বিভিন্ন জাতি ও সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, তাদের উত্থানের পেছনে কিছু মৌলিক উপাদান কাজ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি হলো—প্রথমত, তাদের সমাজে একটি দৃঢ় নৈতিক ভিত্তি ছিল, যা ইনসাফ ও মানবিকতাকে অগ্রাধিকার দিত। তারা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত এবং সমাজে ইনসাফের ন্যূনতম একটি কাঠামো নিশ্চিত করত। দ্বিতীয়ত, তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল একটি গোষ্ঠীগত ঐক্য যেটিকে প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ইবনে খালদুন বলেছেন ‘আসাবিয়্যা’। এই জাতিগত সংহতি বা সামাজিক ঐক্য একটি জাতির শক্তিমত্তা ও টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। ইতিহাসে আমরা এই সংহতির প্রমাণ দেখি প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্র স্পার্টা ও এথেন্সে। সেগুলো আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও এর অভ্যন্তরীণ ঐক্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সচেতনতা তাদের প্রভাবকে যুগ যুগ ধরে ছড়িয়ে দিয়েছিল। আধুনিক সভ্যতায়ও গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোর সেই প্রভাব স্পষ্ট।

একই ধরনের দৃঢ় সংহতি আমরা দেখতে পাই মদিনাকেন্দ্রিক ‘উম্মাহর’ মধ্যেও, যা অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানে পুরো দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। যদিও সেখানে ‘আসাবিয়্যার’ চেয়েও বড় ভূমিকা পালন করেছিল ইসলামের ন্যায়বিচার ও মানবকল্যাণের বাণী। তাই বলা যায়, গোষ্ঠীগত ঐক্যের সঙ্গে যদি কোনো জাতি ন্যায্যতা ও ইনসাফ বজায় রাখতে পারে, তবে তাদের শাসন, রাষ্ট্র, সমাজ ও সভ্যতার চিহ্ন দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং সমৃদ্ধির পথে এগোয়।

এখন যদি আমরা ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-কে মূল্যায়ন করি, তবে এটিকে বাংলাদেশের প্রচলিত ‘বিভক্তিপূর্ণ ও আসাবিয়্যাবিহীন’ রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে একটি মোড় পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট হিসেবে দেখা যেতে পারে। ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের রাজনীতি গোষ্ঠীকেন্দ্রিক, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও বিভাজনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সেখানে জুলাইয়ের ঘটনাপ্রবাহ যেন এক নতুন রাজনৈতিক বোধের আভাস দেয়, যেখানে দলীয় স্বার্থ নয়, বরং জাতীয় স্বার্থ, ন্যায়বিচার ও ন্যূনতম ঐক্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। হয়তো আমরা একে ‘জুলাইয়ের রাজনীতি’ নামে অভিহিত করতে পারি, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নৈতিক ও ঐক্যনির্ভর নতুন ধারার সূচনাবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় ‘জুলাইয়ের রাজনীতি’ আমাদের কী শেখায়? জুলাইয়ের রাষ্ট্রের ভিশন কী? আমরা জুলাইয়ের রাজনীতি চর্চা করছি কতখানি? এর উত্তরে আমরা বলতে পারি, জুলাই আমাদের একটি নতুন রাজনৈতিক পাঠ শেখায়। এটি মনে করিয়ে দেয়, বিগত ইতিহাসে বিশেষ করে ১৯৪৭-পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তান পর্বে আমরা ‘বাঙালি’ বনাম পশ্চিম ‘পাকিস্তানি’ দ্বন্দ্বের বিভেদমূলক রাজনীতি চর্চা করেছি। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ‘পাকিস্তানের’ পরাজয়কে ‘ইসলাম’ এর পরাজয় দেখানোর রাজনীতি চর্চা করা হয়েছে।

১৯৭১-পরবর্তী কালে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র একচ্ছত্র ব্যবহার, কিংবা ২০১৩ সালে ‘শাহবাগ বনাম হেফাজত’-এর মুখোমুখি অবস্থান জাতিকে গভীরভাবে বিভক্ত করেছে। এমনকি আমরা আগে বাঙালি নাকি আগে মুসলমান—এটা নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। মুসলমানকে ‘বহিরাগত’ দেখানোর ভান প্রায় ৭৮ বছর আমাদের সমাজ ও রাজনীতিকে বিভক্ত করে রেখেছে। এসবের ভিত্তি গড়ে উঠেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে তথাকথিত বেঙ্গল রেনেসাঁর (পড়ুন হিন্দু রেনেসাঁ) সময়ে।

যেখানে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ‘মুসলমানের অবস্থান বঙ্গ মুলুকে বসবাসকারী চার স্তরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে’ ছিল। অথবা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রগতিশীল সমাজ সংস্কারকদের কাছেও ফুটবল খেলা হয়েছে ‘বাঙ্গালী বনাম মুসলমান’-এর। সেই ধারাবাহিকতাই বহন করেছেন বিংশ শতাব্দীতে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজে নবগঠিত মধ্যবিত্ত সমাজের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিভূরা। আহমদ শরীফ থেকে শুরু করে আনিসুজ্জামান, আহমদ ছফা ও গোলাম মুর্শিদরা সেই ধারাবাহিকতাই বহন করে গেছেন শেষ অবধি।

জুলাই আমাদের সেই বিভক্তির মতাদর্শ ও রাজনীতির বাইরে এসে নতুন করে ভাবতে শেখায়। এটি দেখায়, কীভাবে ‘বাংলাদেশপন্থার আসাবিয়্যা’ অর্থাৎ দেশকেন্দ্রিক গোষ্ঠীগত সংহতি একটি জাতীয় ঐকমত্য গঠনের ভিত্তি হতে পারে। এখানে ব্যক্তি, শ্রেণি, মতাদর্শ, কিংবা রাজনৈতিক দলের সিলেক্টিভ স্বার্থের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যকে সামনে রেখে একটি ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এই ঐক্যই আমাদের দীর্ঘদিন ধরে লালিত একরৈখিক ও এককেন্দ্রিক ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদ’ থেকে মুক্তি দিয়েছে। সুতরাং বলা যায়, রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক মতভেদ থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় অগ্রগতির স্বার্থে একটি বাংলাদেশপন্থি, ন্যায়ভিত্তিক ও সমন্বিত ‘আসাবিয়্যা’র চেতনায় উজ্জীবিত রাজনীতিই আমাদের সামনে এগিয়ে নিতে পারে। এটাই ‘জুলাইয়ের রাজনীতি’, যা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, বরং রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ঐক্যের ওপর দাঁড়িয়ে। হিন্দু-মুসলিম, ডান-বাম—সবাই মিলে বাংলাদেশ।

অন্যদিকে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী পথ পেরিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হলেও রাষ্ট্রের জনগণের বিশ্বাস ও অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যথাযথ কোনো মূলনীতি, পরিচয় ও ভিশন নির্বাচন না করতে পারায় ৫৪ বছর পরে এসেও নতুন করে মত প্রকাশ, দুর্নীতি রোধ, বৈষম্য ও স্বাধিকারের লড়াই করতে হয়েছে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে এসে। ১৯৭৭ ও ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে এই ধারাবাহিকতার কিছুটা পরিবর্তন হলেও ২০০৭ সালের পরে তা আবারও সেই ’৭১-পরবর্তী বাঙালি (মুজিববাদী) বনাম অবাঙালি/মুসলিম (বিএনপি-জামায়াত) বিভেদ ছড়িয়ে দেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করা থেকে শুরু করে সার্বভৌমত্ব পর্যন্ত হুমকির মুখে পড়ছে।

রক্ত ও ঘামের স্রোত আর ১৫ বছরের ত্যাগের ফলে যে অভ্যুত্থান হয়েছে, তা আমাদের নতুন করে সুযোগ করে দিয়েছে রাষ্ট্রের নতুন মানস গঠন করে নয়া ভিশন সৃষ্টি করার। বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ও লেখক নোয়াম চমস্কি তার পাওয়ার অ্যান্ড প্রসপেক্ট বইতে বলেছেন, ‘একটি সমাজ তখনই মহান হয়ে ওঠে, যখন তা তার সময়ের সমস্যাগুলো ছাড়িয়ে আরো ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যৎ কল্পনা করার সাহস দেখায়।’

তাই জুলাই থেকে পাওয়া বাংলাদেশের নয়া ভিশন হবে ঐক্য (আসাবিয়্যা), সাম্য, গণতন্ত্র ও ইনসাফের সমন্বয়ে ফ্যাসিবাদমুক্ত, আধিপত্যবিরোধী, বাংলাদেশপন্থি, অন্তর্ভুক্তিমূলক (সবাই মিলে যেখানে হরিজন থেকে কওমি মাদরাসা) ও মানুষের অধিকারের ভিত্তিতে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণ করা, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো লড়াই করবে নীতি ও অধিকারের জন্য। নেতারা মালিক না হয়ে হবে সেবক। জনগণের সম্পদ ও তাদের পক্ষ থেকে দায়িত্ব ও ক্ষমতা হবে আমানত।

রাষ্ট্র তার পুঁজিবাদী বা এলিটবান্ধব নীতি থেকে সরে এসে হবে জনকল্যাণমূলক। সরকার গড়বে সামাজিক কল্যাণ রাষ্ট্র। কোটা প্রথা কিংবা দলীয় আনুগত্যে নিয়োগ বা পদোন্নতি নয়। ধর্মীয় কোনো চিহ্ন বহন কিংবা আচার পালন করার জন্য কিংবা ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্য আর কেউ নিপীড়নের শিকার হবে না। রাষ্ট্রের অর্থনীতি হবে আধুনিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতার নিরিখে নির্মিত। বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার ভিত্তিতে হবে নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা। রাষ্ট্রের থাকবে স্বাধীন-সার্বভৌম পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তানীতি, যা কোনো বৈদেশিক দেশ কর্তৃক প্রভাবিত হবে না।

এখন প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক দলগুলো কি জুলাইয়ের রাজনীতি করতে পেরেছে? পারলে তা কতটুকু? রাজনৈতিক দলগুলোর প্রজন্মগত ভিন্নতা এবং পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে পুরোপুরি না পারলেও কিছুটা অন্তত পেরেছে। জুলাই অভ্যুত্থান নিজেই ছিল জাতীয় ঐক্যের এক নবজাগরণ। বিএনপি-জামায়াতের মতো বড় দলগুলো ছাত্রদের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে চূড়ান্ত লড়াইয়ে অংশ নেয়। গত এক বছরে নানা বিষয়ে মতবিরোধ ও বাগ্‌যুদ্ধ হলেও ছাত্ররাজনীতিতে কিংবা বিএনপি-জামায়াত অথবা নবগঠিত এনসিপির মধ্যে বড় কোনো সংঘাত হয়নি, যা আমাদের নতুন পথে যাত্রার চেষ্টার ছোট্ট প্রকাশ মাত্র।

গণঅভ্যুত্থানের পরপরই গঠিত হয় বিভিন্ন বিষয়ের সংস্কার কমিশন ও পরবর্তী সময়ে ঐকমত্য কমিশন, যেখানে বিভিন্ন মত ও আদর্শের দলগুলো অংশগ্রহণ করছে, নানা প্রস্তাবনা দিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণে সম্মত হচ্ছে, যা ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। শুধু সরকার গঠনেই নয়, বরং সারা দেশে গঠিত স্থানীয় বিভিন্ন কমিটিগুলোয়ও সাধ্যমতো সব দলের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা প্রমাণ করে একটি অংশগ্রহণমূলক ও সহনশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার কিছুটা হলেও বিকাশ ঘটেছে। এছাড়া অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, অভ্যুত্থান-পরবর্তী ধর্মীয় সহনশীলতা ছিল নজিরবিহীন।

ফ্যাসিবাদী শাসনের সময়ে যারা দখল করে নিয়েছিল মসজিদ-মন্দির, সেসব ধর্মীয় স্থান জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত চাপে পুনরুদ্ধার করা হয় শান্তিপূর্ণভাবে। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো পতিত স্বৈরাচারের ব্যবহৃত ‘হিন্দুদের রক্ষাকর্তা’র পতন হলেও দেশপ্রেমিক ধর্মভীরু জনতার চেষ্টায় লীগ ও ভারতের হাজারো চেষ্টার পরও কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা হিন্দু-মুসলিম সহিংসতার দিকে যায়নি। একজন মুসলমান আইনজীবীকে হত্যার পরও ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশের মুসলমানরা মোটা দাগে ধৈর্য ধরতে পেরেছে, যা প্রশংসার দাবিদার। এছাড়া ব ঈদ, পূজা, ইফতার মাহফিল, বিয়ে, সেমিনারসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সব ধর্ম-বর্ণসহ রাজনৈতিক মতের মানুষেরা একসঙ্গে অংশ নিয়েছে, যা দেশে ১৫ বছর ধরে অবর্তমান থাকা গণতান্ত্রিক সৌন্দর্যকে কিছুটা হলেও ফিরিয়ে এনেছে।

এই ঐক্যের তথা আসাবিয়্যার সংস্কৃতি ও বৈষম্যহীন ন্যায্যতার দাবি ছিল অভ্যুত্থানের প্রকৃত শক্তি এবং পরবর্তী সময়ে তাদের কার্যক্রম প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের জনগণ শুধু রাজনৈতিক মুক্তি নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথেও একত্র হতে পারে। যদি ভবিষ্যৎ সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যের রাজনীতি তথা জুলাইয়ের রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ভিশন সংহত করার লড়াই চালিয়ে যায়, তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে অপার সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

লেখক : যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভার্ন্যান্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশনাল স্টাডিজ (সিজিসিএস)

সূত্র, আমার দেশ