ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত পশ্চিমা বিশ্বে প্রকৌশলী (ইঞ্জিনিয়ার) ও ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী প্রকৌশল প্রযুক্তিবিদ (ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজিস্ট) পেশাজীবীদের মধ্যে দায়িত্বের বিভাজন স্পষ্ট। প্রত্যেকের দায়িত্ব কাঠামোগত ও আইনগতভাবে নির্দিষ্ট। পেশাগত দায়িত্বের বাস্তবসম্মত এই বিভাজন ব্যবস্থাটি প্রকৌশল পেশাকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করে তুলেছে।
এই বিভাজনটি করা হয় মূলত ডিগ্রি ও সনদ অনুযায়ী। একজন প্রকৌশলী শিক্ষাগত যোগ্যতায় স্নাতক (ব্যাচেলরস ইন ইঞ্জিনিয়ারিং)। এই একাডেমিক ডিগ্রি দিয়ে চাকরি পাওয়া যায়, তবে আইনত পেশাগত কাজ করতে চাইলে প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার (পিই) বা চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে লাইসেন্স অর্জন করতে হয়। তাদের কাজের পরিধি হলো ডিজাইন, নকশা প্রণয়ন, নকশা বিশ্লেষণ, নকশা অনুমোদন, প্রযুক্তি উন্নয়ন, প্রযুক্তি উদ্ভাবন প্রভৃতি। আইনগতভাবে তারা ডিজাইন ও নকশায় অনুমোদনসূচক স্বাক্ষর করতে পারেন। কাজের কারিগরি দিকের সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব তাদের।
অন্যদিকে একজন প্রকৌশল প্রযুক্তিবিদ শিক্ষাগত যোগ্যতায় ডিপ্লোমাধারী। তাদের ডিগ্রির নাম কখনো ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, কখনোবা অ্যাসোসিয়েট ব্যাচেলর। এই সনদ দিয়ে চাকরি শুরু করতে হয়, তবে আইনত পেশাগত কাজ করতে চাইলে সার্টিফাইড ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনিশিয়ান (সিইটি) বা এ-জাতীয় কোনো লাইসেন্স অর্জন করতে হয়। তাদের কাজের পরিধি হলো টেস্টিং, পরিমাপ, বাস্তবায়ন, রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতি। তারা কারিগরি ডিজাইন অথবা নকশায় অনুমোদনসূচক স্বাক্ষর দিতে পারেন না, কাজে তারা যতই দক্ষ হোন না কেন।
পশ্চিমা দেশে কারিগরি প্রকল্পগুলোয় তিন স্তরের পেশাজীবীদের সমন্বয়ে কাজ পরিচালনা করা হয়ে থাকে। প্রকৌশলী ও প্রকৌশল প্রযুক্তিবিদ ছাড়াও টিমে টেকনিশিয়ানরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বল্পমেয়াদি ট্রেড কোর্স সম্পন্ন করে টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ পাওয়া যায়। তারা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি পরিচালনা এবং ইনস্টলেশন, টেস্টিং ও মেইনটেন্যান্সের সময় হাতেকলমে কায়িক পরিশ্রমের কাজগুলো করে থাকে।
পশ্চিমা বিশ্বে প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারীদের মধ্যে পেশাগত দায়িত্বের বিভাজন অত্যন্ত পরিষ্কার—শিক্ষাগত যোগ্যতা, লাইসেন্স, দায়িত্ব ও পেশাগত নাম সবই আলাদা। এতে বিভ্রান্তি বা পেশাগত দ্বন্দ্ব তৈরি হয় না। প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ আর টেকনিশিয়ানদের কাজের প্রতিটি স্তর অপরিহার্য এবং পরস্পর নির্ভরশীল। তাদের মধ্যে দায়িত্বের ভারসাম্য ও পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক ছাড়া কোনো কারিগরি প্রকল্প সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। একজন টেকনিশিয়ান বা প্রযুক্তিবিদ ইচ্ছা করলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে প্রকৌশলী হতে পারেন। পশ্চিমের দেশগুলোয় পেশাজীবীদের পেশাগত উত্তরণ সহজ করার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন প্রোগ্রাম, নৈশ প্রোগ্রাম, ক্রেডিট ট্রান্সফার সুবিধাসহ নানা ধরনের সুবিধা আছে। সেখানে পেশাগত জীবনে প্রত্যেকেরই ওপরে ওঠার সুযোগটি অবারিত।
প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারীদের মধ্যে পেশাগত দায়িত্বের স্পষ্ট বিভাজন না থাকলে দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এতে দলীয় কাজের পরিবেশ নষ্ট হয় এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ভেঙে পড়ে। প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারী উভয়েই একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা শুরু করলে ব্যক্তিগত অসন্তোষ তৈরি হয় এবং মোটিভেশন ও কর্মদক্ষতা কমে যায়। অদক্ষ সিদ্ধান্তের ফলে কারিগরি ত্রুটি, নকশায় ভুল, অথবা রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা দেখা দেয়। এতে কারিগরি খাত এবং সামগ্রিকভাবে জাতি ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
সম্প্রতি দেশে প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারীদের মধ্যে পেশাগত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। দেশের কারিগরি খাতের জন্য এটি একটি অশনি সংকেত। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের বিভিন্ন হঠকারী কার্যক্রমের ফলে প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারীদের মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব বিভাজনের ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করতে না পারলে ক্ষমতার অপব্যবহার বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় অদক্ষ জনবল নিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। এতে প্রকৌশল খাত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে। প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রিধারীরা তাদের প্রাপ্য থেকে পিছিয়ে পড়বেন।
আবার ডিপ্লোমাধারীরা হয়তো দায়িত্বের বাইরে গিয়ে কাজ করতে বাধ্য হবেন, যে কাজের জন্য তারা আইনত দায়িত্বপ্রাপ্ত নন। দায়িত্ব বিভাজন না থাকলে একই ধরনের কাজে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ হতে পারে, যা কর্মসংস্থানের ভারসাম্য নষ্ট করবে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারী প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে পেশাগত ভারসাম্য রক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশেষ করে যেখানে উভয় শ্রেণির পেশাজীবীই অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে অবদান রাখছেন। পেশাগত ভারসাম্য রক্ষায় অবিলম্বে একটি জাতীয় কারিগরি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এই নীতিমালায় প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারী উভয়ের কাজের ক্ষেত্র, মানদণ্ড, সনদীকরণ ও পেশাগত উন্নয়ন স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। ডিজাইন, নকশা, বিশ্লেষণ, পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানের কাজ প্রকৌশলীদের দেওয়া উচিত।
ডিপ্লোমাধারীদের জন্য বাস্তবায়ন, সুপারভিশন, অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নির্দিষ্ট করা উচিত। এই বিভাজন সরকারি ও বেসরকারি খাতে যাতে সুস্পষ্টভাবে মেনে চলা হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। উভয় গ্রুপের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার মাধ্যমে পারস্পরিক পেশাগত সম্মানবোধ তৈরি করতে হবে। বেতন ও পদোন্নতিতে ন্যায্যতা বজায় রাখতে হবে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও প্রদর্শিত দক্ষতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে ডিপ্লোমাধারীদের জন্য আলাদা একটি ‘কারিগরি ক্যাডার’ সৃষ্টি করা যেতে পারে, যা তাদের পদোন্নতি ও পেশাগত অগ্রগতি নিশ্চিত করবে।
প্রতিদিনই প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটছে। তাই কারিগরি খাতে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের কাছ থেকে ভালো সেবা পেতে হলে যুগোপযোগী প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের সংযুক্ত রাখতে হবে। দেশে-বিদেশে নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। সবার জন্য নিয়মিত দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রোগ্রাম বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। ডিপ্লোমাধারীদের জন্য সাশ্রয়ী উপায়ে ব্যাচেলর ডিগ্রিতে উন্নীত হওয়ার সুযোগ থাকা উচিত। এজন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের জন্য বিশেষ প্রোগ্রাম থাকা উচিত।
সরকারি-বেসরকারি খাতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, পদবি ও দায়িত্ব নির্ধারণে বৈষম্য দূর করতে হবে।
প্রয়োজনে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে উভয়ের অবস্থান সুরক্ষিত করতে হবে। প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারী উভয়ই বাংলাদেশের উন্নয়নে অপরিহার্য অংশীদার। তাদের মধ্যে দায়িত্বের সুস্পষ্ট বিভাজন, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং পেশাগত উন্নয়নের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারলেই একটি টেকসই, দক্ষ ও কার্যকর কারিগরি দল গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
লেখক : অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট