বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। বড় হলে সমস্যাও বেশি, দায়িত্ব অনেক, স্যাক্রিফাইসটাও বেশি।’ ২ জুলাই পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সম্মেলনে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকার আলোচনা করছে। প্রতিটি দলেরই নিজস্ব আদর্শ ও লক্ষ্য রয়েছে। কিছু মিডিয়ায় বিএনপি সংস্কার মানছে না, এমনটা বলা হচ্ছে। কিন্তু সত্যটা হলো, সংস্কার প্রশ্নে বিএনপি অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়েছে।’

ওই দিনই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় একটি তালিকা তুলে ধরেছেন। সেখানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কোন বিষয়ে মোট কতগুলো সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য উপস্থাপন করেছে এবং তার মধ্যে বিএনপি কতটি সুপারিশের বিষয়ে সম্পূর্ণ এবং আংশিক ঐকমত্য পোষণ করেছে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, বিএনপি অধিকাংশ সুপারিশের সঙ্গেই একমত এবং আরও অনেকগুলোর বিষয়ে আংশিকভাবে একমত পোষণ করেছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, এসব ক্ষেত্রে বিএনপিকে তার পূর্ববর্তী দলীয় অবস্থান পরিবর্তনও করতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও ‘কিছু মিডিয়ায় বিএনপি সংস্কার মানছে না, এমনটা বলা হচ্ছ’ কেন? এমনকি বৃহত্তর জনপরিসরেও এমন একটি ধারণা রয়েছে যে তা-ও অস্বীকার করা যায় না। এর কারণ বোঝাও খুব একটা কঠিন কাজ নয়।

যেমন আমরা স্মরণ করতে পারি, জুলাই অভ্যুত্থানে বিজয়ের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে প্রধানত তিনটি কাজ সুসম্পন্ন করার দায়িত্ব নিয়ে। এক. অতীত স্বৈরাচারের বিচার; দুই. রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার এবং তিন. একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পুনরুদ্ধার। এর মধ্যে বিচারের প্রক্রিয়াটি চলমান রয়েছে। তবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এটি সম্পূর্ণরূপেই আদালতের এখতিয়ারভুক্ত। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো সংস্কার। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সেই প্রক্রিয়াও অব্যাহত রেখেছে। তবে এই প্রক্রিয়ার অগ্রগতি নিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচলও রয়েছে। এর কারণ রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক সংস্কার বলতে আমরা যা বুঝি, সেখানে প্রধান বিষয় হলো ’৭২-এর সংবিধানের খোলনলচে বদলে দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষিত নতুন বাংলাদেশ গঠনের উপযোগী একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা। বিএনপি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকৃত অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করলেও এই ক্ষেত্রে দলটির নিজস্ব কিছু নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবস্থান রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি নতুন সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠন (নির্বাচনের মাধ্যমে); ’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতিসমূহ পরিবর্তন; প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা; সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন; জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের পদ্ধতি; জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রভৃতি। এই বিষয়গুলো সংস্কারপ্রক্রিয়ায় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার শুরু থেকেই উপজীব্য ছিল। আলোচনার ধারাবাহিকতায় এক একটি বিষয় একেক সময় প্রাধান্য হারিয়েছে। সেই জায়গায় নতুন চিন্তার স্থান হয়েছে এবং তা নিয়ে আলোচনা এগিয়েছে। আবার দেখা গেছে, সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলাপ-আলোচনায় কিছুদিন পরপর পুরোনো বা প্রাধান্য হারানো এক একটি বিষয়ই নতুন করে উত্থাপিত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, নতুন করে উত্থাপিত এই পুরোনো বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতা শুরু থেকেই ছিল, এখনো আছে এবং এই মতভিন্নতা অবসানের সম্ভাবনা কম বলেই ধারণা করা যায়।

এই রকম পরিস্থিতির মধ্যেই দেশে এখন জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী পালনের নানা আয়োজন চলছে। এই অভ্যুত্থানের অংশীদার রাজনৈতিক দলগুলো, শিক্ষার্থীরা, সুশীল সমাজ সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে নানান কর্মসূচি পালন করছে। এর পাশাপাশি চলছে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক আলোচনাও। তবে এই আলোচনার প্রধান লক্ষ্য অর্জিত না হলে, অর্থাৎ ভবিষ্যতে এ দেশে কোনো সরকার আর কোনো দিন যেন ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের জন্য জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব না হলে জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এবং দায় ও দরদের সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বিষয়গুলো সেই জন্যই ঘুরেফিরে বারবার সামনে আসছে।

এই যেমন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ২ জুলাই সন্ধ্যায় লালমনিরহাট শহরের মিশন মোড়ে আয়োজিত এক পথসভায় বলেন, ‘বিচার, সংস্কার ও নতুন সংবিধান রচনা বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে আমরা সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব না। আর সেই নির্বাচন জনগণের নির্বাচনও হবে না।’ আমরা শুরু থেকে এনসিপির দাবি এবং বক্তব্য অনুসরণ করলে দেখব যে তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে নতুন করে কিছু উত্থাপন করা হয়নি। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার ধারাবাহিকতা অনুসরণ করলে দেখব, এই যে নতুন সংবিধান রচনা এবং এই দাবির মধ্যে নিহিত গণপরিষদ গঠন, সেটি অনেকটাই আড়ালে চলে গিয়েছিল। এখন আবার তা নতুন করে সামনে এল। ঐকমত্য কমিশনের আগামী বৈঠকে হয়তো বিষয়টি নিয়ে নতুন করে কিছু আলোচনার দরকার হবে। তবে এ বিষয়ে বিএনপির নীতিগত অবস্থানের যে ভিন্নতা রয়েছে, তা আমরা সবাই জানি।

ওই দিনই নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ‘একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে মৌলিক সংস্কারের জন্য যে কার্যক্রম চলছে, জুলাই সনদ এ মাসে হওয়ার কথা, সেই সনদ আদায়ের জন্য আমরা রাজপথে নেমেছি। জুলাই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বিজয় হবে, ইনশা আল্লাহ।’ এই জুলাই সনদ প্রণয়নের বিষয়েও বিএনপির সঙ্গে এনসিপি ও জামায়াতসহ অন্য অনেক দলের মতভিন্নতা রয়েছে। বিএনপি তো জুলাই সনদের একটি খসড়াও ঐকমত্য কমিশনের কাছে উপস্থাপন করে রেখেছে। এরই মধ্যে আবার উত্থাপিত হয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রসঙ্গও, যা এর আগেও একাধিকবার আলোচনায় ছিল এবং প্রাধান্য হারিয়েছিল। এই যে রাষ্ট্র সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয় বলে যেগুলোকে বিবেচনা করা যায়, সেগুলোর বিষয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি না হলে তো নির্বাচন আয়োজন করা হবে না কিংবা করা যাবে না। কারণ, এনসিপিসহ অনেক দলই সেটা মানবে না। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্যও তাতে অপূর্ণ থেকে যাবে।

সংস্কারের বিষয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি হলেই আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হতে পারে বলে যে শর্তসাপেক্ষ পরীক্ষায় বিএনপি অবতীর্ণ হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠকে সেই পরীক্ষা থেকে বিএনপির এখন আর বোধ হয় পিছপা হওয়ার সুযোগ নেই। তবে এই পরীক্ষাটি ইতিমধ্যে কিছুটা কঠিন হয়ে গেছে বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত। তা আরও বেশি কঠিন হবে কি না, বিএনপির অবস্থানের ওপরই তা নির্ভর করবে।

সূত্র, আজকের পত্রিকা