শ্রীলঙ্কার বিদ্রোহী নেতা, লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলমের (এলটিটিই) প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণকে তার জীবদ্দশায় অনেকেই ঘৃণা করতেন, কারণ নিজ দল বা গোষ্ঠীর ভিন্নমতাবলম্বীদেরও তিনি সোজা মেরে ফেলতেন এবং গৃহযুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর আত্মঘাতী বোমা হামলার তিনিই প্রবক্তা।

শুধু তিনি কেন, ইতিহাসের সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সাংবাদিক হিসেবে কোনো অনুরাগ বা বিরাগ না থাকাটাই শ্রেয়। তবে আমরা যেহেতু রক্তমাংসের মানুষ, তাই হৃদয়ে আবেগ কাজ করে কখনো কখনো। ২০০৯ সালে এলটিটিই নেতা পরাজিত ও নিহত হওয়ার পর এই লেখক একসময় বিবিসির কলম্বো প্রতিনিধির অনুভূতি জানতে চাইলে ইংরেজ ভদ্রলোক সেই মুহূর্তে নিজের খারাপ লাগার কথা স্বীকার করেন এবং বলেন, প্রভাকরণের পরাজয় ছিল লজ্জাজনক (ইগনোমিনাস ডিফিট)।

ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা কোনো রাষ্ট্রনায়কের পতন হলে বিরুদ্ধবাদীদের কেউ কেউ পর্যন্ত ভেতরে ভেতরে ধাক্কা খায় বলেই বোধ হয় বসনিয়ার সার্ব নেতা যুদ্ধাপরাধী রাদুভান কারাদিচ ধরা পড়লে এবং ইরানের রেজা শাহ পাহলভি বা আফগানিস্তানের আশরাফ গনির পতন হলে অধিকাংশ মানুষের উল্লাস সত্ত্বেও কেউ কেউ ব্যথিত হন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের দিনে তার সমর্থক বাদেও কিছু কৌতূহলী মনের জিজ্ঞাসা ছিল গণভবন ত্যাগের মুহূর্তে তার মনোজগতে কী ঝড় বয়ে গিয়েছিল। দিল্লিতে আশ্রিত হাসিনা দিন কাটাচ্ছেন কোন স্বপ্ন নিয়ে?

এ-জাতীয় ভাবনার অর্থ আবার এই নয় যে, ওইসব শাসক নিজেদের করুণ পরিণতি ডেকে আনার মতো কোনো কর্মই করেননি। তাদের ও অন্য যে কারো ভূমিকা মূল্যায়নের সময় ন্যায়ের চেতনা দিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবে বাস্তবতাকে না দেখলে আমাদের বক্তব্য একপেশেই হওয়ার কথা।

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদার (২০১৭-২০২২) কথাই ধরা যাক। ২২ জুন ঢাকার উত্তরায় তার বাসায় একদল লোক তাকে অপদস্থ করে এবং পুলিশে সোপর্দ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের দমকা হাওয়া বয়ে যায়।

তার্কিকদের একটি অংশ বলেছেন, এটা মবোক্রেসি, আইন হাতে তুলে নেওয়া এবং একজন সম্মানিত নাগরিককে অসম্মান করা। কেউ কেউ যারা দায়ী তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন, তাদের দু-চারজন বলতে চেয়েছেন (সিনেমার মতো), ‘বড় ভালো লোক ছিলেন’ হুদা সাহেব, যিনি সরকারি খরচে হজ করতে রাজি হননি।

পাছে নিজেদের অতীত ভূমিকা সামনে চলে আসে, তাই এই নব্য সমালোচকদের প্রায় কেউই বলেননি গত সাড়ে ১৫ বছর তারা কোন ধাঁচের প্রতিবাদ করেছেন বা আদৌ করেননি।

নুরুল হুদাকে হেনস্তাকারীরা পূর্ববর্তী অন্ধকার যুগে কোন অবস্থায় ছিল, কে জানে!

ধরা পড়া বিচারপতি মানিকের কলার চেপে ধরে বা কোর্টে আসামি সাবেক মন্ত্রী দীপু মনিকে ডিম নিক্ষেপ করে ২০১৩ সালের শাহবাগি মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই বড় বিপ্লবী হওয়া যেতে পারে।

এসব বিদ্বেষী কর্মকাণ্ডকে মব বলে একটা হাই থটের গালি দিয়ে আত্মপ্রসাদের ঢেকুর তুলতে পারেন সুশীল প্রতিবাদকারীরা, কিন্তু মব সৃষ্টির রহস্য তো রয়েই যায়।

হাসিনার ফ্যাসিবাদী আমলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করা কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ (২৯১২-২০১৭), কেএম নুরুল হুদা এবং কাজী হাবিবুল আউয়াল (২০২২-২০২৪) এবং হাসিনার অপকর্মের শরিক ও সমর্থন জোগানো অন্যদের ব্যাপারে এ যাবৎকালে টুঁ শব্দটি করেননি ওই সুশীলেরা।

আহা, কী তাদের ভদ্রতাবোধ! বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার হরণ করার ভারত-হাসিনা যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রধান ভিলেনদের দোষ দিতেই পারছেন না দ্বিচারিতায় ‘কামেল’ এই ভদ্রলোকেরা! তাদের যুক্তি, দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ‘মহান’ ব্যক্তিদের অপমান করলে ভবিষ্যতে এত বড় (!) দায়িত্ব নিতে কেউ এগিয়ে আসবে না।

আওয়ামী দোসরদের হত্যা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের মতো অপকর্মের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ কি তাহলে যথার্থ নয়? বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেড় দশকে, তাতেই আইনের শাসনের প্রতি আস্থা চলে গেছে সাধারণ মানুষের।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি, তিন সাবেক সিইসির বিরুদ্ধে মামলা করার পরই তথাকথিত মব নুরুল হুদাকে ধরিয়ে দেয়; তার আগে সাবেক তিন সিইসি ঢাকা শহরেই ছিলেন, কিন্তু সেরকম কৈফিয়তের মধ্য আনা হয়নি তাদের। সেই অবস্থায় অপরাধীর বিচার নিয়ে কী বার্তা যায় আমজনতার কাছে?

জনগণের সম্মিলিত নিষ্পাপ ক্রোধ প্রশমনে উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, রাজনৈতিক সংগঠন ও সচেতন নাগরিক সমাজের। মৃতপ্রায়, অন্যায্য ও অমানবিক আইনি কাঠামোয় মবের সমাধান হওয়ার নয়।

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব কি হাসিনার শাসনের বৈধতা, তার তৈরি আইন, তার নিযুক্ত ‘চামচা’দের কর্তৃত্ব মেনে সংঘটিত হয়েছে, নাকি ছাত্র-জনতার বিদ্রোহী প্রতিরোধে?

কথায় কথায় আজ যারা ‘মব, মব’ বলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন, তারা কার্যত জুলাই বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহকে ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে চালিয়ে দেওয়ার আওয়ামী বয়ানের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন; বলতে চান, ‘দেশ তো ফ্যাসিবাদী আমলেই ভালো ছিল!’ তাদের গাঁটছড়া বাঁধা সেই অলিগার্কির সঙ্গে যারা এলিটদের আড্ডায় প্রতিবাদ ও দাবি উত্থাপনের অধিকারকে আখ্যায়িত করেন মব বলে; পর্দার অন্তরালের সুবিধা নিতে অভ্যস্ত ‘লোকগুলো’ গণতন্ত্রের প্রকাশ্য পরিসর সংকুচিত করতেই অধিক উৎসাহী এখনো।

এই মব তত্ত্ব অতটা ঠিক হলে ওবায়দুল কাদেরদের ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর পাঁচ লাখ আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী ও সমর্থক গণহত্যার শিকার হতো; এই অগ্রিম অপপ্রচার ১০০ ভাগ মিথ্যা প্রমাণিত হতো না।

যেসব গোষ্ঠী চাঁদাবাজি, দখলদারত্ব, মাস্তানি, সহিংসতা, কিংবা দুর্নীতি বাণিজ্যের মতো অন্যায় ও অবৈধ কার্যকলাপে আওয়ামী ক্যাডারদের প্রতিস্থাপিত করছে, তাদেরও মব আখ্যা দিলেই যেন সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যাবে।

এসব কর্মকাণ্ডে জড়িতরা প্রমাণ করছেন হাসিনার ফ্যাসিবাদী নীতি-কৌশল তাদের বেশ পছন্দ!

যারা সংক্ষুব্ধ মন নিয়ে মব সৃষ্টি করছে, তারা জাতিকে উদ্ধার করার পরিবর্তে সামাজিক, রাজনৈতিক, আইনগত ও নৈতিক সংকট তৈরি এবং নিজেদের দেউলিয়াত্ব জাহির করছে। নতুন বাংলাদেশে এরা নিজেদের দায়িত্ব ও করণীয় খুঁজে পাচ্ছে না হয়তো।

বিপ্লব-পরবর্তীকালে ‘মব জাস্টিস’ (আসলে ন্যায়বিচার পরিপন্থী) বলে নৈরাজ্য সৃষ্টি বা গোষ্ঠী এজেন্ডায় আইন হাতে তুলে নেওয়ার বিষয়টি বিবেকবান ও সচেতন মানুষেরা একটুও সমর্থন করছেন না; কিন্তু এই পরিস্থিতির সুযোগে আপনি অপরাধীকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে চাইবেন, সেটা কেমন কথা?

যেমন কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন সর্বজনাব রকিব, হুদা, আউয়ালদের কী করার ছিল, যখন দেশীয় ‘সিস্টেম’ সুষ্ঠু নির্বাচনের উপযোগী নয়। যেন তারা ও শেখ হাসিনা ‘সিস্টেম’-এর কেউ নন। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসে তারাসহ কিছু সচিব, আইজিপি, ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা, ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসি এবং প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কোনো দায়ই নেই তাহলে!

আসলেই কি সিইসিদের কিছু করার ছিল না?

প্রথমত, তারা দায়িত্ব নেওয়ার আগেই তখনকার প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠ সহচরদের কাছে জানতে চাইতে পারতেন, সরকার কেমন নির্বাচন করতে আগ্রহী এবং তার কাছে তাদের প্রত্যাশা কী? উত্তর সন্তোষজনক না হলে সিইসি পদ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে পারতেন।

দ্বিতীয়ত, নির্বাচন-পূর্ববর্তী পরিস্থিতি অনুকূল না দেখলে পদত্যাগ করতে পারতেন, অথবা হাসিনার লোকদের ভয় পেলে বিদেশে পালিয়ে যেতে পারতেন।

তৃতীয়ত, যখন দেখলেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, তখন সরকারি ফলাফল ঘোষণার আগেই সংবাদ সম্মেলন করে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাইতে এবং সর্বদলীয় পরামর্শ সভা আহ্বান করতে পারতেন।

চতুর্থত, সব চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে এবং কমিশন থেকে পদত্যাগ করে বা বিদায় নেওয়ার পর নিজেদের অপারগতা ও অসহায়ত্ব স্বীকার করে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে পারতেন।

যেহেতু নিজেদের নিরপরাধ রাখার কোনো আইনগত, রাজনৈতিক ও নৈতিক উপায়ই তারা অবলম্বন করেননি, তাই তারা মানুষের ভোটাধিকার নষ্ট করার অপরাধে অপরাধী এবং হাসিনার ক্ষমতা দীর্ঘায়িতকরণের সহযোগী হিসেবে গণ্য হবেন।

ভোটের ইস্যুর বাইরেও বিচার-বহির্ভূত এবং বিচারিক হত্যা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন এবং সব বৈষম্যমূলক নীতি কার্যক্রম নিয়ে যে শ্রেণির সুশীলেরা বিবেকের তাড়নায় প্রতিবাদ বা সমালোচনা করেননি, তারাই এখন নিজেদের মুখরক্ষা ও বিবেকবান হিসেবে নতুন করে উপস্থাপনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ব্যাপারটা দু’ধরনের মানদণ্ড (ডাবল স্ট্যান্ডার্ড) ব্যবহার করা হয়ে গেল না, ভাইসব?

তাদের জন্য যে ‘সিরাতাল মুস্তাকিম’ বা সরল পথ বাতলানো যায়, সেটা তারা অনুসরণ করছেন না।

যারা নিজেদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি মনে করেন, তাদের প্রথম কাজ দেশের বর্তমান অবস্থা নির্মোহভাবে মূল্যায়ন এবং গণমানুষের প্রত্যাশা ও হতাশার প্রকৃত চিত্র মাঠপর্যায় থেকে তুলে আনা। চলমান ইস্যু ও সম্ভাব্য সমাধান জনপরিসরে উপস্থাপন করে এগুলোকে মানুষের স্মৃতিতে জাগিয়ে রাখা তাদের নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতেই প্রয়োজনীয়।

লেখক : সাংবাদিক

সূত্র, আমার দেশ