচনা করেছে একটি গ্রিন আইস। উদ্ভিদ প্রজাতি বৈচিত্র্য যত কমবে, জীববৈচিত্র্যও তত কমবে। চুনতি বনের চারদিকে ৪২টি ইটভাটা, লোকালয়, করাতকল, বন উজাড়, বনভূমি দখল, দূষণ—এগুলোর চাপে বনের নিজস্ব উদ্ভিদগুলোই যেখানে থাকছে না, সেখানে সংরক্ষিত উদ্ভিদের রক্ষণ আশা করা যায় না।

প্রায় ৪০০ হেক্টরের মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানে আছে মাত্র ১০ প্রজাতির বৃক্ষ! একটা বনে উদ্ভিদ প্রজাতির এ রকম দীনদশা কাম্য না। আলোচনার জন্য চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যকে একটি উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছি। বাকি ৫২টি সংরক্ষিত বনের অবস্থাও যে এর চেয়ে ভালো নেই তা হলফ করে বলা যায়। এসব বনের আদি উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোর পুনর্বনায়ন যেমন জরুরি, তেমনি যেসব উদ্ভিদ প্রজাতি বিপন্ন হয়ে পড়েছে বা সংরক্ষিত অবস্থায় সংরক্ষণের দাবি রাখে, সেসব উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোর দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে ইন সিটো ও এক্স সিটো পদ্ধতিতে এসব বনে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার যেহেতু বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতির আকাশমণি ও ইউক্যালিপটাসগাছ লাগানো নিষিদ্ধ করেছে, সেহেতু এসব রক্ষিত বনের সেসব গাছ কেটে সেখানে দ্রুত সংরক্ষিত প্রজাতির উদ্ভিদ লাগানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

আর একটি প্রস্তাব হলো, সংরক্ষিত বন ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানের সুপরিসর প্রাঙ্গণকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেসব রাষ্ট্রীয় সংরক্ষিত এলাকা ও সেনানিবাসগুলোর ভেতরে বিভিন্ন প্রজাতির সংরক্ষিত উদ্ভিদ লাগানো এবং রক্ষণের পরিকল্পনা করা যেতে পারে। এমনকি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, পার্ক ইত্যাদি স্থানে দুই-চারটা হলেও সংরক্ষিত উদ্ভিদ লাগানোর চিন্তা করা যায়। সারা দেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ৭৮টি হর্টিকালচার সেন্টার আছে। সেসব সেন্টারে বিভিন্ন উদ্যানতাত্ত্বিক উদ্ভিদের চারা-কলম উৎপাদন করা হয়। বন বিভাগের নার্সারিগুলোতে উৎপাদন করা হয় বনজ গাছের চারা। এই কেন্দ্রগুলোতে সংরক্ষিত উদ্ভিদের মাতৃবাগান গড়ে তুলে তা থেকে চারা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া যায়। এতে সংরক্ষিত উদ্ভিদগুলো রক্ষণের পাশাপাশি বিস্তারণও ঘটবে।

আনন্দের কথা যে, এ দেশে এখন অনেক মানুষের মধ্যে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভাবনা লক্ষ করা যাচ্ছে। কেউ কেউ ব্যক্তি উদ্যোগে নিজের বাড়ির আঙিনা বা জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়ে বাগান ও উদ্যান করছেন, বাড়িকে বানাচ্ছেন উদ্ভিদ সংগ্রহশালা। সেসব ব্যক্তির মধ্যেও প্রচারণা চালিয়ে দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য, বিপন্ন ও সংরক্ষিত প্রজাতির উদ্ভিদ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। স্থানীয় প্রকৃতিপ্রেমিক তরুণসমাজকে এ উদ্যোগে সম্পৃক্ত করতে পারলে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্ভিদ রক্ষণব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে, যা ভবিষ্যতে উদ্ভিদ প্রজাতি রক্ষার একটি টেকসই ভিত গড়ে দেবে। উদ্যোগ নিতে হবে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানকে, সঙ্গে থাকবে দেশের মানুষ। তাহলেই বাঁচবে সংরক্ষিত উদ্ভিদ প্রজাতিগুলো।

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

সূত্র, আজকের পত্রিকা