আজকের দিনে ভারতের প্রতিটি সকাল শুরু হয় দুই ধরনের বিনোদন দিয়ে। এক ধরনের বিনোদন টেলিভিশনের পর্দায় প্রচারিত হয়। সেখানে পাকিস্তান, হিন্দু পরিচয়ের গর্ব আর ‘নতুন ভারত’ নিয়ে অবিরাম অনুষ্ঠান চলে। অন্য ধরনের বিনোদন টেলিভিশনে দেখা যায় না, কিন্তু তা টেলিভিশনে প্রচারিত বিনোদনটির মতোই বাস্তব। সেটি হচ্ছে, প্রতিদিন মুসলমানদের গণপিটুনি, হয়রানি, কারাবন্দি করা ও তাদের দানবের মতো করে উপস্থাপন করার ঘটনা।
উভয় ধরনের বিনোদন কাছাকাছি ফল বয়ে আনে। এতে হয় মুসলমানদের দুঃখ-কষ্ট আড়াল করা হয়, নয়তো সেটাকে রূপান্তরিত করা হয় এক ধরনের প্রদর্শনীর বিষয়ে। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জন্য এসব সান্ধ্যকালীন বিনোদনের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। অন্যদিকে মুসলমানদের বাঁচতে হয় এমনভাবে, যেন তারা চিরকালীন অপরাধী, যাদের ওপর সবসময় অভিযোগ থাকে কিন্তু কখনো তাদের অভিযোগ কেউ শোনে না।
এই সেপ্টেম্বর মাসে আজমগড়ে সাত বছরের মুসলিম শিশুটির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিই ধরুন। তার দেহ একটি ব্যাগে ভরা অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রতিবেশীরা নির্বিকারভাবে সেটি দেখতে থাকে, যেন কিছুই হয়নি। যদিও পরে তারাই এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সামান্য সময়ের জন্য ঘটনাটি প্রচার করেছিল, কিন্তু টেলিভিশন থেকে তা দ্রুতই হারিয়ে যায়। তার জায়গা দখল করে ‘লাভ জিহাদ’, সীমান্ত উত্তেজনা বা ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক। একটি মুসলিম শিশুর মৃত্যু জাতীয় ক্ষোভে রূপান্তরিত হতে পারেনি। বরং তা স্বাভাবিক সহিংসতার আরেকটি উদাহরণ হয়ে আছে মাত্র।
সমাজবিজ্ঞানী স্ট্যানলি কোহেন একবার ‘স্টেটস অব ডিনায়াল’-এর ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, যে সমাজে নৃশংসতাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা হয় না, বরং এত বেশি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয় যে তা আর কাউকে নাড়া দেয় না, তাই হচ্ছে সেই সমাজের স্টেটস অব ডিনায়াল।
এটাই আজকের ভারতের বাস্তব অবস্থা। দিনের আলোয় মুসলমানদের হত্যা করা হয়, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে তা শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ।
কানপুরে মুসলমানরা যখন ‘আমি মুহাম্মদকে (সা.) ভালোবাসি’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল, তখন পুলিশ তাদের রক্ষা তো করেইনি; বরং ১৩০০ মুসলমানের বিরুদ্ধে এফআইআর করে গণগ্রেপ্তার চালায়। সেদিন ভালোবাসার কাজও অপরাধ হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু মহারাষ্ট্র বা মধ্যপ্রদেশে যখন হিন্দুত্ববাদী মব প্রকাশ্যে গণহত্যার আহ্বান জানায়, তখন টেলিভিশনগুলো হয় তাদের মহিমান্বিত করে তুলে ধরে, নয়তো চুপচাপ দেখেও না দেখার ভান করে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে এক ধরনের নাট্যমঞ্চের সঙ্গে তুলনা করা চলে—যেখানে মুসলমানরা সবসময় আসামি আর হিন্দুত্ববাদীরা সভ্যতার রক্ষকের ভূমিকায়। কারো নিরীহ কাজও অপরাধ আর কারো প্রকৃত অপরাধও অপরাধ নয়।
ইন্দোরে ‘জিহাদি-মুক্ত বাজার’-এর নাম দিয়ে মুসলিম ব্যবসায়ীদের এক রাতের মধ্যে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। একে ‘অর্থনৈতিক গণপিটুনি’ ছাড়া আর কীইবা বলতে পারি। এ ঘটনায় পরিবারগুলো তাদের জীবিকা অর্জনের একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে ফেলেছে, অর্থাভাবে শিশুদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে আর নারীরা খাবারের জন্য প্রতিবেশীদের কাছে ভিক্ষা চাইতে বাধ্য হয়েছে।
তবু জাতীয় গণমাধ্যমগুলো একে উপস্থাপন করেছে ‘আইনশৃঙ্খলার সামান্য ব্যত্যয়’ হিসেবে। মানবিক ক্ষয়ক্ষতির কথা প্রায় বলাই হয়নি। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উৎসব করেছে। মুসলমানদের সর্বস্ব হারানোর ঘটনাকে ভাইরাল বিনোদনে পরিণত করেছে তারা। যা হওয়া উচিত ছিল জাতীয় কেলেঙ্কারি, সেটিকে বানানো হয়েছে একটি সাধারণ ‘স্থানীয় উত্তেজনা’র গল্প। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এই সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছেন। সরকারি পদে থেকেও তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। মুসলমানরা তার ভাষায় ‘সন্ত্রাসবাদ-সমর্থক’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’।
যোগী আদিত্যনাথরা তো কোনো প্রান্তিক কেউ নয়; এরা শাসক শ্রেণির মূল অংশ। তবু তথাকথিত বিরোধী দলগুলো ক্ষোভ প্রকাশ না করে। এরা বরং যার যার নিজস্ব হিন্দুত্ববাদের সংস্করণ নিয়ে ব্যস্ত। কে বেশি ‘হিন্দুপন্থি’ হতে পারে, তা নিয়ে এদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। আর সেই প্রতিযোগিতার মধ্যেই মুসলমানদের আশঙ্কা এবং উদ্বেগ চাপা পড়ে যায়।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকারি ও বিরোধী উভয় দলের মধ্যে এ ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে, ভারতে মুসলমানরা আর রাজনৈতিক নাগরিক নয়; তারা শুধু রাজনীতির উপকরণ (props)।
আজকের ভারতে মুসলমান হিসেবে বাঁচা মানে একজন সার্বক্ষণিক সন্দেহভাজন হিসেবে বাঁচা। মসজিদে নজরদারি, বাজারে বিচার আর শ্রেণিকক্ষে সন্দেহ। প্রতিটি জুমার নামাজ এখন একটা ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনা। মাইকে আজানের প্রতিটি ডাক কিছু মানুষের কাছে উসকানির মতো শোনায়, যদিও সেটিই একটি সম্প্রদায়ের হৃৎস্পন্দন।
উর্দু কবি সাহির লুধিয়ানভি একবার লিখেছিলেন, ‘জিনহে নাজ হ্যায় হিন্দ পার ও কাহাঁ হ্যায়’, অর্থাৎ ‘যাদের ভারতের ওপর খুব গর্ব, তারা এখন কোথায়?’ সেই প্রশ্ন আজও প্রাসঙ্গিক।
উগান্ডায় জন্ম নেওয়া মুসলিম পণ্ডিত মাহমুদ মামদানি এই বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করার একটি তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করেছেন।
তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম’-এ তিনি দেখিয়েছেন, রাষ্ট্র ও সমাজ কীভাবে মুসলমানদের দুই ভাগে ভাগ করে রাখে। এদের একদল ‘গ্রহণযোগ্য’, যারা নীরবে সব সহ্য করে চলে; আরেক দল ‘বিপজ্জনক’, যারা রুখে দাঁড়ায়। এমনকি যারা নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারাও এই ভাগে পড়ে। ভারতে এই বিভাজনকেই প্রতিনিয়ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
যে মুসলমান নিজের বিশ্বাস গোপন রাখে, আচার-আচরণ থেকে মুসলমান পরিচয় বোঝা যায় না, তাকে সহ্য করা হয়। কিন্তু যে মুসলমান নিজের পরিচয় দেয়, যে প্রকাশ্যে বলে, ‘আমি মুহাম্মদকে ভালোবাসি’, যে সমান অধিকারের দাবি করে, যে তাকে দৃশ্যপট থেকে মুছে ফেলার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তাকে সঙ্গে সঙ্গে অপরাধী বা মুজরিম বলে চিহ্নিত করা হয়।
মামদানির মতে, এটা ধর্মতত্ত্বের বিষয় নয়, বরং ক্ষমতার প্রশ্ন। কে বৈধতা নির্ধারণের অধিকার রাখবে আর কে প্রতিনিয়ত সন্দেহের মধ্যে বাঁচবে, এই বিভাজনটাই আসল।
এ কারণেই গণপিটুনির ভিডিওগুলো হোয়াটসঅ্যাপে মিমের মতো ঘোরে, টেলিভিশন উপস্থাপকরা ‘মুসলিম জনসংখ্যা বিস্ফোরণ’ নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে দিয়ে হাসে আর দাঙ্গাবাজরা দোকান পুড়িয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে।
ভারতে ঘৃণা এখন শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই; এটি পরিণত হয়েছে সামাজিক বিনোদনে। যখন নিষ্ঠুরতা হাস্যরসে রূপ নেয় আর অপমান হয়ে ওঠে প্রাইম-টাইম খবরের বিষয়বস্তু, তখন গণতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদের মধ্যকার সীমারেখা ভেঙে পড়ে।
কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, যে সমাজ সংখ্যালঘুদের কষ্টকে বিনোদনে পরিণত করে, সেই সমাজ নিজেও পচনের হাত থেকে রেহাই পায় না।
নাৎসিদের উত্থানের সময় জার্মান উদারপন্থিদের নীরবতা, কৃষ্ণাঙ্গদের গণপিটুনির সময় আমেরিকানদের উদাসীনতা আর গাজায় বোমাবর্ষণের সময় ইসরাইলিদের উল্লাস সবকিছুই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ঘৃণার ওপর গড়া বিনোদন শেষ পর্যন্ত সেই সমাজকেই গ্রাস করে ফেলে।
ভারতও এই নিয়মের বাইরে নয়। তাই আমি আবার সেই প্রশ্নে ফিরে যাই : আমরা কি মুসলিম, নাকি মুজরিম (অপরাধী)? কেন আমাদের প্রতিদিন আসামির মতো বাঁচতে হবে, যখন খুনিরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়? কেন আমাদের শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা মিডিয়া থেকে গায়েব করে ফেলা হয়, অথচ রাষ্ট্র স্বাধীনতার ‘অমৃতকাল’ উদযাপন করে?
এই প্রশ্ন শুধু মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য নয়, মূলত ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকেই ঠিক করতে হবে, তারা কি ঘৃণাকেই তাদের প্রিয় সিরিয়াল হিসেবে দেখতে থাকবে, না কি তারা এসব ত্যাগ করবেন।
কারণ যেদিন ঘৃণাই হয়ে উঠবে জাতীয় বিনোদনের একমাত্র অনুষঙ্গ, সেদিন শুধু মুসলমানরাই এর ভুক্তভোগী হবেন না, এর ভুক্তভোগী হবে পুরো রাষ্ট্র।
আর ইতিহাস তখন জিজ্ঞাসা করবে না তুমি হিন্দু না মুসলমান, ডানপন্থি না উদারপন্থি। সে শুধু জিজ্ঞাসা করবে, কেন সভ্যতার উৎকর্ষ নিয়ে গর্বিত একটি সমাজ নিষ্ঠুরতাকে হাস্যরস আর নীরবতাকে সম্মতিতে পরিণত করেছিল। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠের সামনে এখন প্রশ্নটা আর সহনশীলতা বা ধর্মনিরপেক্ষতার নয়; প্রশ্ন হলো—তারা কি এখনো তাদের প্রতিবেশীকে মানুষ বলে গণ্য করে?
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা