২১ বছর বয়সি আগন্তুক ঢাকার স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্র। সামাজিক মাধ্যমে তিনি যখন বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নির্যাতিত হওয়ার খবর পান, তখন প্রথমেই খোঁজ নিয়ে দেখেন তার হিন্দু প্রতিবেশীরা কেমন আছেন।

ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন আগন্তুক। এই আন্দোলনের কারণেই বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ওই আন্দোলনে সরকারের শক্তি প্রয়োগের কারণে তিন শতাধিক মানুষ নিহত হয়। রাস্তার আন্দোলনে যোগ না নিয়ে আগন্তুক তার প্রযুক্তিগত দক্ষতার জন্য অনলাইন নজরদারি এবং সরকার আরোপিত ইন্টারনেট ব্লকেডের মধ্যে কী করে কাজ করা যায় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করার জন্য গঠিত একটি টিমে ছিলেন।

আগন্তুক বলেন, হিন্দুদের ওপর হামলা কখনোই ছাত্র আন্দোলনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল না। অনেকেই বিষয়টিকে দেখছিলেন ‘গণহত্যা’ হিসেবে, যা উদ্বেগজনক।

বাংলাদেশের রাজধানী থেকে ফোনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আগন্তুক বলেন, ‘আমি কিছুটা অবাক হয়েছি, কারণ আমাদের দেশের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে থাকেন। আমরা আমাদের মধ্যেই কোনো নৈরাজ্য বা অশান্তি চাই না। আমরা খবরগুলো পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি, এগুলো সত্য কিনা।’

শেখ হাসিনার পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টা পর আগন্তুক ঢাকার নবিনবাগ এলাকায় বসবাসকারী হিন্দুদের খোঁজ নিতে যান। সেখানে সবকিছুই শান্ত ছিল। তিনি বলেন, ‘ওই এলাকায় একটি হামলার ঘটনাও ঘটেনি। কয়েক দিন ধরে আমি ওই এলাকার ওপর নজর রাখছি। আমি ওই এলাকায় বসবাসকারী ও দোকানদারদের সঙ্গেও কথা বলেছি। সবকিছু ঠিকঠাক আছে।’

সামাজিক মাধ্যম ও ভারতীয় মূলধারার টিভি চ্যানেলগুলোয় ওই দিন থেকেই হিন্দুদের বাড়ি, মন্দির ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার খবর প্রচারিত হতে থাকে। আগন্তুক তার বিষয়টির ওপর নজর রাখতে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা তার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি তাদের সঙ্গে রোজ যোগাযোগ করতাম। তারা আমাকে জানায়, তারা মন্দিরগুলো পাহারা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা আমাকে জানিয়েছে, কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।’

হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার অল্প সময় পরই উদ্‌যাপনকারীদের একটি অংশ মবে পরিণত হয়। এই মবের দাঙ্গাকারীরা আওয়ামী লীগের দলীয় অফিস এবং হাসিনার পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের সব প্রতীকে হামলা চালায়। এর মধ্যে হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ও তার স্মৃতি জাদুঘরও রয়েছে।

মুসলিম সংখ্যাগুরু বাংলাদেশে হিন্দুরা সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে তাদের সংখ্যা আট শতাংশ। তারা ঐতিহ্যগতভাবেই আওয়ামী লীগের সমর্থক। ফলে তাদের ওপর দাঙ্গাকারীদের ক্ষোভ ছিল।

হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক সপ্তাহ পর হিন্দু এবং অন্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর দুই শতাধিক হামলা হয়। এ হিসাবটি সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের।

তবে হামলার সঠিক সংখ্যা এবং উদ্দেশ্য জানা বেশ কঠিন। ছাত্র আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমনে শক্তি প্রয়োগের জন্য হামলার শিকার হয় পুলিশ। ফলে হাসিনার পতনের পর থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত তারা কর্মবিরতি পালন করে।

হাসিনার পতনের পর পরের কয়েক দিন দেশজুড়ে চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছিল। গুজব ও অনলাইনে বিভ্রান্তিকর তথ্যের জন্য সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে এই আতঙ্ক সন্দেহে পরিণত হয়। বিশেষ করে ফ্যাক্ট চেকাররা যখন দেখান, যেসব হামলার ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করা হচ্ছে তার বেশিরভাগই পুরোনো, নয়তো বট ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি ভারতে ঘটে যাওয়া ঘটনাকেও বাংলাদেশের বলে প্রচার করা হয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে ‘ধর্ম’কে একটি পুরোনো ও ভয়াবহ ফাটল রেখা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় এর কারণে বহু রক্তাক্ত ঘটনা ঘটেছে। আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্র তৈরির পেছনেও এই ধর্মের ভূমিকা রয়েছে। ধর্মের সেই বিষাক্ত চেহারাই আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশি হিন্দুদের আতঙ্ক ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের বন্যার মধ্যে হিন্দু সংখ্যাগুরু ভারতের সঙ্গে নানা মাত্রার কূটনৈতিক সংকট তৈরি হয়। ক্ষমতা, প্রভাব, সম্পদ ও প্রাপ্যতা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে।

হাসিনার পতন দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক খেলার একটি নতুন অংশের ওপর আলো ফেলেছে, যেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে গেছে। তবে এখন বিষয়টিকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশে জেন জি বিপ্লব নামে পরিচিত এই আন্দোলন কূটনৈতিক সম্পর্কের খোলনলচে পাল্টে দিয়েছে।

সবার জন্য ‘বর্ষার বিপ্লব’

এই ব্যাপক মাত্রার সহিংসতা হাসিনার পতনের পরপরই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। নোবেলবিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত তিনি এই পদে থাকবেন।

অলিম্পিক গেমসে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি প্যারিসে অবস্থান করছিলেন। হাসিনার পতনের পরপরই তিনি ঢাকায় ফেরেন। এরপর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিকেই তিনি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন।

সোমবার ড. ইউনূস ঢাকেশ্বরীর জাতীয় মসজিদে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দেশের এই সর্ববৃহৎ হিন্দু মন্দিরে গিয়ে তিনি সংযমের আহ্বান জানান। বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য সম-অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তিনি সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

বহু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও সুশীল সমাজের সদস্য সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় যার যার অবস্থানে থেকে কাজ করেছেন। ইন্সটাগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যম ভরে ওঠে মন্দির পাহারা দেওয়া ছাত্রদের ছবিতে।

ঢাকাভিত্তিক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো শাফকাত মুনির মনে করেন, হাসিনা-পরবর্তী সময়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুত্ববাদ গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হওয়া উচিত।

‘প্রথমত আমরা সংখ্যালঘুদের ওপর কিছু দুর্ভাগ্যজনক হামলা প্রত্যক্ষ করেছি। তবে আমি এও বলব, প্রচুর মিথ্যা তথ্যও এ সময় ছড়িয়েছে। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি ঘটনাও অনেক বড় কিছু। এই আন্দোলনকে আমি বলি বর্ষার বিপ্লব। এটা সব বাংলাদেশির বিপ্লব, তারা যে বিশ্বাসেরই হোন না কেন। কাজেই আমাদের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন তার বা তাদের বিশ্বাসের জন্য আক্রান্ত না হয়।’

হাসিনা বনাম একটি ‘অশান্ত ইসলামপন্থি বাংলাদেশ’

তবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে বহু সংবাদ উপস্থাপন, সম্পাদক ও বিশ্লেষক বাংলাদেশ সরকারের এই আশ্বাসের সঙ্গে একমত নন।

ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যম এখন বাংলাদেশের ইসলামপন্থি দলগুলোর ওপরই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এই সংবাদমাধ্যমগুলোর বেশিরভাগই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারের মুখপাত্র। এই সংবাদমাধ্যমের একটির শিরোনাম ছিল—‘জামায়াতে ইসলামী কী? পাকিস্তান-সমর্থিত এ দলই শেখ হাসিনার সরকারকে টেনে নামিয়েছে’। আরেক সংবাদ মাধ্যমে এক জ্যেষ্ঠ বিজেপি নেতার বরাত দিয়ে জানানো হয়, ‘জামায়াত হয়তো বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নিতে যাচ্ছে।’

বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কখনোই জামায়াতে ইসলামী সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তবে বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে মাঝেমধ্যেই জোট বাঁধে তারা। জামায়াত নামে অধিক পরিচিত এ দলকে ২০২৪ সালের ১ আগস্ট নিষিদ্ধ করা হয়। কোটাবিরোধী আন্দোলনে হতাহতের জন্য বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতকে দায়ী করে এ পদক্ষেপ নেন শেখ হাসিনা।

তবে হতাহতের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে বিএনপি-জামায়াত। এই আন্দোলনেই শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পতন হয়। মঙ্গলবার বাংলাদেশের একটি আদালত হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলার কার্যক্রম শুরু করে। গণ-অসন্তোষের সময় নিহত এক ব্যক্তির স্বজনদের করা এ মামলায় হাসিনা প্রশাসনের আরো ছয় সদস্যেরও নাম রয়েছে।

বাংলাদেশের ছাত্রনেতারা অবশ্য বারবারই সাংবাদিকদের বলছেন, তারা মৌলিক পরিবর্তন চান। তাদের বেশির ভাগেরই দেশের মূলধারার দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ওপর আস্থা নেই।

ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে বিগত দিনে চলে আসা রাজনৈতিক ধারার প্রতি তাদের অনাস্থা প্রকাশ করেছেন।

তবে তাদের বার্তা ভারতীয় বিশ্লেষকদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক ইনস্টিটিউশনের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ‘আমি মনে করি, বহু ভারতীয়র ধারণা, ধর্ম নিরপেক্ষ ও উদার বাংলাদেশ এবং ইসলামি শক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন অস্থিতিশীল বাংলাদেশের মধ্যে বিভাজক রেখাটি হচ্ছেন শেখ হাসিনা।’

সব ডিম শেখ হাসিনার ঝুড়িতে

হাসিনার পতনের পরিস্থিতি তৈরি করতে বহু বছর লেগে গেছে। সরকারি চাকরিতে বিতর্কিত কোটা ব্যবস্থা নিয়ে যে বিক্ষোভ তা তার পতনকে ত্বরান্বিত করেছে। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে চতুর্থবারের মতো জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের এই লৌহমানবীর ব্যাপারে গণ-অসন্তোষ আরো বাড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এই সংসদ নির্বাচনকে ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নয় বলে মন্তব্য করে। তবে আঞ্চলিক দুই শক্তিশালী দেশ ভারত ও চীন তাৎক্ষণিকভাবে ৭৬ বছর বয়সি এই নেতার মন্ত্রিসভাকে অভিনন্দন জানায়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হাসিনার এই জয়ের বিশেষভাবে প্রশংসা করেন, যদিও গবেষণা সংস্থাগুলোর বিবেচনায় এ নির্বাচন ছিল ‘নিষিদ্ধ ও বয়কটের’ ভোট। তবে মোদি সেসব বিশ্লেষণে না গিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জনগণকে অভিনন্দন জানান।

এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে মোদি বলেন, ‘একটি সফল নির্বাচন আয়োজনের জন্য আমি বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানাতে চাই। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে জনগণকেন্দ্রিক সম্পর্ক ও অংশীদারত্ব আরো জোরদার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

যদিও এই বক্তব্য ছিল বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণই ভিন্ন। ‘দ্য কর্নেল হু উড নট রিপেন্ট: দ্য বাংলাদেশ ওয়ার অ্যান্ড ইটস আনকোয়াইট লিগেসি’ শীর্ষক বইয়ের লেখক সলিল ত্রিপাঠি এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘ভারত হাসিনায় অতিরিক্ত বিনিয়োগ করে ফেলেছে। বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ কম।’

‘কাজেই নয়াদিল্লি তার সব ডিম এক ঝুড়িতেই রেখেছিল, ভূ-কৌশলগতভাবে যা একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।’

চীন-ভারতের কূটনৈতিক চাপানউতোর সামাল দেওয়া

কুগেলম্যান মনে করেন, হাসিনা এমন কিছু কূটনৈতিক কৌশল অনুসরণ করে চলছিলেন, যা আঞ্চলিক শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে সন্তুষ্ট রাখতে সক্ষম ছিল।

‘আপনি হাসিনা সম্পর্কে যা খুশি বলতে পারেন। তবে আমি মনে করি, তিনি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের চমৎকার ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে পেরেছেন। ভারতের সঙ্গে তার একটি বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তবে চীনের সঙ্গেও তিনি অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা খাতে সম্পর্ক বাড়িয়েছেন।’

গত বছর মার্চ মাসে হাসিনা বাংলাদেশের কক্সবাজার উপকূলে ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত সাবমেরিন ঘাঁটির উদ্বোধন করেন। এর সম্পূর্ণ অর্থায়ন করে চীন। ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিসের দৃষ্টিতে এটা ছিল সাবমেরিন কূটনীতি।

তবে চীন-ভারতের এই কূটনৈতিক সম্পর্ক সামাল দেওয়াও খুব সহজ কাজ নয়। বাংলাদেশে ১৪ বছর এককভাবে সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী থাকার পরও হাসিনার অবস্থানে কিছুটা ফাটল ধরে।

ভারতের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, আগের মাসে তার চীন সফর পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। সেবার হাসিনার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি বেইজিং। তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীন সফর করেছিলেন হাসিনা। তবে তার সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

হাসিনা তার চীন সফর সংক্ষিপ্ত করে ফেলেন। দেশে গিয়ে সাংবাদিকদের জানান, তিস্তা পানি প্রকল্পের জন্য ভারতের প্রস্তাবই তার বেশি পছন্দ হয়েছে।

বাংলাদেশকে ‘বিক্রি’

ঐতিহাসিকভাবেই দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সুসম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ একসময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হয় তারা। ১৯৪৭ সালে হিন্দু সংখ্যাগুরু ভারত ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে।

বাংলাদেশের জন্ম হয় ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশকে ভারতের সেনাবাহিনী সহায়তা করে।

সত্তরের দশক থেকে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সহযোগিতা পেয়েছে ভারত। সীমান্ত নিয়ে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত ভারতের জন্য একটি নিয়মিত ঘটনা।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষাগত সাদৃশ্য রয়েছে। ভারত বরাবরই তার পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে বেশ মধুর সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।

২০১৪ সালে মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে যায়।

২০১৯ সালে মোদি সরকার একটি বিতর্কিত নাগরিক আইন পাস করে। এই আইনটি মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। বিজেপির নেতারা সব মুসলমানকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে অভিহিত করে। দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে এক নির্বাচনি জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় বাংলাদেশিদের উইপোকা বলেও সম্বোধন করেন।

২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে মোদি ঢাকায় আসেন। এ সময় মোদিবিরোধী বিক্ষোভে ১২ জন নিহত হন, যা হাসিনার প্রশাসনের জন্য চরম বিব্রতকর বিষয় ছিল।

জানুয়ারির নির্বাচনে হাসিনার জয়ের পর বাংলাদেশজুড়ে একটি ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচার শুরু হয়। এই প্রচারের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতীয় পণ্য বর্জন। সামাজিক মাধ্যমে এই প্রচার ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। ঢাকার দোকানদাররা গত ফেব্রুয়ারিতে ভয়েস অব আমেরিকাকে জানান, ভারতের বেশ কিছু পণ্যের বিক্রি পড়ে গেছে।

বহু সমালোচক মনে করেন, হাসিনার জয়ে ভারতের হাত রয়েছে, যদিও তা গোপনে। আবার অনেকে এমনও বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের উদ্বেগ দমাতে নিজের প্রভাব ব্যবহার করেছে ভারত, যদিও ভারত এসব অভিযোগ স্বীকার করেনি।

মোদির মুসলমানবিদ্বেষী অবস্থানের জন্য বাংলাদেশে তার ব্যাপারে ক্ষোভ রয়েছে। তবে তারপরও হাসিনা মোদির সঙ্গে চমৎকারভাবে কাজ করার মতো সম্পর্ক বজায় রেখে চলছিলেন। ভারতে ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিজেপির নেতাদের মুসলমানবিদ্বেষী ও বাংলাদেশি অভিবাসীবিরোধী মন্তব্য বাড়তে থাকলেও হাসিনা এ ব্যাপারে নীরবতা পালন করেন। এ বিষয়টিকে তিনি বরাবরই দেখেছেন ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয় হিসেবে।

অর্থাৎ দুই নেতাই পরস্পরের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণের ঘটনাগুলো এড়িয়ে গেছেন, যা হাসিনা-মোদির সম্পর্কে স্থিতিশীলতা ও গতিশীলতা বাড়িয়েছে।

ঢাকা-দিল্লির মধ্যে এ সময়ে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও বেড়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের সহিংসতা-কবলিত উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো শান্ত হয়েছে।

বেড়েছে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য। ভারতের সহযোগিতায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিও সই হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হাসিনা সরকার ও ভারতের বিলিয়নেয়ার গৌতম আদানির আদানি গ্রুপের মধ্যে সই হওয়া কয়লা চুক্তি। এই গ্রুপের সঙ্গে মোদির বিশেষ সুসম্পর্ক রয়েছে।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে হাসিনাকে তার ২১-২২ জুনের ভারত সফরের প্রসঙ্গ তুলে প্রশ্ন করা হয়—তিনি দেশ ভারতের কাছে বেচে দিয়েছেন কিনা। জবাবে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা দেশ বেচে না।’ তার অতীত ট্র্যাক রেকর্ড ঘেঁটে দেখার জন্য তিনি পরামর্শ দেন।

সংখ্যালঘুদের ঠিক ও বেঠিক

দক্ষিণ এশিয়া-বিষয়ক বিশ্লেষকেরা ভারত প্রসঙ্গে নিয়মিত একটি বিষয় উল্লেখ করেন, ভারত তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ করে। এটা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে তামিলদের প্রসঙ্গ হতে পারে, অথবা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হিন্দু।

তবে ত্রিপাঠি মনে করেন, মোদি প্রশাসনের হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংকল্প ভারতের মূল পররাষ্ট্র নীতিকে বেশ প্রভাবিত করেছে।

তিনি বলেন, ‘হিন্দুদের সঙ্গে বাংলাদেশে কেমন আচরণ করা হয়—বিষয়টি ভারতের জন্য রেড লাইনে পরিণত হয়েছে। তারা এই বিষয়টি নিয়ে এমনভাবে কথা বলে যেন এটাই নয়াদিল্লির দীর্ঘদিনের বৈধ অবস্থান। আমি একটি বিষয় বুঝতে অক্ষম, দিল্লি কী করে তার নিজ দেশের সংখ্যালঘু মুসলিমদের সঙ্গে রাষ্ট্রের আচরণের কথা ভুলে যায়।’

বাংলাদেশি বিশ্লেষকেরাও ভারতের এ অবস্থানের কথা খুব ভালো করে জানেন। তবে এখন তাদের মূল মনোযোগ তাদের দেশের ভবিষ্যতের ওপর। যদিও দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুতর।

মুনির বলেন, বাংলাদেশের জন্য স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক অত্যন্ত জরুরি।

‘বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ভারতের সঙ্গে একটি শক্তিশালী, গঠনমূলক ও উৎপাদনমুখী সম্পর্ক চায়। তারা আমাদের সর্ববৃহৎ প্রতিবেশী এবং ভূরাজনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবেই আমাদের মধ্যে বাস্তবসম্মত ও সক্রিয় সম্পর্ক রয়েছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে এই সম্পর্ক জিম্মি হতে পারে না।’

তিনি আরো যোগ করেন, তবে সেক্ষেত্রে দিল্লিকে অবশ্যই তার বাংলাদেশ নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।

‘ঢাকা সম্পর্কে দিল্লি এক ব্যক্তি বা এক সরকারকেন্দ্রিক যে ধারণা তৈরি করে রেখেছে, তাতে পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। ঢাকাকে এই বার্তা দিল্লির দিতে হবে। বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। তাদের মেনে নিতে হবে, বিপ্লব হয়েছে। তাদের মেনে নিতে হবে, শেখ হাসিনা এখন ইতিহাস।’

এদিকে শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানও ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান হাসিনা।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতের পক্ষে হাসিনার নির্বাসনের অনুরোধটি নাকচ করা সম্ভব ছিল না। কারণ সে ক্ষেত্রে বার্তা দেওয়া হতো যে, বিপদে পড়লে সহযোগীদের সহায়তা করে না দিল্লি।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তি রয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, ঢাকা যদি শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করে, তাহলে ভারতকে এটা মেনে নিতে হবে। অন্যথায় আন্তর্জাতিক একটি চুক্তি ভাঙার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে তারা।

কয়েকজন বিশ্লেষক মনে করেন, হাসিনা সংকটের সবচেয়ে সহজ সমাধান হতে পারে তাকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠিয়ে দেওয়া। এটা উপসাগরীয় কোনো দেশ হতে পারে, যার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো।

তবে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেকেই মনে করেন, দেশে ফিরতে পারেন হাসিনা। আগন্তুকের মতো অনেকেই একে দেখছেন ভীতিকর বিষয় হিসেবে।

‘আমি আমার পরিচয় এখনো প্রকাশ করিনি, কারণ এখনো আমার নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। তবে তার দলের অনেক মানুষ, তার দলের ছাত্র সংগঠনের অনেকে এখনো দেশে। তারা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি। তারা এখনো আমাদের দিকে নজর রাখছেন।’

বাংলাদেশের সামনের পথ বেশ কঠিন। হাসিনার পদত্যাগের ১০ দিন পার হয়ে গেছে। ঢাকার পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক নয়। বৃহস্পতিবার ছিল ১৫ আগস্ট। ১৯৭১ সালের এই দিনেই এক সামরিক অভ্যুত্থানে হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন।

ঢাকায় ওই দিন হাজারো ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীরা বাঁশের লাঠি, লোহার রড ও পাইপ হাতে শেখ মুজিবের সাবেক বাসভবনে যেতে হাসিনার সমর্থকদের বাধা দেন।

বিপ্লবের পর রক্তাক্ত প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা রয়ে যায়। অনেক সময় মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের মতো যেসব আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিপ্লব ঘটানো হয়েছিল, তা পূরণ হতেও লম্বা সময় লেগে যায়।

তবে আগন্তুক বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ছাত্রদের একটি উজ্জ্বল ও কল্যাণকর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করাই ছিল এই বিক্ষোভের মূল উদ্দেশ্য। আমরা আশাবাদী। বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা নিয়ে আমরা এই আশাবাদ ধরে রাখব। আমরা সবাই আমাদের উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের অপেক্ষায় আছি।’

নিবন্ধটি ফ্রান্স ২৪-এ ‘ইন্ডিয়া ওভার ইনভেস্টেড ইন হাসিনা অ্যান্ড আন্ডার-ইনভেস্টেড ইন বাংলাদেশ—অ্যান্ড ইজ নাউ প্যানিকিং’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়

সূত্র, আমার দেশ