‘এনিমি’জ এনিমি ইজ মাই ফ্রেন্ড’শত্রুর শ্রত্রু আমার বন্ধু বলে একটি প্রবাদ আছে। সরল অর্থে, আমার শত্রু তুমি, তোমার শত্রু আমার বন্ধু। বর্তমান বিশ্বে বাণিজ্যিক কূটনৈতিক রাজনীতিতে প্রভাবশালী দেশসহ প্রায় প্রত্যেক দেশই এ নীতি নিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নিচ্ছে। যে বন্ধু রাষ্ট্র, তার সাথে পারস্পরিক স্বার্থের সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকে। আবার এ কথাও মেনে চলা হচ্ছে, ‘চির শত্রুতা বলে কিছু নেই, শত্রুতা ক্ষণস্থায়ী, স্বার্থ চিরস্থায়ী।’ এক সময়ের চিরশত্রুও সময় পরিক্রমায় পারস্পরিক স্বার্থের কারণে সুসম্পর্ক স্থাপন করে। বর্তমান বিশ্বে এ নীতি নিয়েই প্রত্যেক দেশ স্ব স্ব অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আমরা দেখেছি, ¯œায়ুযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া হুমকি-ধমকি ও অস্ত্রের ঝনঝনানি দিয়ে পরস্পরকে শত্রু বিবেচনা করত। দুই দেশই বিশ্বে বিভক্তি সৃষ্টি করে অন্যান্য দেশকে তাদের পক্ষে টানত। সেই যুদ্ধের অবসান হয়ে এখন দুই দেশই পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাছাকাছি এসেছে। তবে এটাও সত্য, তারা তাদের মিত্র দেশগুলোকে নিজস্ব ব্লকে রেখেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের চিরশত্রু উত্তর কোরিয়া এবং প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা চীন ও রাশিয়ার রাষ্ট্র প্রধানরা একসঙ্গে বসেছেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের টেনশন বেড়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো বলেই ফেলেছেন, এই তিন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণও রয়েছে। পরাশক্তির অধিকারি তিনটি দেশ যখন এক হওয়া বা জোটবদ্ধ হওয়ার ইঙ্গিত দেয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগেরই বিষয়। তারা কেন এক হলো? এ প্রশ্ন এসে যায়। এর উত্তরে বলা যায়, বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া মাতব্বরির রাস টেনে ধরার জন্যই তারা একসাথে কাজ করার ইশারা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ট্রাম্পের শুল্কারোপ নীতি ঠেকাতেই সম্ভবত পরাশক্তির এই তিন দেশ পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই তিন দেশের সমন্বিত পারমানবিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বহুগুণে বেশি। তার জন্য থ্রেটও বটে। অনুমান করা যায়, তারা এটা করতে যাচ্ছে, ট্রাম্পের মনোপলি বা একচেটিয়া বাণিজ্য যুদ্ধের প্রতি-উত্তরে। এই তিন দেশের সাথে ভারতেরও যুক্ত হওয়া বা সমর্থন দেয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যদিও চীন ভারতের চিরশত্রু, তারপরও তার স্বার্থের জন্য চীনের সাথে দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ঘনিষ্ট মিত্র হয়ে ওঠা ভারত ট্রাম্পের শুল্কারোপ নীতিতে ভীষণ ক্ষুদ্ধ এবং তা সামাল দিতে সে চীনের সাথে শত্রুতা কমিয়ে ঘনিষ্ট হওয়ার পথে রয়েছে। ভারতের একজন পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, চির শত্রুতা অস্থায়ী, স্বার্থ চিরস্থায়ী। এ থেকে বোঝা যায়, দেশটি চীনের সাথে নিজ স্বার্থে সুসম্পর্ক গড়তে চায়।
দুই.
এসব কথা বলার কারণ হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ থেকে। উভয় দেশই পারস্পরিক স্বার্থে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। হাসিনা বিগত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধোঁয়া তুলে ভারতের এজেন্ডা অনুযায়ী পাকিস্তানকে শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দেশটিকে বাংলাদেশের ‘কমন এনিমি’তে পরিণত করে। উদার কূটনীতির অংশ হিসেবে পাকিস্তানের সাথে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। এর মূল কারণ, পাকিস্তান ভারতের চিরশত্রু। এই চির শত্রুকে ভারতের দাসী হাসিনা বাংলাদেশেরও চিরশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছিলো। ভারতের ‘কমন এনিমি’কে বাংলাদেশেরও ‘কমন এনিমি’তে পরিণত করে, যা আমাদের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি ‘কারো সাথে শত্রুতা নয়, প্রত্যেকের সাথে বন্ধুত্বে’র খেলাপ। হাসিনা দীর্ঘ দেড় দশক ধরে আমাদের এই উদার কূটনীতিকে ভারতের কাছে বন্ধক দিয়ে রেখেছিলো। তার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়ে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। বিগত প্রায় একযুগের অধিক সময়ের মধ্যে গত ২৩ আগস্ট পাকিস্তানের কোনো শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বাংলাদেশে দুই দিনের সফরে আসেন। তার দুই দিন আগে দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী সফর করেন। তার আগে পররাষ্ট্রসচিব সফর করেছিলেন। দুই দিনের সফরে বিমানবন্দরে পা রেখেই ইসহাক দার ঢাকা সফরকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এ সফর পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের ‘নতুন অধ্যায়ে’র সূচনার পাশাপাশি দুই দেশের অংশীদারত্বে নতুনভাবে প্রাণ সঞ্চার করবে। তিনি মনে করেন, দুই দেশের সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। গত এক বছরে দুই দেশের স¤পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের পদক্ষেপের প্রতি ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছে। ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু কৃত্রিম বাধা ছিল, যা দূর করা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, গভীর সংলাপের জন্য একটি কাঠামো দরকার, যেখানে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে ভুল-বোঝাবুঝি দূর করা যেতে পারে। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আইজাজ চৌধুরী একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে বলেছেন, ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদ ও ঢাকার যৌথ অসন্তোষ রয়েছে। উভয়ের এ অসন্তোষই তাদের সম্পর্কের পুনঃস্থাপনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি বলেছেন, ভারতের আধিপত্যবাদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে। পাকিস্তানেরও রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দুই দেশই দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টি বুঝতে পারছে। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের অতীত নিয়ে কিছু সমস্যা আছে। সেগুলো দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করা সম্ভব এবং তা বাধা হয়ে থাকা উচিৎ নয়। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মনে করেন, পাকিস্তানের জনগণ ১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মতোই ব্যথিত। আমি মনে করি, এ ব্যথা দূর করে উভয় দেশের মানুষই এখন এগিয়ে যেতে চায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান বিশ্ববাণিজ্য যুদ্ধে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। পারস্পরিক স্বার্থে শত্রু দেশের সাথেও ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতে হয়। চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যতই শত্রু ভাবাপন্ন মনোভাব থাকুক না কেন, বানিজ্যিক সম্পর্ক তাদের পারস্পরিক স্বার্থ বজায় রেখেই চলছে। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক স¤পর্ক গড়ে তুলতে পারলে দুই দেশই উপকৃত হবে, যদিও দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য খুব একটা বড় নয়। ২০২৪ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে ৬৬ কোটি ১০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। একই সময়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানে মাত্র ৫ কোটি ৭ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। তবে বাংলাদেশ এ রপ্তানি বাড়াতে পারে। বাংলাদেশ পাট ও পাটজাত পণ্য, ওষুধ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বা জীবাণুনাশক তরল, রাসায়নিক এবং তামাকজাত পণ্য রপ্তানি বাড়াতে পারে। বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে তুলা ও বস্ত্রজাত পণ্য, চাল, সিমেন্ট, ফল এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য আমদানি করে উপকৃত হতে পারে। যদি দুই দেশ বাণিজ্য সম্পর্কের পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করে, তাহলে উভয় দেশ পর¯পরের কাছ থেকে সুবিধা নিতে পারবে। কাঁচামালের উৎস এবং বাজার সম্প্রসারণসহ উভয় দিক থেকে দুই দেশের সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি, যা পশ্চিম ইউরোপের জনসংখ্যার দ্বিগুণের বেশি। ফলে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে উভয় দেশের জন্য এটি একটি বড় বাজার হতে পারে। এ বাজার বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, পাকিস্তান মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে প্রবেশ দ্বার হিসেবে বিবেচিত। পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলে, বাংলাদেশের পণ্যের বাজার মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।
তিন.
বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার ক্ষেত্রে বরাবরই ’৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের ওপর চালানো পাকিস্তানের গণহত্যার বিষয়টি সামনে এসেছে। এই গণহত্যার জন্য বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। অথচ পাকিস্তান বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠানিকভাবে তিনবার ক্ষমা চেয়েছে বলে সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ায় তুলে ধরা হয়েছে। এ বছরের ১৬ এপ্রিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমানা বেলুচ বাংলাদেশ সফরে এলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিনটি ইস্যুর নিস্পত্তি হলে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের স¤পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে বলে এক ধরনের শর্ত দেয়া হয়। এই তিনটি ইস্যু হচ্ছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে অফিসিয়ালি ক্ষমা চাইতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে বসবাসরত বিহারিদের পাকিস্তানে ফেরত নিতে হবে। তৃতীয়ত, পাকিস্তানের অংশ থাকাকালে পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের যে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার পাওনা আছে, তা পরিশোধ করতে হবে। প্রথম শর্তের বিবেচনায় দেখা যায়, পাকিস্তান পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের কাছে তিনবার ক্ষমা চেয়েছে। প্রথমবার ক্ষমা চেয়েছে ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল, দ্বিতীয়বার একই বছরের ২৯ জুন এবং তৃতীয়বার ২০০২ সালে। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিলের এক চুক্তির অংশ হিসেবে ইসলামাবাদ জানিয়েছিল, বাংলাদেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকলে পাকিস্তান তার নিন্দা করছে এবং গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে। চুক্তিতে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা স্বাক্ষর করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আটক ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে মুক্তি দেয়া হয়। চুক্তির অংশ হিসেবে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, অতীতের ভুলগুলোকে ভুলে গিয়ে ক্ষমা করে দিন। ১১ এপ্রিল ১৯৭৪ দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে। ওই বছরের জুনে জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এসে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চালানো নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনায় তওবা বা অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, আমরা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তওবা (অনুশোচনা) করছি।’ ২৯ জুন ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যে লজ্জাজনক দমননীতি ও অকথ্য অপরাধ চালিয়েছিল তার জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করছেন। সর্বশেষ পাকিস্তান সরকার ক্ষমা চেয়েছিল ২০০২ সালে যখন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফ বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনের সময় দর্শনার্থী বইতে লিখেন, ১৯৭১ সালের ঘটনার কষ্ট পাকিস্তানের ভাই-বোনরাও অনুভব করে। সেই দুর্ভাগ্যজনক সময়ে সংঘটিত ঘটনাবলির জন্য আমরা দুঃখিত। পাকিস্তানের কোনো সেনাশাসকের পক্ষ থেকে এটাই ছিল প্রথম অনুশোচনা প্রকাশ করা। প্রশ্ন হচ্ছে, পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান ক্ষমা চাইলেও তা কেন দেশের মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়নি কিংবা জানতে দেয়া হয়নি? এর কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না। ভারত তার স্বার্থে এবং আওয়ামী লীগ তার দাসত্ব মেনে ক্ষমতায় থাকতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উসিলা করে পাকিস্তানকে চিরশত্রু বানিয়ে রেখেছিল। পাকিস্তান ক্ষমা চাওয়া সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশকে তার করদরাজ্যে পরিণত করে খবরদারি করার জন্যই আওয়ামী লীগকে দিয়ে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে দেয়নি। পাকিস্তানকে বাংলাদেশের ‘কমন এনিমি’ বানিয়ে রেখেছিল। যেমন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে খবরদারি করতে কোনো কোনো রাষ্ট্রকে অপবাদ দিয়ে তার শত্রু রাষ্ট্র বানিয়ে রাখে। উত্তর কোরিয়া, ইরান, রাশিয়া ও চীনকে সে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শত্রু রাষ্ট্র বানিয়েছে। এর কারণ, তার শত্রু না থাকলে, তার আধিপত্য বা ক্ষমতা দেখানোরও সুযোগ থাকে না। বিভিন্ন দেশকে তার শত্রু গণ্য করে যুদ্ধ না বাঁধালে তার অস্ত্র বিক্রি হবে না। আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো মিলে কীভাবে বিপদগামী কিছু মুসলমানকে দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে মুসলমানদের জঙ্গী ও সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত করার প্রয়াস চালিয়েছে। পাশাপাশি তা দমনের নামে অনন্ত যুদ্ধের সূচনা করে খবরদারি করেছে এবং ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে, সম্পদ লুট করেছে। তাদের এই মিথ্যা অপবাদ শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকেনি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র অনন্ত যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। এখন তার মোড়লগিরির জন্য নতুন শত্রু প্রয়োজন। ভারতও ঠিক একইভাবে তার প্রতিবেশিদের ওপর খবরদারি চালিয়ে নিজেকে মাতব্বরে পরিণত করেছিল। সে তার চিরশত্রু পাকিস্তানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উসিলা দিয়ে আওয়ামী লীগকে দিয়ে বাংলাদেশেরও চিরশত্রুতে পরিণত করে রেখেছিল। অথচ বিশ্বে পারস্পরিক স্বার্থে চিরশত্রু বলে কিছু নেই, চিরস্বার্থ রয়েছে। ভারত তো এখন তার বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের ঠেলায় পড়ে তার চিরশত্রু চীনের সাথে ভালো সম্পর্ক করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পাকিস্তানের সাথে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে না? বিশ্ব বাস্তবতায় এ ধরনের মনোভাব ধরে রাখার কোনো যুক্তি নেই। একটা সময় ব্রিটেন উপমহাদেশে দুইশ’ বছর রাজত্ব করেছে। স্বাধীনতার জন্য তার বিরুদ্ধে তো কম যুদ্ধ হয়নি। যুদ্ধে তাকে পরাস্তও করা যায়নি। নিজ থেকেই চলে গেছে। উপমহাদেশের দেশগুলোর কাছে তো বৃটেন চিরশত্রু হওয়ার কথা। সেটা কি হয়েছে? হয়নি। উল্টো বৃটেনের সাথে সুসম্পর্ক রাখার জন্য প্রত্যেক দেশই ব্যাকুল হয়েছে এবং সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে। দেশটিতে যাওয়ার জন্য উপমহাদেশের নাগরিকরা উন্মুখ হয়ে থাকে। ’৭১-এ পাকিস্তান গণহত্যা চালিয়ে নিশ্চয়ই অন্যায় ও অপরাধ করেছে। সেজন্য ক্ষমাও চেয়েছে। ফলে পারস্পরিক স্বার্থে তার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে বাধা থাকার কথা নয়।
চার.
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানকে যতটা না শত্রু মনে করেছে, তার চেয়ে বেশি শত্রু মনে করে আসছে ভারতকে। মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী স্বাধীনতার পরপরই বলেছিলেন, ‘পিন্ডির গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি দিল্লির দাসত্ব করার জন্য নয়।’ কথাটি তো তিনি এমনি এমনি বলেননি। স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত বাংলাদেশকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিগত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে দিয়ে বাংলাদেশকে করদরাজ্যে পরিণত করেছিল। ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে হাসিনা ও তার প্রভু ভারতকে খেদিয়ে দিল্লীর জিঞ্জির ছিন্ন করেছে। নতুন প্রজন্মও ভাসানীর সেই শ্লোগান এখন দিচ্ছে। তবে বাংলাদেশকে নিয়ে সময়োপযোগী গুরুত্বপূর্ণ শ্লোগানটি দিয়েছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, ‘দিল্লী নয় পিন্ডি নয়, সবার আগে বাংলাদেশ।’ মূলত এই শ্লোগানই হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। স্বাধীন বাংলাদেশ কারো গোলামি করবে না, আবার কারো সাথে শত্রুতাও করবে না। সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে স্বাধীনসত্তা নিয়ে এগিয়ে যাবে।