এক. আমাদের ইতিহাস এবং আমাদের পূর্ব পুরুষদের ইতিহাস মূলত জালিম ও জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস। যুগে যুগেই এই মাটির সন্তানেরা বুক চিতিয়ে লড়াই করেছে মুক্তির জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, ন্যায় বিচার ও সুশাসনের জন্য। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আমরা লড়েছি। পাকিস্তানের শোষণ উৎপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে আমরা একটি নতুন রাষ্ট্র অর্জন করেছি। সেটা কারো দয়ায় নয়, রক্ত এবং জীবন দিয়েই আমরা অর্জন করেছি। বাঙালি লড়াই করতে জানে না - এই বক্তব্য আমরা ভুল প্রমাণ করেছি বার বার। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আমরা আমাদের লড়াইয়ের সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছি। আমরা যারা শোষণ হীন একটি ন্যায় ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি, আমরা সবাই এই লড়াইয়ে অংশ নিয়েছি। কেউ জীবন দিয়েছি, কেউ আহত আর কেউ বা নতুন বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছি। এই যে নতুনের আবাহন, নতুন কিছুর স্বপ্ন এর জন্য আমাদের অনেক কিছুই জীবন থেকে ছাড় দিতে হয়েছে।
দুই. জুলাই একটি চেতনার নাম। প্রতি বছরের জুলাই আমাদের মনে করিয়ে দিবে কিভাবে জুলুম এবং জালিমের বিরুদ্ধে লড়াই করে ফ্যাসিবাদের করব রচনা করতে হবে। বাঁচতে হলে কীভাবে মরতে হয় সেই মহাকাব্যের নাম জুলাই। জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতি, বাংলাদেশের ভবিষ্যত, বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন এক আশার মানচিত্র তৈরি করে দিয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষ এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে যেখানে কোনো অন্যায় -অবিচার- শোষণ- নিপীড়ন থাকবে না।
শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক, ছাত্র শ্রমিক রাজনৈতিক কর্মী, সাধারণ মানুষ সবাই কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নেমে আসলো? কেন জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করলো বীর জনতা? এইসব কেনর উত্তর জানা এবং রাজনীতিবিদদের তা মনে রেখে কাজ করা খুব জরুরি। মানুষ সমাজে ন্যায়বিচার চায়, সুশাসন চায়, নানামুখী হয়রানি থেকে মুক্তি চায়। মানুষকে এসব থেকে মুক্তি দিতে না পারলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনা ব্যর্থ হবে।
তিন. জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহুরে এলিট তরুণ প্রজন্মের একটা বড় ভূমিকা আছে। এটা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটা ইউনিক বিষয়। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে সমাজে একটি ভিন্ন ধারণা ছিল। মনে করা হতো এবং বলা হতো দেশ এবং রাজনীতি নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু রিয়েলিটি হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রুখে দাঁড়ানোর বিষয়টা। জীবন বাজী রেখে দেশের জন্য তারা লড়াই করেছে। দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হওয়ার পরে তারা ক্যাম্পাসে ফিরে গেছে। তাহলে এই যে প্রজন্ম তারা কেন, কিসের জন্য বুলেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো? যারা সেই দিন মৃত্যুর পরোয়ানা বুক পকেটে নিয়ে জীবনের জয়গান গেয়েছেন তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়াই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট।
২৪জন রিক্সাওয়ালা জীবন দিয়েছে, শিশুরা শহীদ হয়েছে, নারী শহীদ হয়েছেন, ছাত্ররা শহীদ হয়েছে, সাধারণ মানুষ শহীদ হয়েছে, নাম না জানা মানুষের কবর হয়েছে রাজধানীতে। এতো সেক্রিফাইজ আমরা কোনো ভাবেই ভুলে যেতে পারি না। জুলাই গণঅভ্যুত্থান এদেশের মানুষের রাজনৈতিক চিন্তায় ঝড় তুলেছে। যারা রাস্তায় নেমেছিল তারা বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছে সেটাই মূলত জুলাইয়ের চেতনা। সেখান থেকে সরে আসলে যে কারো রাজনীতি কঠিন হবে এতে কোনো সন্দেহ নাই।
চার. জুলাই গণঅভ্যুত্থানে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, সাধারণ মানুষ সবার স্বপ্ন এক মোহনায় এসে মিলিত হয়েছিল। সবাই এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে যেখানে কোনো ভয়ের সংস্কৃতি থাকবে না, ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস থাকবে না, মানুষের প্রতি জুলুম করা হবে না, মানুষের ভোটের অধিকার থাকবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে - জুলাই উত্তর বাংলাদেশে এই স্বপ্ন গুলো বাস্তবায়ণ করাই এখন একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। মানুষ রক্ত এবং জীবন দিয়ে জুলাইয়ে মুক্তির যে মহাকাব্য রচনা করেছে তাকে কোনো ভাবেই আমরা ব্যর্থ হতে দিতে পারি না।
জুলাইয়ের চেতনা একটি পরিচ্ছন্ন রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা, একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, ফ্যাসিবাদকে কবর দেওয়ার অঙ্গীকার। আমরা যদি মানুষের কল্যাণে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে রাজনীতিকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে পারি তাহলেই শহিদের আত্মা শান্তি পাবে, জুলাইয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।
পাঁচ. স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন পথের সন্ধানে। আইনের শাসন, সুশাসন, গণতন্ত্র, মুক্তি এসব বিষয়কে ধারণ করেই এগিয়ে যেতে চায় সমাজ। যেজন্য রাষ্ট্রকে মূখ্য ভূমিকা রাখতে হয় এবং হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতির সেই নতুন দিগন্তের শুভ সূচনা করেছে। পুরো সমাজকে এক নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে জুলাই। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত পরিবর্তন, সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, রাজনীতিকে সমস্যা সমাধানের কারণ হয়ে উঠতে সহায়তা করা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের অন্যতম অনুষঙ্গ।
ফ্যাসিবাদের পতনের পর জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদেরকে এমন একটি বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে এদেশের আঠারো কোটি মানুষ। জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের ঐক্যের চূড়ান্ত পরিণতি। এটা ধরে রাখতে হবে যেকোনো মূল্য। রাজনৈতিক ভিন্ন চিন্তা আমাদের বিভাজনের কারণ হয়ে না উঠুক। অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশে ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশনটা ভালো করে সম্পন্ন হওয়া খুব জরুরি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদেরকে এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছে যে বাংলাদেশটা হবে আপনার, আমার, সবার। জাতি হিসেবে আমাদের স্বপ্ন দেখার, লড়াই করার এবং জয়ী হওয়ার ইতিহাস অনেক। আছে বিজয় ছিনিতাই হওয়ার ক্ষতও। কিন্তু এবার আমরা হারতে চাই না। সবাই মিলে গড়তে চাই নতুন বাংলাদেশ, সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার বাংলাদেশ। জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেই স্বপ্ন দেখায়, এটাই মূলত জুলাইয়ের চেতনা।