জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এ বছর ৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বহুল প্রতীক্ষিত জুলাই প্রোক্লেমেশন (ঘোষণাপত্র) পাঠ করেন। এই ঘোষণাপত্র ঘোষিত হওয়ার পরপরই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অংশগ্রহণকারী সমাজের নানা পেশার নানা শ্রেণির প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান থেকে উত্থিত নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে আলাপ না করেই শুধু রাজনৈতিক দলগুলার সম্মতির ভিত্তিতে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করায় এটা এমনিতেই গণমানুষের সবার প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা হারিয়েছে। এর বাইরেও এই ঘোষণাপত্রে যে জুলাই গণবিপ্লবের জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি, তা নিয়েই কিছু কথা বলব এই লেখায়।
রাষ্ট্রকাঠামোর বৈপ্লবিক ও মৌলিক পরিবর্তনের বদলে দায়সারা গোছের কসমেটিক সংস্কারের কথা বলে জুলাই ঘোষণাপত্র মূলত আনুষ্ঠানিকভাবে ও সরকারিভাবে জুলাই গণবিপ্লবের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার কবর রচনা করেছে। তবে এটি অনিবার্যই ছিল, কারণ ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকেই পুরোনো সিস্টেম অক্ষত রাখার কৌশল হিসেবে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী মাফিয়া ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বদলে সংস্কারের আইডিয়া প্রচার করেছিল দেশের সিভিল সোসাইটি এবং কথিত ইন্টেলেকচুয়ালরা। গণঅভ্যুত্থানের পর বিপ্লব প্রতিরোধের জন্য একটি ক্লাসিক কৌশল হলো সংস্কারের আলোচনা উত্থাপন করা। আরব বসন্তও একইরকমভাবে ফেল করেছিল, যেখানে জুলাই ঘোষণাপত্রে দরকার ছিল অগণতান্ত্রিক কলোনিয়াল মাফিয়া লুটেরা রাষ্ট্রকাঠামো এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎখাতের ঘোষণা দেওয়া। সেখানে সংবিধান এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারের ঘোষণা দিয়ে পুরোনো সিস্টেম ও এস্টাব্লিশমেন্ট অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
একটা নোক্তা দিই আপনাদের—যেখানেই দেখবেন ‘নিয়মতান্ত্রিকতার কথা’ আর ‘ধারাবাহিকতার কথা’ বলা আছে, ‘সংস্কারের কথা’ বলা আছে, বুঝবেন সেখানে পুরোনো সিস্টেম অক্ষত রাখা হবে। এগুলো আমলাতান্ত্রিক ও আইনি মারপ্যাঁচের ভাষা—এই ভাষাগুলো ব্যবহার করা হয় বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে ঠেকানোর জন্য এবং মুক্তিকামী জনতাকে সাময়িকভাবে আশ্বস্ত করার জন্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ’৭২-এর সংবিধানে যেরকম বিদ্যমান ঔপনিবেশিক আইন-কাঠামো বজায় রাখা হয়েছে, ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর যেমন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলা হয়েছে, একইরকমভাবে জুলাই ঘোষণাপত্রে ঔপনিবেশিক মাফিয়া লুটেরা কাঠামোর রক্ষাকবচ ফ্যাসিস্ট সংবিধান বাতিল না করে তাতে ‘নিয়মতান্ত্রিক সংস্কার’ করে তা রক্ষার ধারাবাহিকতার কথাই বলা হয়েছে।
এই ঘোষণাপত্রে বৈষম্য দূর করার ব্যাপারে অঙ্গীকার থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নিওলিবারেল পলিসির আগ্রাসন এবং মাফিয়া বিজনেস অলিগার্কদের ক্রনি ক্যাপিটালিজমের হেজিমনি প্রতিহত করে কীভাবে একটা জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি।
জুলাই প্রোক্লেমেশন প্রণয়নকারীদের আইন বা সংবিধান এবং গণক্ষমতার আন্তঃসম্পর্ক সম্পর্কে যে পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই তাই প্রমাণিত হলো। গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকারের বৈধতার জন্য চলমান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের কাছে যে আশ্রয় নেওয়া হলো এবং তার ফলে যে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কাছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিপ্লবী সম্ভাবনা (রাষ্ট্রকাঠামোর বৈপ্লবিক ও মৌলিক পরিবর্তন) বলি দেওয়া হয়েছে, তা গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটবিরোধী। যেকোনো গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লব নিজেই নিজের বৈধতা।
গণঅভ্যুত্থান নিজেই জনতার সার্বভৌম অভিপ্রায়ের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ বলে তার বৈধতা বিদ্যমান আইন বা সংবিধানের অধীন নয়, বরং গণঅভ্যুত্থান নিজেই নিজেকে বৈধ করে। ফলে জুলাই প্রোক্লেমেশনে যে গণঅভ্যুত্থানের সরকারের বৈধতার জন্য চলমান সংবিধানের কাছে আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, এটা চরম রাজনৈতিক ভুল।
কেননা এই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে বিদ্যমান সংবিধানের ক্ষমতা বলয় এবং ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধেই; ফলে সেই ফ্যাসিস্ট সংবিধানের কাছেই বৈধতা চাওয়া নিজেই গণঅভ্যুত্থান-বিরোধী। এর ফলে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে গণক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে, তাকে নতুন রাষ্ট্র গঠনের কাজে না লাগিয়ে এই গাঠনিক শক্তিকে আবারও পুরোনো সংবিধানের কাঠামোর মাঝে বিলীন করে দেওয়া হয়েছে। কেননা কারণ সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা মানে এই সংবিধান বহাল রাখা, যেটি ‘সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের’ জন্ম দিয়েছে, যেটি ‘নির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো’ বলবৎ করেছে।
আবার সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা মানে একই সঙ্গে বলপ্রয়োগভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো এবং রিপ্রেসিভ আইন, ঔপনিবেশিক আইন সব অব্যাহত থাকা।
ইউনূস সরকারের রাজনৈতিক থিংক ট্যাংকরা যে আধুনিক স্টেট কাঠামোয় ক্ষমতা, ভায়োলেন্স ও আইন বা সংবিধানের আন্তঃসম্পর্ক বুঝতে অক্ষম, তার প্রমাণ হচ্ছে তারা গণঅভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকার এবং সরকারের সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কারের বৈধতার জন্য চলমান সংবিধানের কাছে এবং পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন।
আধুনিক স্টেট কাঠামোতে ক্ষমতাই আইন ও সংবিধানের উৎস এবং আইন মাত্রই বলপ্রয়োগ করে প্রয়োগ করতে হয় বলে আইনের বেসিস হচ্ছে ভায়োলেন্স। লিগ্যাল সিস্টেমের অন্তর্নিহিত ‘ভায়োলেন্স’ প্রয়োগ করাকে রাষ্ট্রের নাগরিকরা লেজিটিমেইট বলে মেনে নেয়, কেননা এতে করে রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা বিধান করবে এবং সমাজে-রাষ্ট্রে একটা শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা হবে। কিন্তু যদি সেই আইন জাস্টিস প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, উল্টো চরম নির্যাতন নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন জনগণ গণ-আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, গণবিপ্লব করে বিদ্যমান কাঠামো উচ্ছেদ করে, যা পুরোনো সংবিধান/আইন অনুযায়ী বেআইনি হলেও জনগণের জাস্টিস প্রতিষ্ঠার যে নৈতিক, মানবিক, আত্মিক ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা তার ভিত্তিতে তা ন্যায়সংগত। অর্থাৎ গণঅভ্যুত্থান বিদ্যমান আইনের বাইরের ব্যাপার এবং গণঅভ্যুত্থান নিজেই নতুন আইন তৈরির বৈধতা দেয়।
পুরোনো সিস্টেমের আইন/সংবিধানের আশ্রয় নিয়ে স্টেট যখন জনতার ওপর ভায়োলেন্স করে, তখন তার বিরুদ্ধে জনগণ গণঅভ্যুত্থান করে পাল্টা বৈপ্লবিক ভায়োলেন্সের মাধ্যমে, যাকে জার্মান দার্শনিক ভাল্টার বেনিয়ামিন বলেছেন, ‘ডিভাইন ভায়োলেন্স।’ আবার কোনো কোনো রাজনৈতিক ফিলোসোফার একে বলেন ইমান্সিপেটরি ভায়োলেন্স। পুরোনো কাঠামোর পক্ষে সম্মতি উৎপাদনকারীরা একে বলে ‘দাঙ্গা’, ‘সন্ত্রাস’, ‘জঙ্গিবাদ’ (যেমন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নির্বিচার গণহত্যা এবং স্টেট ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা আত্মরক্ষার্থে যে রেভোলুশনারি ভায়োলেন্স করেছে, তাকে ফ্যাসিবাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনকারী বুদ্ধিজীবীরা প্রথম থেকেই ‘সন্ত্রাসী কাজ’, ‘ধ্বংসাত্মক কাজ’, ‘জঙ্গিবাদিতা’, ‘দাঙ্গা’ বলে ট্যাগসন্ত্রাস করেছে)।
জনগণ পুরোনো অন্যায্য সিস্টেম/কাঠামোকে উচ্ছেদের জন্য এই যে রেভোলুশনারি ভায়োলেন্স প্রয়োগ করে, তার লক্ষ্য হচ্ছে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও জুলুমের ন্যায়বিচার এবং সেজন্য প্রথম দরকার হচ্ছে পুরোনো জুলুমতন্ত্রের আইন/সংবিধানকে উচ্ছেদ করে নতুন আইন/সংবিধান প্রণয়ন করা। অর্থাৎ গণঅভ্যুত্থানের যে রেভোলুশনারি পটেনশিয়াল তাকে ট্র্যান্সলেট করতে হয় নতুন ক্ষমতা-কাঠামো তৈরি করে, যা নতুন আইনবা সংবিধান প্রণয়ন করবে। অর্থাৎ রেভোলুশনারি ভায়োলেন্সের ট্র্যান্সফরমেটিভ পাওয়ার থাকতে হবে।
এখন জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেন হয়েছে? কারণ বিদ্যমান আইন বা সংবিধান রাজনৈতিক সিস্টেমকে গণনির্যাতন-নিপীড়নের টুল হিসেবে ব্যবহার করেছে ফ্যাসিবাদী রেজিম। ঔপনিবেশিক পুলিশ আইন (১৮৬১, ১৮৯৮), ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রযন্ত্র, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন, র্যাব আইন ২০০৩, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৮, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ২০১৮ থেকে শুরু করে নানা দমনমূলক আইনের ভিত্তিতে জনগণকে গুম-খুন-ক্রসফায়ার করে একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করাতে এবং চলমান সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামো এবং ভাবাদর্শের মাঝে ঔপনিবেশিক-ফ্যাসিস্ট-মাফিয়া সিস্টেমের জুলুমতন্ত্র প্রোথিত থাকায় একটা সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে, যা স্টেট ভায়োলেন্সের ন্যায্যতা দিয়েছে।
এই ফ্যাসিস্ট ভায়োলেন্সের (যাকে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন বলেন মিথিক ভায়োলেন্স) বহিঃপ্রকাশ ছিল নজরদারি, গুম-খুন-ক্রসফায়ার-আয়নাঘর নির্যাতন, কয়েকটা ম্যাসাকার। এই স্টেট ভায়োলেন্সের সবচেয়ে ভয়ানক প্রকাশ ঘটে জুলাই গণহত্যার মাধ্যমে, যার ফলে এদেশের ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থান করে এই রেজিমের পতন ঘটায়। ফলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উত্থিত গণক্ষমতার যে রেভোলুশনারি পটেনশিয়াল, তাকে ট্র্যান্সলেট করতে হতো নতুন সংবিধান/নতুন আইনে।
ঔপনিবেশিক-ফ্যাসিস্ট-মাফিয়া সিস্টেমের জুলুমতন্ত্র যে সংবিধানের ক্ষমতা-কাঠামোতে প্রোথিত, তাকে উচ্ছেদ করাই হচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের প্রথম দাবি এবং আকাঙ্ক্ষা, কেননা এসব অক্ষত রেখে জাস্টিস প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের মতে এই ট্র্যান্সফরমেটিভ রেভোলুশনারি ভায়োলেন্স/গণআন্দোলনের কাজ হচ্ছে পুরোনো অন্যায্য সব আইন, লিগ্যাল ভায়োলেন্স ও স্টেট ভেঙে দেওয়া, আর নতুন ইতিহাস তৈরি করা। অথচ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এই রেভোলুশনারি পটেনশিয়ালকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে পুরোনো সংবিধানের মাঝে, অর্থাৎ পুরোনো সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে তাকে রক্ষার জন্য তার কাছেই শপথ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে। এটা রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিকভাবে একটা চরম অন্যায়।
জুলাই হয়েছে পতিত রেজিমের সাংবিধানিক কাঠামোর লিগ্যাল সিস্টেমকে নাকচ করেই, ফলে জুলাই ঘোষণাপত্র পুরোনো আইন বা পুরোনো সংবিধানের অন্যায্যতা তুলে ধরে তাকে নাকচ করে নতুন গণক্ষমতার ভিত্তিতে নতুন গণতান্ত্রিক আইন বা সংবিধান প্রণয়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশের পুরোনো রাজনীতিবিদরা এবং ইউনূস সরকারের পলিসিমেকাররা এটা বুঝতেই পারছেন না যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে গণক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে, তার ভিত্তিতে ঔপনিবেশিক-ফ্যাসিস্ট-মাফিয়া সিস্টেমের রক্ষাকবচ আইনগুলো বাতিল বা ব্যাপক সংস্কার করে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান বা গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের দিকে যাত্রা করাই ছিল গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রধান রাজনৈতিক কাজ।
জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রধান ঘোষণাই হওয়া দরকার ছিল নির্বাচিত গণপরিষদ- গণভোটের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র বা সংবিধান প্রণয়নের ঘোষণা দেওয়া। অথচ জুলাই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে—‘বর্তমান সংবিধান ও সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে (দফা ২২)।’ ‘সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন... নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধান ও সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় (দফা ২৫)।’
ফলে গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন রাষ্ট্র গড়ার জন্য নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে রাষ্ট্রকাঠামোয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার যে গণদাবি ছিল তাকে দায়সারা সংস্কারের ঘোষণা দিয়ে ঠেকিয়ে দেওয়ার কৌশল নেওয়া হয়েছে। এই ঘোষণাপত্র তাই বেহাত বিপ্লব এবং আপসের ডিক্লারেশন হিসেবেই ইতিহাসে জায়গা পাবে। একটা রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের পরও জনগণের নিজেদের রাষ্ট্র নিজেরাই নতুন করে গড়ার গাঠনিক শক্তিকে কীভাবে সংস্কারের আলাপ এনে ধ্বংস করে দেওয়া যায়, তার একটা দলিল হয়ে থাকবে এই ঘোষণাপত্র।
জুলাই ঘোষণাপত্রে যেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং সংবিধান সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, তার বৈধতাও চাওয়া হয়েছে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সংসদের কাছে। ফলে এই প্রোক্লেমেশনের নিজেরই বৈধতা নির্ভর করছে পরবর্তী সরকারের ওপর। দুনিয়াজুড়েই যেকোনো গণঅভ্যুত্থানের বা গণবিপ্লবের প্রক্লেমেশন নিজেই নিজেকে বলবৎ করে। চলমান সংবিধান বা পরবর্তী সরকারের কাছে বৈধতা খোঁজার মানে হচ্ছে, এই প্রোক্লেমেশন গণঅভ্যুত্থানে উত্থিত গণক্ষমতাকে অস্বীকার করছে।
যারা বোঝেই না যে ঔপনিবেশিক আমলের আইন, আমলাতন্ত্র ও প্রশাসনযন্ত্র উপড়ে না ফেললে দেশের জনগণের জন্য কল্যাণকর কিছু করা যাবে না, যারা বোঝেই না যে বিকেন্দ্রীভূত ক্ষমতায়নকৃত জনগণের অংশগ্রহণমূলক স্থানীয় সরকার ছাড়া গণতন্ত্র পসিবল নয়, যারা বোঝেই না যে নতুন সংবিধান সভা (constituent assembly) ছাড়া সংবিধান পরিবর্তন বা সংশোধন করা ঠিক নয় এবং পার্লামেন্টের হাতে এটা ছেড়ে দেওয়া মানে সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে একটা জগাখিচুড়ি বানানোর ব্যবস্থা চালু রাখা, যারা বোঝেই না যে আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামোয় গণ-সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠাই মূল কথা এবং রাষ্ট্র, প্রশাসন, সরকার ও রাজনৈতিক দলের প্রধান কাজই হবে ব্যক্তির অধিকার, মর্যাদা এবং বিকাশ নিশ্চিত করা, যারা বোঝেই না যে চলমান সংবিধানে যে গণ-সার্বভৌমত্ব বাস্তবায়নের কোনো আইনি-রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কাঠামো নেই এবং এই সংবিধানই যে পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র, নির্বাহী প্রধান-কেন্দ্রিক নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের প্রস্তাবক, তাই এটার সংশোধন নয় বাতিল দরকার, যারা বোঝেই না যে ঔপনিবেশিক জবরদস্তিমূলক আইন এবং সিস্টেম অক্ষত রাখায় এবং সেই ধারাবাহিকতায় নতুন রিপ্রেসিভ মানবাধিকার পরিপন্থি আইন রচনা করায় এগুলো বাতিল না করে বাংলাদেশকে একটা রিপাবলিক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভবই না—এরকম সুশীল ‘বুদ্ধিজীবীদের’ দিয়েই বারবার রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এরা পুরোনো সিস্টেম অক্ষত রেখেই হালকা দায়সারা গোছের কসমেটিক সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েই গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লবের ফসল লুটেরা মাফিয়াদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ’৭২-এ একই কাজ হয়েছে, ফলে ঔপনিবেশিক আইন-কাঠামো অক্ষত রয়ে গেছে। ’৯০-এর নাগরিক অভ্যুত্থানের পরও লিবারেল সিভিল সোসাইটির লোকদের দিয়ে সংস্কারের প্রস্তাব লেখা হয়েছে, যেখানে পুরোনো সিস্টেম একদম অক্ষত রাখা হয়েছে।
ন্যাড়া নাকি একবারই বেলতলায় যায়, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অভ্যুত্থানকারীরা বারবার বেলতলায় গিয়ে একই চিন্তার একই ঘরানার লোকদের হাতেই রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ দিয়ে অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। এবারও বৈপ্লবিক পরিবর্তনে সক্ষম লোকদের বাদ দিয়ে সুশীল লিবারেল ঘরানার লোকদের দিয়েই সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এরাই ’৯০-এর মতো জুলাই বিপ্লবকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। ঔপনিবেশিক আইন, মৌলিক অধিকারবিরোধী আইন, গণবিরোধী আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর আইন কাঠামোর আমূল পরিবর্তন বা বাতিল না করে এবং এদেশের রাজনৈতিক সিস্টেমের মূল ক্রাইসিসগুলো মানে ক্ষমতার মূল চরিত্র চেঞ্জ না করে শুধু ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোয় হালকা চেক অ্যান্ড ব্যাল্যান্স করাকেই এরা ‘মৌলিক সংস্কার’ বলে চালিয়ে দিয়ে জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোয় ক্ষমতার যে বিন্যাস ও বলয় তার মাঝে চারটা পিলার হচ্ছে ঔপনিবেশিক কাঠামো, বাকশালি কাঠামো, মাফিয়া লুটেরা কাঠামো ও বল প্রয়োগের নিরঙ্কুশ কাঠামো—এই চারটা কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গত ১৭ বছরে দিল্লির হেজিমনি ও প্রেসক্রিপশনে নানা নয়া ঔপনিবেশিক পলিসি—এই পাঁচটা পিলার নিয়েই যে ফ্যাসিবাদী সিস্টেম তৈরি হয়েছে, তা উৎখাত করে একটা নয়া রিপাবলিক গড়াই জুলাইয়ের জন-আকাঙ্ক্ষা ও জুলাই বিপ্লবের মূল দাবি।
ক্ষমতার এই পাঁচটা কাঠামো নাট-বল্টুসহ পুরো অক্ষত রেখে স্রেফ ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোয় হালকা চেক অ্যান্ড ব্যাল্যান্স আনার যেই প্রস্তাবগুলো (প্রধানমন্ত্রী ও দলের প্রধান একই পারসন হতে পারবে না, একজন জীবনে ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না, উচ্চকক্ষ প্রবর্তন, ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল না করে হালকা সংস্কার প্রভৃতি) জুলাই সনদে সন্নিবেশিত করা হচ্ছে, তা জুলাইকে ’৯০-এর মতোই একটা ব্যর্থ ইভেন্টে পরিণত করতে যাচ্ছে। রাষ্ট্রনীতি ও রাজনৈতিক ফিলোসফি না বোঝা এবং ক্ষমতার এসেন্স না বোঝা কিছু মিডিয়া সেলিব্রিটি লেখককেই বারবার রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের রক্তাক্ত সব গণ-আন্দোলনকে এভাবেই নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। অথচ দেশের জনগণকে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজে লাগানো হয়নি কখনোই। সুশীল এলিট আর এজেন্সি পলিটিক্স করা কিছু লোকই বারবার এভাবে দেশের জনগণের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে যাচ্ছে।
লেখক : সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক এবং সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়