পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় এই মুহূর্তে এক ভয়াবহ সরকারবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধিয়াছে। শিক্ষা খাতে প্রস্তাবিত বাজেট কাটছাঁট এবং নূতন কর আরোপকে কেন্দ্র করিয়া হাজার হাজার নাগরিক রাজধানী নাইরোবির রাজপথে নামিয়া প্রতিবাদ জানাইতেছেন। বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিবর্ষণে অন্তত ৩৯ জন নিহত হইয়াছেন-এমনটি জানাইতেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।

কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো বলিয়াছেন, 'যাহারা অপরের সম্পত্তিতে অগ্নিসংযোগ করে, তাহাদের পায়ে গুলি করা উচিত। তাহাদের প্রাণনাশ করা প্রয়োজন নহে; কিন্তু এমন মাইর দেওয়া উচিত যাহাতে তাহাদের পা ভাঙিয়া যায়। পরবর্তীকালে তাহাদেরকে হাসপাতাল হইতে আদালতে লইয়া যাওয়া যাইবে।' সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি আরো লিখিয়াছেন, 'যাহারা কেনিয়ার সাধারণ জনগণ, পুলিশ সদস্য এবং ব্যবসায়ীদের উপর আক্রমণ চালায় ও নিরাপত্তা স্থাপনায় ক্ষতিসাধন করে, তাহারা সন্ত্রাসী।

এই সকল অপরাধ কার্যত যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য।' একটি পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী শর্টকাট পথ অবলম্বন করিয়া রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইতে চাহে-এই অভিযোগ উত্থাপন করিয়া তিনি বলিয়াছেন, 'আমরা আমাদের দেশকে ধ্বংস হইতে দিব না।'

গত বিংশ ও একবিংশ শতকে আমরা সরকারবিরোধী অসংখ্য আন্দোলন দেখিয়াছি। এবং সেই সকল আন্দোলন উন্নত বিশ্বেও হইয়াছে। ঘটিয়াছে জীবনহানির ঘটনাও। উন্নত দেশসমূহেও বিভিন্ন আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাসীনরা একাধিক বার কঠোর পদক্ষেপ লইয়াছেন। তবে সেই সকল পদক্ষেপ সর্বদা ন্যায়সংগত কিংবা কার্যকর হইয়াছে-এই দাবি করা কঠিন।

১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের নাগরিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে (সিভিল রাইটস মুভমেন্ট) সরকার ও অঙ্গরাজ্যগুলির প্রতিক্রিয়া ছিল সহিংস ও তীব্র। বার্মিংহাম নগরীতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে জলকামান ও পুলিশ-কুকুর ব্যবহৃত হইয়াছিল। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মতো নেতৃবৃন্দকেও একাধিক বার গ্রেফতার করা হয়। যদিও পরবর্তীকালে আইন প্রণয়ন ও সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে আন্দোলনের অনেক দাবি পূরণ হইয়াছে, তথাপি তৎকালীন শাসকদের সহিংস প্রতিক্রিয়া ইতিহাসে গাঢ় দাগ কাটিয়াছে।

ফ্রান্সের ১৯৬৮ সালের মে আন্দোলন-যাহা একযোগে ছাত্র, শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিক্ষোভে রূপান্তরিত হইয়াছিল তাহাও একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত। প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল জরুরি অবস্থা জারির প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং সেনাবাহিনীকে প্যারিসে নামাইবার জন্য প্রস্তুত রাখেন। একইভাবে যুক্তরাজ্যে ১৯৮৪-৮৫ সালের খনিশ্রমিকদের ধর্মঘটে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার প্রায় ২০ হাজার পুলিশ নিযুক্ত করিয়াছিলেন আন্দোলন দমন করিবার জন্য।

আন্দোলন দীর্ঘায়িত হইলেও রাষ্ট্র কর্তৃক অনমনীয় অবস্থান গ্রহণ করা হয় এবং বিক্ষোভকারীদের প্রতি সহিংস আচরণ সমাজে বিভক্তি ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে। পশ্চিম জার্মানির প্রেক্ষাপটে রেড আর্মি ফ্যাকশনের সহিংস কার্যকলাপকে দমন করিবার জন্য তৎকালীন সরকার যে দমননীতি অবলম্বন করিয়াছিল-তাহা মানবাধিকার সংগঠনগুলির নিকট সমালোচিত হইয়াছিল।

অনেকেই মনে করেন-আন্দোলন দমনে গ্রেফতার, পীড়ন এবং বিচারব্যবস্থায় কঠোরতা অপরিহার্য হইলেও প্রশ্ন থাকে-রাষ্ট্রপরিচালনাকারী সরকার কোথায় তাহার দমনের সীমারেখা টানিবে? বর্তমানে কেনিয়ায় চলমান সহিংসতা এবং প্রেসিডেন্টের হুমকির ভাষা কতখানি সংযত হওয়া উচিত? ইতিহাস আমাদের এই সত্যও শিখায় যে, আন্দোলন মোকাবিলায় কেবল বল প্রয়োগ নহে-সংলাপ, সহনশীলতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাই হইতেছে দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের পথ।

দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলার সহিত আলোচনার মাধ্যমে বর্ণবৈষম্য উত্তরণের ইতিহাসই ইহার প্রমাণ। আবার কানাডায় 'অকুপাই' আন্দোলনের সময় কিংবা জার্মানিতে আধুনিক কৃষক ও ছাত্র আন্দোলনে তুলনামূলক সংযত পুলিশি ব্যবস্থাপনা ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যস্থতায় ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস পায়।

ইতিহাস আমাদের দেখাইয়াছে-যেইখানে সরকার বন্দুক চালাইয়া শৃঙ্খলা ফিরাইবার চেষ্টা করিয়াছে, সেইখানেই জন্ম লইয়াছে চরমপন্থা ও অবিশ্বাস। সুতরাং একটি দায়িত্বশীল সরকারের মধ্যে প্রশ্ন জাগা উচিত-'এই ক্ষোভের উৎপত্তি কোথায়?' এবং 'আমরা কীভাবে মানুষের আস্থা অর্জন করিতে পারি?' সরকার যদি জনগণের ভয়ের উৎসে পরিণত হয়, তবে তাহা কেবল সরকারের ব্যর্থতাই নয়, রাষ্ট্রচরিত্রেরও সংকট। এই সংকটের উত্তরণ না ঘটিলে সেই রাষ্ট্র কখনো উন্নত রাষ্ট্র হইয়া উঠিতে পারে না।

সূত্র, ইত্তেফাক