মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর রীতিমত দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসাবেই নিজেকে জাহির করতে শুরু করেছেন। নতুন মার্কিন প্রশাসন হাজার হাজার ফেডারেল কর্মীকে গণহারে ছাঁটাই করা থেকে শুরু করে সরকারি নথিপত্রে ‘লিঙ্গ’, ‘ঝুঁকিতে’ ও ‘মেক্সিকো উপসাগর’-এর মতো শব্দ নিষিদ্ধ করাসহ একের পর এক ক্ষোভ সৃষ্টিকারী এবং অযৌক্তিক নীতির স্রোত বইয়ে দিয়ে চলেছেন।

ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ‘দ্য অফিস অব পার্সোনেল ম্যানেজমেন্ট’ মার্কিন ফেডারেল সংস্থাগুলো থেকে হাজার হাজার প্রবেশনারি কর্মীকে চাকরিচ্যুত করার নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের প্রথম দিনই তিনি জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিয়ে এক নির্বাহী আদেশ জারি করেন। গত জানুয়ারিতে ‘অফিস অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বাজেট’ বিষয়ক একটি চিঠিতে বিশ্বজুড়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় সরকারের সব অনুদান ও ঋণ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব নেয়ার অল্পক্ষণ পরেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সব মানবিক ও উন্নয়ন কাজে তহবিলের জোগান দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তার এসব সিদ্ধান্ত মোটেই নির্বিঘ্ন হয়নি বরং মার্কিন আদালতের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে নিজ দলের মধ্যেও।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখানেই থেমে যাননি বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ব্যাপক শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। যা বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধকে রীতিমত উস্কে দিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। মূলত, প্রায় সব দেশের ওপর আরোপ করা এমন শুল্ক বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এমন ঘোষণাকে অনেকে ট্রেড ওয়ার বা শুল্ক যুদ্ধের সূচনা হিসেবে দেখছেন। অবশ্য ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছেন, আরোপিত শুল্ক মার্কিন শিল্পকে রক্ষা করবে এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে দেশীয় কর্মসংস্থান বাড়াবে। শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতা দ্রুত বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, আমদানি পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। ফলে ভোক্তাদের জীবনযাত্রার খরচের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। একই সাথে কানাডা ও মেক্সিকোর মতো প্রতিবেশী দেশগুলো; বিশেষ করে যারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল-তাদের রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হতে পারে। চীনের ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। চীন ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, তারাও মার্কিন কৃষিপণ্য ও শক্তি খাতের ওপর প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করবে। ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স ও অটোমোবাইল শিল্প, ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। কানাডা আরোপিত শুল্ককে ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, ‘আমরা ১০৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করবো’। মেক্সিকোও একই পথে হাঁটছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও একেবারে ছেড়ে কথা বলছে না। ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজেদের ফাঁদে আটকা পড়ছেন কি না তা নিয়েও রীতিমত প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র চীন ছাড়া সকল দেশের ওপর আরোপিত শুল্ক ৩ মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।

ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেইন মার্কিন শুল্ককে ‘বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় আঘাত’ বলে মন্তব্য করেছেন। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে দিয়েছেন, এটি ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার সময়কার সংরক্ষণবাদী নীতির পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। বৈশ্বিক শিল্প যেমন ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম এবং কৃষি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো ইতিমধ্যে এ সংস্থায় মার্কিন শুল্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে শুল্ক ঘোষণার পর বিশ্বব্যাপী শেয়ার বাজারেও তীব্র পতন দেখা দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে ডাও জোন্স সূচক ৫শ পয়েন্ট কমেছে। সে সাথে টরন্টো ও মেক্সিকো সিটির বাজারও ধস নেমেছে। কানাডিয়ান ডলার এবং মেক্সিকান পেসোর মান কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। একই সাথে দীর্ঘমেয়াদে এ শুল্ক যুদ্ধ বৈশ্বিক মুক্ত বাণিজ্যের পরিবর্তে সংরক্ষণবাদী নীতির দিকে ঝুঁকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমলেও অন্য দেশগুলো বিকল্প বাজারের দিকে ঝুঁকলে, বৈশ্বিক মার্কিন প্রভাব কমে যেতে পারে।

এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ ধরনের শুল্ক আরোপকে কেউই যৌক্তিক ও কাক্সিক্ষত মনে করছেন না বরং তিনি তা করতে গিয়ে নিজের সঙ্গেই সবচেয়ে বড় জুয়া খেলছেন বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল। মূলত, ট্রাম্প কয়েক দশক ধরে এ নীতিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি মনে করেন মার্কিন অর্থনীতিকে যদি চাঙ্গা করতে হয় তাহলে তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো শুল্ক। এর মধ্যদিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছেন। তার ভাষায়, এতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, তিনি এক্ষেত্রে নিজের বিরুদ্ধে নিজেই জুয়া খেলায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি নিজের প্রেসিডেন্সিকে বাজি ধরেছেন।

হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে বন্ধু, কনজারভেটিভ রাজনীতিক ও মন্ত্রীদের পরিবেষ্টিত অনুষ্ঠানে ট্রাম্প শুল্ক আরোপের ঘোষণার দিনকে বর্ণনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের দেয়া বক্তৃতার অর্ধেক ছিল উদযাপন, বাকি অর্ধেক ছিল আত্মপ্রশংসা। ট্রাম্প তার বক্তৃতায় শুল্ক নিয়ে নিজের দীর্ঘদিনের বিশ্বাসের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি নাফটার মতো মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা নিয়ে নিজের শুরুর দিকের সমালোচনার কথা স্মরণ করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মানেন যে, নতুন শুল্ক ঘোষণার কারণে আগামী দিনে তাকে ‘বিশ্ববাদী’ আর ‘বিশেষ স্বার্থবাদীদের’ চাপের মুখে পড়তে হবে। তবে তিনি নিজের বিশ্বাসের ওপর আমেরিকানদের ভরসা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তার কথায়, ভুলে গেলে চলবে না, গত ৩০ বছর ধরে বাণিজ্য নিয়ে আমাদের বিরোধীরা যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, তার প্রত্যেকটিই সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

ট্রাম্প বলেন, কঠোর পরিশ্রমী মার্কিনীরা বছরের পর বছর ধরে দর্শকসারিতে বসে থাকতে বাধ্য হয়েছে; কারণ অন্যান্য দেশ ধনী ও শক্তিশালী হয়েছে, যার বেশির ভাগ খরচ গুনতে হয়েছে আমাদের। আজকের পদক্ষেপের মাধ্যমে অবশেষে আমরা আমেরিকাকে আবার মহান করে তুলতে চলেছি; অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে মহান। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য এখনো বড় ধরনের ঝুঁকি অপেক্ষা করছে। সব দেশের অর্থনীতিবিদরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, চীনের ওপর ৫৩ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর ২০ শতাংশ এবং সব দেশের ওপর অন্তত ১০ শতাংশের যে শুল্ক ঘোষণা করা হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত আমেরিকান ভোক্তাদেরই ভোগাবে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে, সে সাথে বৈশ্বিক মন্দারও ঝুঁকি তৈরি করবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কেন রগফ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, নতুন শুল্ক ঘোষণার পর বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মন্দায় পড়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। তিনি (ট্রাম্প) বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় একটি পারমাণবিক বোমা ছুড়েছেন।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানির ওপর এ স্তরের কর আরোপের সিদ্ধান্ত হবে রীতিমত বিস্ময়কর। ট্রাম্পের পদক্ষেপে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ বৃদ্ধির যেমন আশঙ্কা রয়েছে, তেমনই যেসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টায় রয়েছে আমেরিকা-এমন মিত্রদেরও হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। যেমন চীনের উচ্চাকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে রক্ষাকবচ হিসেবে দেখে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সম্প্রতি ওই তিন দেশ ঘোষণা দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির জবাব দিতে তারা একসঙ্গে কাজ করবে। বিবিসি লিখেছে, ট্রাম্প যদি সফল হন, তবে তিনি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলবেন, যা গড়ে তুলতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকার ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, নতুন নীতি আমেরিকান উৎপাদন ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করবে, রাজস্বের নতুন উৎস তৈরি করবে এবং আমেরিকাকে আরও স্বাবলম্বী করবে। কোভিড মহামারিতে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে যে ধরনের সংকটে পড়তে হয়েছে, তেমন পরিস্থিতি থেকেও রক্ষা করবে। বিবিসি লিখেছে, ট্রাম্পের দীর্ঘ পরিকল্পনা অনেকের কাছে ‘অত্যন্ত অবাস্তব’ ঠেকতে পারে। কিন্তু যুদ্ধের অবসান, ভৌগোলিক অবস্থানের নতুন নামকরণ, নতুন অঞ্চল অধিগ্রহণ বা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প বিলোপ ও জনবল কমানোর মাধ্যমে যে প্রেসিডেন্ট তার উত্তরাধিকারকে শক্তিশালী করতে চান, তার জন্য এটাই হতে পারে সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ফলপ্রসূ পুরস্কার।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্প আরোপ বিষয়ক ভাষণ ছিল বিজয়োল্লাসে পূর্ণ। তার এ পদক্ষেপের ফলে আমেরিকান অর্থনীতি এবং রাজনৈতিকভাবে তাকে যে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে, সে সম্ভাবনার কথা ভাষণে ছিল অনুপস্থিত। অবশ্য তিনি বলেছেন, যা তিনি করতে চান, সেজন্য এটুকু ঝুঁকি নেয়াই যায়। আর তাতেই বক্তব্যের একেবারে শেষে, তার সাহসী চেহারার মাঝে ছোট্ট একটি সন্দেহের ছায়া যেন উঁকি দিচ্ছিল। ট্রাম্প বলেন, এটা হতে চলেছে এমন এক দিন, যেদিনের কথা আপনারা ভবিষ্যতে স্মরণ করবেন। তখন আপনারা বলবেন, ‘তিনি ঠিকই করেছিলেন’।

সার্বিক দিকে বিবেচনায় মনে হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধকে আরও তীব্র করে তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। অন্যান্য দেশ মার্কিন পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কের বিপরীতে রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ বা পারস্পরিক শুল্কের একটি ধারা চালু করেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা সকল পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ বেসলাইন ট্যারিফ এবং দেশটির বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর উচ্চতর শুল্ক আরোপ করার কথা জানিয়েছেন ট্রাম্প। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে শুল্ক বিভিন্ন করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে শতকরা ৩৭ ভাগ। এর মধ্যদিয়ে ট্রাম্প ইচ্ছে পূরণের সবচেয়ে বড় জুয়া খেলছেন। অনলাইন বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক দশক ধরে রাজনীতির ধরন পাল্টে দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে শুল্ককে বানিয়েছেন হাতিয়ার। এখন তিনি সে টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে নিজের প্রেসিডেন্সিকে বাজি রেখেছেন।

তার এ কর্মকাণ্ডে বিশ্বনেতাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ বলছেন, এর ফলে ইউরোপের সঙ্গে ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুল্ক আরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ বলে উল্লেখ করেছেন। লক্ষ্য করার বিষয় হলো তিনি চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। তবে এ থেকে রেহাই পেয়েছে রাশিয়া। এ ছাড়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং জাপানের ওপর যথাক্রমে ২০ এবং ২৪ শতাংশ শুল্ক দেয়া হয়েছে। আর ভারতকে আমদানি শুল্ক দিতে হবে ২৬ শতাংশ। এদিকে ট্রাম্পের এ শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ। অস্ট্রেলিয়ার গরুর মাংসের ওপর ট্রাম্পের কঠোর বাধা-নিষেধের সমালোচনা করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ। মার্কিন প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপকে অন্যায় উল্লেখ করে আলবানিজ বলেছেন, এ অন্যায় পদক্ষেপের জন্য আমেরিকান জনগণকে আরও চড়া মূল্য দিতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, ট্রাম্পের অযৌক্তিক শুল্কের জন্য সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হবে আমেরিকার জনগণকে। এ কারণেই আমাদের সরকার রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ আরোপ করবে না। আমরা এমন কোনো প্রতিযোগিতায় যোগ দেবো না যা উচ্চমূল্য এবং ধীর প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত করবে।

ট্রাম্পের এ শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি। বলেছেন, বিশ্ববাণিজ্য এ ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটাবে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারদের তুলনায় কানাডার জন্য ট্রাম্পের শুল্ক কিছুটা সীমিত ছিল। কিন্তু কার্নি বলেছেন-অ্যালুমিনিয়াম, ইস্পাত এবং গাড়ির ওপর মার্কিন শুল্কের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে লাখ লাখ কানাডিয়ান। পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে লড়াই করার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। কিছুটা নিরুত্তাপ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার। বলেছেন, কারওই বাণিজ্যযুদ্ধের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। পার্লামেন্টের বক্তব্যে স্টারমার আরও বলেন, আমরা সকল পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত আছি। আমরা কোনো কিছুকেই উড়িয়ে দিচ্ছি না। বাণিজ্যযুদ্ধের বিষয়ে সতর্ক করে জার্মানি জানিয়েছে, এ বাণিজ্যযুদ্ধ উভয় পক্ষকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। নিজ দেশের কোম্পানি এবং কর্মীদের রক্ষা করার অঙ্গীকার করেছে স্পেন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেছেন, তার দেশ কোম্পানি এবং কর্মীদের রক্ষা করবে এবং একটি উন্মুক্ত বিশ্বের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। বাণিজ্যে কোনোরকম বাধা চায় না সুইডেন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী উল্ফ ক্রিস্টারসন উল্লেখ করেছেন যে, তার দেশ বাণিজ্যে ক্রমবর্ধমান কোনো বাধা চায় না। তিনি বলেছেন, আমরা বাণিজ্যযুদ্ধ চাই না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও সহযোগিতার পথে ফিরে যেতে চাই। যেন এ দেশের মানুষ আরও ভালো জীবন উপভোগ করতে পারে।

আইরিশ বাণিজ্যমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস বলেছেন, আয়ারল্যান্ড এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে পেতে প্রস্তুত। আলোচনা এবং সংলাপ সর্বদাই এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম উপায় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ট্রাম্পের মিত্র ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনিও বলেছেন, পশ্চিমাদের দুর্বল করে দেবে এমন বাণিজ্যযুদ্ধ এড়াতে নতুন চুক্তি অনুসন্ধান করবে তার দেশ। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জর্জিয়া। তিনি বলেছেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন চুক্তি নিয়ে কাজ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। যার লক্ষ্য হচ্ছে বাণিজ্যযুদ্ধ এড়ানো। ফ্রান্স সরকারের মুখপাত্র বলেছেন, এপ্রিলের মধ্যেই ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। ২৭ দেশের এ ব্লকের প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়ামের ওপর মার্কিন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করা। এরপর খাত-ভিত্তিক ব্যবস্থা নেয়া। এদিকে বুধবার ট্রাম্পের আরোপিত ১০ শতাংশ শুল্কের বিরুদ্ধে একটি আইন পাস করেছে লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল।

সার্বিক দিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপর শুল্ক আরোপের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগামী দিনের পথচলা মোটেই সুখকর হবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের ফলে প্রথমত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব-প্রতিপত্তি বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। কারণ, এমন শুল্কারোপের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় ভিকটিম রাষ্ট্রগুলো একজোট হবে। যা মার্কিনীদের জন্য খুব একটা স্বস্তিদায়ক হবে না। একই সাথে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে; বৃদ্ধি পাবে নাগরিকদের জীবনযাত্রার ব্যয়ও। ক্ষতিগ্রস্ত হবে বৈশ্বিক শিল্পও। বিশেষ করে ইস্পাত ও অ্যালুমোনিয়াম খাত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট অনাকাক্সিক্ষত শুল্ক আরোপের মাধ্যমে নিজের সাথে নিজেই বড় ধরনের জুয়া খেলেছেন। তবে শুধু চীন ছাড়া অন্যসব দেশের ওপর আরোপিত শুল্ক ৩ মাসের জন্য স্থগিত নতুন বার্তা বহন করে। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তা-ই এখন দেখার বিষয়।

সূত্র, সংগ্রাম