সম্প্রতি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে নেমে আসে অভিশপ্ত বিপর্যয়। একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে আছড়ে পড়ে ভবনের ওপর। জানা যায়, ২১ জুলাই দুপুর ১টা ৬ মিনিটে রাজধানীর কুর্মিটোলার বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর বিমানটি স্কুল ভবনের ওপর এসে বিধ্বস্ত হয়। দুপুর ১টা ১৮ মিনিটে খবর পায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিটের নিরন্তর প্রচেষ্টায় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে আগুন লাগার প্রায় এক ঘণ্টা ২০ মিনিট পর দুপুর ২টা ২৫ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সর্বশেষ তথ্যমতে, ৩৫ জন নিহত এবং ৫৪ জনের অবস্থা সঙ্গিন।
এই ট্র্যাজেডি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে অবহেলার ভয়াবহ চিত্র– আগুন নেভানোর জন্য আমাদের কাছে নেই পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রাংশ, টুলস কিংবা কার্যকরী কৌশল। ফলে যে কোনো অগ্নিকাণ্ডে তাৎক্ষণিক আগুন নেভাতে ব্যর্থ হচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা। অথচ এই মূল্যবান সময়ে যদি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হতো, ড্রোনভিত্তিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয়তো প্রাণহানির সংখ্যা অনেক কম হতো। হয়তো অনেক শিশু তাদের মায়ের কোলে ফিরতে পারত।
দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা এখনও আগুন নেভাতে ‘বালতি ও পাইপ’ পদ্ধতিতে পড়ে আছি। আধুনিক ড্রোন, অটো ফায়ার ডিটেকশন অ্যালার্ম, স্মার্ট স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম– এসব এখনও আমাদের কল্পনার বাইরে। অথচ চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, এমনকি ভিয়েতনাম পর্যন্ত এসব প্রযুক্তি বহু বছর ধরে সফলভাবে ব্যবহার করছে; মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে।
চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে আমার সৌদি আরব ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। সেখানে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাই, কীভাবে ড্রোন ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশাল জনসমাগমে আগুন নেভানো হয়। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে আগুন শনাক্ত করে দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে না; উদ্ধার তৎপরতা চালানো যায় দ্রুততম সময়ে। এটি আমাদের জন্য বড় শিক্ষা। যদি আমাদের দেশের ফায়ার সার্ভিসে এই প্রযুক্তি আসত, তাহলে মাইলস্টোনের মতো দুর্ঘটনায় প্রাণহানি অনেক কম হতো।
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডগুলো আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার চরম দুর্বলতা বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। প্রতিটি ঘটনার পেছনে আছে অগণিত মানুষের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার করুণ গল্প। ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জন মারা গিয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন অনেকে। ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট কাজ করেছিল এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগেছিল। ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকার বঙ্গবাজারে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়েছিল। অথচ ফায়ার সার্ভিসের অবস্থান ছিল বঙ্গবাজারের পাশেই। সেই আগুনে প্রায় ১০০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।
২০১৯ সালের চকবাজার অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন নিহত ও ৫০ জনের বেশি আহত হয়েছিলেন, যেখানে রাসায়নিকের অবৈধ গুদামজাতকরণ এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রায় ১২ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। ২০১৬ সালে বসুন্ধরা সিটির আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডে দুজন নিহত ও ২০ জনের বেশি আহত হন শর্টসার্কিট থেকে সৃষ্ট আগুনে। ২০১৩ সালে নবাবপুর মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে ১৫ জন নিহত ও ৩০ জনেরও বেশি আহত হন। ২০১২ সালের চুড়িহাট্টা মার্কেটে ১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল বাণিজ্যিক এলাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরি হওয়ার কারণে। এ ছাড়া ২০১৭ সালে সাতক্ষীরা মার্কেট অগ্নিকাণ্ডে আটজন নিহত; ২০২১ সালে নরসিংদীর কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে পাঁচজন নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছিলেন।
এই হলো গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া কিছু বহুল আলোচিত অগ্নিকাণ্ডের চিত্র, যেখানে প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই আগুন নেভাতে দেরি হওয়ায় হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার ঘটনাও নজিরবিহীন নয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে এসেও আগুন নেভাতে গিয়ে জীবন বাজি রেখে সাহসিকতা প্রদর্শন করতে হচ্ছে এবং অনেক সময় সেই সাহসিকতার পরিণতিই হচ্ছে মৃত্যু। এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
অন্যদিকে, প্রতিবছর দুর্ঘটনা আর প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে চললেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। অনিয়ম, অব্যবস্থা আর চরম অবহেলার মধ্যেই ঘটে চলে একের পর এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, ঝরে যায় অসংখ্য প্রাণ। এসব দুর্ঘটনার পর কিছুদিন হইচই হয়; প্রতিবাদে সরব হয় নাগরিক সমাজ। সংবাদমাধ্যমগুলোও সোচ্চার হয়। কিন্তু প্রতিবাদগুলো যেন সাময়িক ঢেউ। কিছুদিন পর সেই ঢেউ শান্ত হয়ে যায়। সবকিছু আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে, যেন কিছুই ঘটেনি। এর পেছনে প্রধানত রয়েছে বিচারহীনতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, মনিটরিং ও জবাবদিহি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে এখন আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ারফাইটিং ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে দ্রুত আগুন শনাক্ত করে পানি বা ফোম ছিটানো হয়। এসব ড্রোনের দাম ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই কোটি টাকার মধ্যে, যা দেশের সামগ্রিক বাজেটের তুলনায় খুবই সামান্য। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর জনগণের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে। এর সামান্য অংশও যদি ফায়ার সার্ভিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর জন্য আধুনিক ড্রোন প্রযুক্তি কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবহৃত হতো, তাহলে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হতো।
তাহলে কেন আমরা এখনও এগুলো ব্যবহার করি না? কারণ, আমাদের রাজনীতিবিদরা কিংবা প্রশাসনিক মহল এখনও ‘প্রচলিত পদ্ধতি’ ও ‘মানুষের সাহস’-এর ওপর ভরসা করেন। তারা নতুন প্রযুক্তি নিয়ে ভয় পান, খরচ বেশি ভাবেন অথবা এর রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারের জটিলতা নিয়ে অহেতুক আশঙ্কা করেন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই খাতে বিনিয়োগের জন্য তদারকি ও দায়িত্বশীলতার অভাব। ফলে বড় বড় বাজেটের ঘোষণা এলেও বাস্তবে কোনো পরিবর্তন আসে না। বরাদ্দকৃত অর্থও ভিন্ন খাতে চলে যায় বা অপচয় হয়।
মাইলস্টোনের দুর্ঘটনা আমাদের জন্য বড় হুঁশিয়ারি। এখনও সতর্ক না হলে সামনে আরও খারাপ দিন আসবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে! প্রতিট প্রাণের মূল্য অপরিসীম। আর সেসব প্রাণ যাতে অনিয়ম আর অবহেলার বলি না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবার।