আবারও সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটল। নৃশংস ও বর্বরোচিত কায়দায় কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হলো সাংবাদিক আসাদুজ্জমান তুহিনকে। গাজীপুরের জনাকীর্ণ চান্দনা চৌরাস্তায় শত শত মানুষের সামনে ঘটেছে এ হত্যাকাণ্ড। কেউ সাংবাদিক তুহিনকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। সবাই খুনিদের হিংস্রতা ও বীভৎসতা দেখেছে—খুনের পর উল্লাস আর নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করেছে নির্বিকারভাবে।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, সাংবাদিক খুনের ঘটনায় জড়িত চারজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পেরেছে। পুলিশের সংগৃহীত সিসিটিভি ফুটেজে যে কয়জন অস্ত্রধারীকে দেখা গেছে, তাদের তিনজনকে আটক করা সম্ভব হয়েছে। গোলাপী নামক যে নারীকে ঘিরে ঘটনার সূত্রপাত তাকেও আটক করতে পেরেছে। শুক্রবার রাতে অভিযান চালিয়ে তিনটি পৃথক স্থান থেকে চাপাতি হাতে দেখা যাওয়া মো. মিজান ওরফে কেটু মিজান, স্বাধীন ও আল-আমিনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। কেটু মিজানের স্ত্রী গোলাপীকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চলছে। তুহিন হত্যাকাণ্ডের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই চিহ্নিত খুনিদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হওয়ায় পুলিশকে সাধুবাদ জানাতে হয়। এখন সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে হত্যার কারণ উদ্‌ঘাটন ও খুনিদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করাই তুহিন পরিবার, সাংবাদিক সমাজসহ সবার প্রত্যাশা।

নিকট অতীতে গাজীপুরে খুন হওয়া সাংবাদিকের তালিকায় তুহিন চতুর্থ। ২০২৩ সালের আগস্টে হত্যার শিকার হন দৈনিক ভোরের দর্পণ ও করতোয়ার সাংবাদিক শেখ মঞ্জুর হোসেন মিলন। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর গাজীপুরের হাজিরবাগে সাংবাদিক আবু বকর সিদ্দিক বাবু খুন হন দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে। তার আগে ২০০৯ সালের ২৬ আগস্ট এমএম আহসান হাবীব বারী নামে আরেক সাংবাদিক খুন হন গাজীপুরে। একটি খুনেরও কূলকিনারা হয়নি। শুধু গাজীপুরের কেন, পতিত শেখ হাসিনার সরকারের ১৫ বছরে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের মচ্ছবের মধ্যে দেশে ৬১ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। এর মধ্যে সাগর-রুনী দম্পতি সবচেয়ে আলোচিত। তথ্য পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০০৯ ও ২০১৫ সালে পাঁচজন করে ২০১০, ২০১২, ২০১৪ ও ২০২০ সালে তিনজন করে, ২০১১ ও ২০২৩ সালে ছয়জন করে, ২০১৩, ২০১৫, ২০১৯ ও ২০২২ সালে চারজন করে, ২০১৮ সালে পাঁচজন, ২০১৭ সালে দুজন, ২০২১ সালে একজন এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে আটজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। চব্বিশ সালের আটজনের মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় শহীদ ছয়জন সাংবাদিক রয়েছেন।

গাজীপুরের নাজুক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামনে এসেছে সাংবাদিক তুহিন হত্যার মধ্য দিয়ে। রাজধানীর সন্নিকটে গাজীপুর পতিত আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এখানে স্থায়ী বাসিন্দার চেয়ে ভাসমান জনসংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। সময়ে সময়ে অবস্থান পরিবর্তন ও আবাস বদলের কারণে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জও ভিন্নমাত্রিক। জনসংখ্যার তুলনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জনবল ও যানবাহন স্বল্পতায় অপরাধীদের পোয়াবারো। গাজীপুরে ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ব্যাপকতা এর আগেও ছিল। কিন্তু এখন বিগত সরকারের অনুগত পুলিশ সদস্যদের নির্লিপ্ততা এবং ক্ষেত্রবিশেষে পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিদেশে পলাতক আওয়ামী নেতাদের খরচাদি জোগান দিতে গাজীপুরসহ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় পেশাদার-অপেশাদার চাঁদাবাজ-ছিনতাইকারীদের নিয়োজিত করা হয়েছে—এমন কথাও চাউর আছে। গত সাত মাসে গাজীপুরে ১০৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে। রাজনীতি, মাদক, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, পূর্বশত্রুতা, জমিজমা ও পারিবারিক বিরোধে এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে।

সাংবাদিক তুহিনের বাবা-বা ও স্ত্রী-পুত্রের আহাজারি ও কান্নার রোল আমাদের হৃদয়কে বিদীর্ণ করছে। তুহিনের বিধবা স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানের সামনে ঘোর অমানিশা। তুহিন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের হাসান জামাল ও সাহাবিয়া খাতুন দম্পতির সন্তান। সাত ভাইবোনের মধ্যে আসাদুজ্জামান সবার ছোট ছিলেন। তিনি দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সাংবাদিকতা তার আয়ের উৎস ছিল না। হয়তো শখের বসে এ পেশায় যুক্ত হয়েছিলেন। হালে সাংবাদিক পরিচয়ে মাঠপর্যায়ে চাঁদাবাজি, ধান্ধাবাজি, ব্ল্যাকমেইল ও মানুষকে হয়রানির যে চেনা চিত্র দেখা যায়, তা থেকে তুহিন আলাদা ছিলেন বলেই জানাচ্ছেন গাজীপুরের সাংবাদিক বন্ধুরা। জীবিকা নির্বাহের জন্য তুহিন একটি কোম্পানির ওষুধ সরবরাহের কাজ করতেন। একটি ক্লিনিক ব্যবসায়ও জড়িত ছিলেন। সাংবাদিকতা ও ব্যবসা-সূত্রে গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় বসবাস শুরু করেন। স্ত্রী মুক্তা বেগম ও দুই ছেলেসন্তানকে নিয়ে থাকতেন।

তুহিনের বাবা হাসান জামালের প্রশ্ন—‘আমার ছেলেডারে কেন এভাবে মারল, কী অপরাধ আছিল আমার ছেলের? আমি তো কোনোদিন কারো ক্ষতি করি নাই, আমার ছেলেও তো মানুষের ক্ষতি করত না। যে ছেলে দুই দিন আগে আমার ওষুধ কেনার টাকা পাঠাইল, সেই ছেলেই আজ হত্যার শিকার হইল। ওরা কেন এভাবে মারল ছেলেডারে?’ এ প্রশ্নগুচ্ছের জবাব নেই কারো কাছে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই।

ওপরে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা শুধুই যেন পরিসংখ্যান। শেখ হাসিনার তিন মেয়াদে প্রতি মাসে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন সাংবাদিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ডিজিটাল আইনে গ্রেপ্তার, ডজন ডজন মামলার খড়্‌গ, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হেলমেট বাহিনীর বেধড়ক পিটুনি এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে সাংবাদিক নির্যাতন নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিচারহীনতা সাংবাদিক হত্যা-নিপীড়নকে এক ধরনের স্বাভাবিকতা দিয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম রাহুমুক্ত হয়েছে। এখন স্বাধীন সাংবাদিকতার চর্চা হচ্ছে, যা খুশি তা লেখা যাচ্ছে। টকশোতে হাত-পা ছুড়ে সরকারের গুষ্টি উদ্ধার করা যাচ্ছে। প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপে এখন আর সংবাদ ব্ল্যাকআউট করতে হয় না। কোন অনুষ্ঠান লাইভ হবে আর কোনটা করা যাবে না, তা প্রেস উইং থেকে ডিক্টেট করে না। টকশোতে অতিথি তালিকা সরকারপ্রধানের কার্যালয় কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার খুদেবার্তায় নির্ধারিত হচ্ছে না। সরকারের বিরুদ্ধে রিপোর্ট কিংবা নিবন্ধ লেখার জন্য সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করার আল্টিমেটামও এখন আর আসে না।

সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে উপদেষ্টা ও কর্তাব্যক্তিদের সমালোচনা করে প্রতিনিয়ত কলাম প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকি সেনাপ্রধানের সমালোচনা করেও প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। সে কারণে কাউকে আয়নাঘরের কাছাকাছি ‘চা খাওয়ার’ দাওয়াতে যেতে হয়নি। সংবেদনশীল প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার নাম উল্লেখ করে সমালোচনামূলক রিপোর্ট হচ্ছে, নিবন্ধ লেখা হচ্ছে, যা চব্বিশের ৫ আগস্টের আগে ছিল কল্পনাতীত। সরকারের উপদেষ্টা ও তার বাবাকে নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশনে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা হয়েছে। উপদেষ্টার পিএস ও এপিএসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ-সংবলিত সংবাদ প্রকাশের কারণে কারো বিরুদ্ধে সিরিজ মামলা বা হুলিয়া জারি হয়নি। বরং তাৎক্ষণিকভাবে দুদক তদন্ত শুরু করেছে। তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এসবই নতুন বাংলাদেশের অর্জন।

তবে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানোত্তর বাংলাদেশে সাংবাদিকতা ও সংবাদকর্মীদের মধ্যে নতুন কিছু সিমটম দেখা যাচ্ছে। ভয়হীন সাংবাদিকতার সুযোগে লাগামহীন সাংবাদিকতা মাথাচাড়া দিচ্ছে। দায়িত্ব ও কাণ্ডজ্ঞানহীন সাংবাদিকতার বিস্তার দিব্যি চোখে পড়ছে। নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ভিউ-বাণিজ্যের মোহে যাচাই না করে প্রচার ও প্রকাশ করা হচ্ছে মুখরোচক সংবাদ, যার সর্বশেষ উদাহরণ কক্সবাজারে এনসিপি নেতাদের ব্যক্তিগত সফর। চরিত্র হনন করা হচ্ছে রাজনীতিক থেকে শুরু করে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের। বর্তমান ও অনাগত ক্ষমতাবানদের নেকনজরে থাকতে এবং তাদের তুষ্ট করতে সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোয় মালিকেরা নতুন মুখ বসাচ্ছেন। অতীতের পাপ-গ্লানি আড়াল করতে অতিউৎসাহী হয়ে চাটুকারিতার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। স্তুতি সাংবাদিকতার নতুন রূপ দেখতে হচ্ছে। পেশাদারত্ব ও সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। সম্পাদক পরিষদ, নোয়াব, সাংবাদিক ইউনিয়ন ও সাংবাদিকদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ মতলববাজি এবং এজেন্ডার বাইরে যেতে পারছে না।

সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াব একটি ঝাঁজালো বিবৃতি দিয়েছে। তারা যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছে, তা ঢালাও। সরকার বিবৃতির অভিযোগগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রেস সচিব তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে অভিযোগ খণ্ডন করেছেন। নোয়াবের বিবৃতির উপলক্ষ মনে হয়েছে দৈনিক জনকণ্ঠের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। জনকণ্ঠ কবে সাংবাদিকতা করেছে, তা গবেষণার বিষয়। গণঅভ্যুত্থান-উত্তর জনকণ্ঠ যেভাবে চলছে, তা বিশ্লেষণ এ স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব নয়। সর্বশেষ আগস্টের গোড়ায় গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ও মূলমন্ত্রকে উপেক্ষা করে কর্তৃপক্ষ সীমানার বাইরে পলাতকদের উসকানিতে পা দিয়েছে। তারা ২০ জন সাংবাদিককে কর্মচ্যুত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ১২ জনকে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে অফিসে আসতে বারণ করেছেন। বেতন বকেয়া আট-দশ কোটি টাকা। এসব কারণে সেখানে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত একটি সমঝোতা হয়েছে বলে জানা গেছে।

জনকণ্ঠে বিরাজমান মূল সমস্যা-সংকট আড়াল করে নোয়াব ‘শিবের গীত’ গেয়েছে, যা অগ্রহণযোগ্য। ‘মব’ আবিষ্কার করে সরকার ও বর্তমান শাসনকে এক হাত নিয়েছে মালিকদের একাংশের সংগঠনটি। এই নোয়াবই কিন্তু দৈনিক সংগ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ সম্পাদককে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে পত্রিকা অফিসটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার সময় গভীর গুমে অচেতন ছিল। দৈনিক আমার দেশ অফিস আগুনে ভস্মীভূত করা, সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কোর্ট প্রাঙ্গণে রক্তাক্ত করে হত্যার চেষ্টা, নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আগুন দেওয়ার সময়ও ‘মব’ দেখেনি। ‘মব’ এক আজব আবিষ্কার! ১৫ বছরের অপশাসনে ‘মব’ কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী—এদেশের মানুষ দেখেছে। কথায় কথায় পেশিশক্তির উন্মত্ততা যখন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, তখন নোয়াবের মুখ ফোটেনি। কারণ নোয়াব-নেতা তো প্রথমেও ‘তাঁহাকে’ চেয়েছিলেন, শেষেও চেয়েছিলেন ‘তাঁহাকেই’। দিল্লিনিবাসী সেই ‘তাঁহার’ জন্য এই ব্যাকুলতা কিনা কে জানে!

আরেকটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিক নির্যাতনের ভুয়া পরিসংখ্যান প্রকাশ-প্রচার। নতুন করে গজিয়ে ওঠা কিছু মানবাধিকার সংগঠন মাসিক রিপোর্টে ভিত্তিহীন পরিসংখ্যান দিচ্ছে। সেগুলো আবার টিআইবির মতো প্রতিষ্ঠানও ব্যবহার করছে। টিআইবির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত এক বছরে ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন, ২৬৬ জনকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। ২৬৬ জনকে হত্যা মামলার আসামি করার পরিসংখ্যানটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ ধরনের অভিযোগ ওঠার পর তৎকালীন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ করার জন্য আট সদস্যের একটি কমিটি করে দেন। কমিটির আমিও একজন সদস্য।

সেই কমিটি তিন দফায় মামলায় অভিযুক্ত সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তথ্য আহ্বান করে, কোন কোন মামলা হয়রানিমূলক তা জানতে চায়। মামলার মেরিট বিশ্লেষণ করে হয়রানিমূলক মামলা থেকে সাংবাদিকদের অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করাই ছিল এ উদ্যোগের লক্ষ্য। কমিটির আহ্বানে ৭৫ জন সাংবাদিক দাবি করেন, তাদের বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থানের পর হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি সিআর (নালিশি) মামলা, যেগুলোর ব্যাপারে সরকারের তেমন কিছু করার নেই। আর জিআর মামলা, যা পুলিশের মাধ্যমে রেকর্ড হয়েছে, তার সংখ্যা ৫৯টি। দেশের ১৯টি জেলার বিভিন্ন থানায় এ জিআর মামলাগুলো রেকর্ড হয়েছে। ৫৯টি মামলার মধ্যে চারটিতে শেখ হাসিনাও আসামি হিসেবে রয়েছেন। সাংবাদিক রয়েছেন চারজন। মামলার নথি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ঢাকায় ১৪ জন, বগুড়ায় ৯ জন, নারায়ণগঞ্জে পাঁচজন, কুষ্টিয়ায় চারজন, খাগড়াছড়িতে তিনজন, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুড়িগ্রাম ও মাগুরায় দুজন করে এবং সুনামগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বরগুনা, কক্সবাজার, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, ফেনী ও নীলফামারিতে একজন করে সাংবাদিক মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন। সব বাদীই ব্যক্তি, সরকার নয়।

লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, ঢাকার বাইরের অধিকাংশ এবং ঢাকার কোনো কোনো মামলা পারস্পরিক ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। ঢাকার বাইরের যারা সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে পর্যালোচনা কমিটির কাছে হয়রানিমূলক দাবি করে আবেদন করেছেন, তাদের বেশির ভাগই কোনো উল্লেখযোগ্য সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত নন। তাছাড়া আওয়ামী লীগ বা অঙ্গসংগঠনের কোনো না কোনো পদে থেকে গত ১৫ বছরে তাদের অনেকেই নিপীড়নমূলক আচরণ করেছেন। চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দখল করেছেন। এসব অপরাধের প্রোটেকশন হিসেবে কোনো ভুঁইফোঁড় মিডিয়া থেকে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে সাংবাদিক পরিচয় দিতেন। গণঅভ্যুত্থানের পর ভুক্তভোগীরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। কাউকে কাউকে জুলাই আন্দোলনে হত্যা মামলায় নাম দিয়েছেন। বেশির ভাগই চাঁদাবাজি বা দখলদারির মামলা। ব্যতিক্রমও আছে। হাতেগোনা কয়েকটি। এদের সবাইকে একাকার করে টিআইবি বা অন্যান্য সংস্থা বলছে, এক বছরে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ২৬৬টি হত্যা মামলা হয়েছে। এটা স্রেফ অসততা।

ঢাকায় একটি বেসরকারি টিভি স্টেশনের অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয় অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে। সেই কর্মী ওই টিভি স্টেশনের মালিকসহ চারজনের নাম যাত্রাবাড়ীর একটি হত্যা মামলায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। এরই মধ্যে তাদের মধ্যে মীমাংসা হয়ে গেছে। এই চারজনকেও সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে টিআইবি বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সাংবাদিক নিপীড়ন হিসেবে তুলে ধরছে। তথ্য-পরিসংখ্যানে যদি ভেজাল থাকে, তাহলে প্রতিবাদ ও দাবি দুর্বল হতে বাধ্য। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার আরো সচেতন হওয়া জরুরি।

বাংলাদেশে সাংবাদিকতা কখনো পুরোপুরি নিরাপদ ছিল না। যে সাংবাদিকেরা মাঠে কাজ করেন, তাদের জীবন অপরাধী চক্রের হাতে বিপন্ন হতে দেখা গেছে সব সময়ই। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো সাংবাদিক তুহিন হত্যার সময় শত শত মানুষ উপস্থিত থাকলেও ছিল নীরব দর্শক। মানুষের এই নীরবতা শুধু ভয়ের নয়, বরং অপরাধীদের জন্য এক অঘোষিত প্রশ্রয়ের পরিবেশ তৈরি করে দেয়। মানুষ কেন নীরব থাকে তা সাংবাদিকদের বিশ্লেষণ করতে হবে গভীরভাবে। সাংবাদিকদের মানুষ সমীহ করে। শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে এ সমীহ, নাকি অনিষ্টের ভয়ে, তা ভেবে দেখতে হবে। সারা দেশে সাংবাদিক পরিচয়ধারী একশ্রেণির অপরাধীদের দৌরাত্ম্য দিন দিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকেরাও মানুষের শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি হারাচ্ছেন। এর প্রতিকার কোন পথে, তা ভেবে দেখার এখনই সময়।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সূত্র, আমার দেশ