নির্বাচনের তারিখ নিয়ে তবু আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু নির্বাচনে ভোটারদের প্রার্থী পছন্দের ক্ষেত্রে পর্যাপ্তসংখ্যক বিকল্প থাকবে কি থাকবে না—সেটা নিয়ে কি কেউ আলোচনা করছে? বাস্তবতা হচ্ছে—করছে না। যেসব নির্বাহী আদেশ এরই মধ্যে এসেছে, তাতে এতটুকু অন্তত বোঝা যাচ্ছে যে ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিল—নির্বাচন যখনই হোক না কেন, তাতে নৌকা মার্কা নিয়ে কোনো প্রার্থী থাকছে না।
গত জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলির ওপর জাতিসংঘ মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশন একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এটা এ বছরের শুরুর দিকের কথা। ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে হাসিনা সরকারের নির্মম কর্মকাণ্ডের একটা প্রাথমিক চিত্র পাওয়া যায়। কত মানুষ নিহত হয়েছে, তাদের মধ্যে নারী বা শিশু কত জন, কত মানুষ আহত বা পঙ্গু হয়েছে, হত্যাযজ্ঞ কারা চালিয়েছে, কার নির্দেশে চালিয়েছে—এ রকম অনেক প্রশ্নের জবাবই পাওয়া যায় সেই প্রতিবেদনে। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের সেই আন্দোলনে যে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে, সেই সংখ্যাটিও প্রথম পাওয়া যায় তাদের প্রতিবেদনেই। এর আগপর্যন্ত আমাদের সরকারি বা বেসরকারি কোনো পর্যায়েই এ রকম সুনির্দিষ্ট কোনো ফিগার পাওয়া যায়নি।
জাতিসংঘ মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনের এই প্রতিবেদনকে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে স্বাগত জানানো হয়। এই প্রতিষ্ঠানটির নাম এর আগেও বহুবার আমাদের মিডিয়াতে উচ্চারিত হয়েছে। হাসিনা সরকারের আমলে প্রায় সব প্রতিবেদনকেই সেই সময়ের মন্ত্রীরা খুবই মন্দ চোখে দেখতেন। তাঁরা এই কমিশনের রিপোর্টকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিহিত করতেন। সে সময় এই প্রতিষ্ঠানের হাইকমিশনার ফলকার তুর্কের নামও আমাদের কাছে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিল। হাসিনা সরকারের পতনের পটভূমি তৈরিতে এই ভদ্রলোকের বেশ একটা ভূমিকাও ছিল বলে অনেকে মনে করেন। সে বিবেচনায় এমন কথা অনেকে হয়তো ভেবেছেন যে, ড. ইউনূস ও তাঁর সরকারের সঙ্গে হয়তো এই প্রতিষ্ঠানের ভালো সম্পর্কই থাকবে। ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া তাদের প্রতিবেদন সেই ধারণাকে আরও দৃঢ় করে থাকবে।
দুই দিন আগে সেই ফলকার তুর্কের আরেকটা বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। ১৬ জুন জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিলেন। তিনি সেখানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার চলমান সংলাপের প্রশংসা করেন। কিন্তু পাশাপাশি একটি বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক যে আইনি পরিবর্তনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘এই ধরনের পদক্ষেপ অযৌক্তিকভাবে মানুষের সংগঠনের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমাবেশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।’
জেনেভায় ফলকার তুর্কের এমন বক্তব্যের পর এই লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত তিন দিন অতিক্রম হয়ে গেছে। কিন্তু এ নিয়ে সরকারের কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া আমি দেখলাম না। আগেরবার যেমন প্রতিবেদনটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই স্বাগত জানানো হয়েছিল, এবার সরকারের কেউ আর স্বাগত জানাল না। এমনকি মাঠে সক্রিয় থাকা কোনো রাজনৈতিক দলও এ বিষয়ে কিছু বলল না! প্রশংসা বা নিন্দা কোনোটাই দেখলাম না। তাহলে সবাই কি বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে চাইছে?
ফলকার তুর্ক বা মানবাধিকার কমিশনের এমন বক্তব্য কিন্তু অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। ফেব্রুয়ারির যে প্রতিবেদনকে সরকারিভাবে স্বাগত জানানো হয়েছিল, সেখানেও কিন্তু এ রকমই একটা কথা আরও অনেক স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল। সেখানে তারা কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ না করার পরামর্শ দিয়েছিল। কারণ হিসেবে তারা তখন বলেছিল, কোনো দলকে নিষিদ্ধ করলে তা প্রকৃত বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে পারে এবং বাংলাদেশের জনগণের একটি বড় অংশকে কার্যত ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে। তখন অবশ্য সরকারপ্রধান ড. ইউনূসকেও বিভিন্ন বিদেশি সংবাদমাধ্যমের কাছে বলতে শোনা গেছে—কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা তাঁর সরকারের নেই।
এর মধ্যে ড. ইউনূস বা তাঁর সরকারের ইচ্ছায় বড় পরিবর্তন এসেছে। কেন এই পরিবর্তন, সে সম্পর্কে তাদের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তবে এনসিপির একজন নেতা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ আর অঙ্গসংগঠনগুলোর সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাহী আদেশে এটা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এই সংগঠন ও সেগুলোর নেতাদের বিচারের। বলা হয়েছে—এই বিচার যত দিন শেষ না হবে, তত দিন তারা দেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না। এর পাশাপাশি সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনেও একটু পরিবর্তন এনেছে। আগে কোনো রাজনৈতিক দলকে শাস্তি প্রদান বা নিষিদ্ধ করার কোনো ক্ষমতা এই ট্রাইব্যুনালের ছিল না। নতুন অধ্যাদেশের মাধ্যমে তাদের সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এইসব সিদ্ধান্ত যে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলকে লক্ষ্য করেই নেওয়া হয়েছে, সেটা বুঝতে মোটেই গবেষণা করতে হয় না।
সরকারের এইসব সিদ্ধান্ত এমন এক সময় নেওয়া হলো, যখন পুরো জাতি অপেক্ষা করছে একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য। নির্বাচন কখন হবে, কখন হওয়া উচিত, সেসব নিয়ে বেশ জোরদার আলোচনা হচ্ছে। কিছুদিন আগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা শেষে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল বলেছিল নির্বাচন হওয়া উচিত ডিসেম্বর বা তারও আগে। এরপর লন্ডনে তারেক রহমান ও ড. ইউনূসের বৈঠক হলো, তারেক রহমান প্রস্তাব দিলেন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের। ওই এক ঘটনার পর ‘ডিসেম্বর’ যেন ভোজবাজির মতো হারিয়ে গেল! এখন আলোচনায় শুধুই ফেব্রুয়ারি। ঐকমত্যের ভিত্তিতে সব সিদ্ধান্তের কথা বলা হলেও নির্বাচনের তারিখ নিয়ে কি আদৌ জাতীয় ঐকমত্য হয়েছে? এটা ঠিক, বিএনপিতে স্বস্তি ফিরে এসেছে। উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার এত দিনের ঘনিষ্ঠ মহলে। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির পক্ষ থেকে তাদের অসন্তুষ্টির কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ্যেই জানান দেওয়া হয়েছে।
যাই হোক, নির্বাচনের তারিখ নিয়ে তবু আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু নির্বাচনে ভোটারদের প্রার্থী পছন্দের ক্ষেত্রে পর্যাপ্তসংখ্যক বিকল্প থাকবে কি থাকবে না—সেটা নিয়ে কি কেউ আলোচনা করছে? বাস্তবতা হচ্ছে—করছে না। যেসব নির্বাহী আদেশ এরই মধ্যে এসেছে, তাতে এতটুকু অন্তত বোঝা যাচ্ছে যে ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিল—নির্বাচন যখনই হোক না কেন, তাতে নৌকা মার্কা নিয়ে কোনো প্রার্থী থাকছে না। তাহলে এত বছর ধরে সারা দেশে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ নৌকায় ভোট দিয়ে এসেছে, তাদের বেছে নেওয়ার জন্য কী বিকল্প থাকছে? জবাব দেওয়া দূরে থাক, এমন প্রশ্ন উচ্চারণই যেন এখন একটা অপরাধে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ওই যে বিপুলসংখ্যক মানুষ, কিংবা তর্কের খাতিরে যদি ধরি অতি অল্পসংখ্যক মানুষ, তাদেরকে বেছে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত বিকল্প প্রার্থী না দেওয়া—এটাকে কি গণতন্ত্র বলা যাবে? ফলকার তুর্ক কিন্তু এ কথাটাই বলেছেন জেনেভায়। জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশন গত ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া তাদের প্রতিবেদনেও বলেছে এই একই কথা। বলা বাহুল্য, সরকার সেটা পছন্দ করেনি। আর সরকারকে খুশি করতে মিডিয়াগুলোও বোধ করি এ নিয়ে তেমন একটা উচ্চবাচ্য করছে না।
ভালো। মেনে নেওয়া এবং মানিয়ে নেওয়ার রাজনীতির পালে কি এখন নতুন হাওয়া বইবে? এটাই কি তবে ‘নতুন বাংলাদেশে’র শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্র!
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক