১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট : এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। সেই দিন ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। এই দিন গুলিকে ঘিরে বছরের পর বছর যে চিত্রটি জনমানসে গেঁথে গেছে, তা হলো মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের বিজয়গাথা, নেহরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা, কিংবা জিন্নাহর পাকিস্তান সৃষ্টির ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কিন্তু এই প্রচলিত ইতিহাসের ছায়ার আড়ালে রয়েছে এক বিস্মৃত অধ্যায়, ১৯৪৬ সালের রাজকীয় ভারতীয় নৌবাহিনীর অভ্যুত্থান, যেখানে মাত্র ১১ জন সাহসী নাবিকের নেতৃত্বে শুরু হয় এক নৌসামরিক বিদ্রোহ, যা অনেক বিশ্লেষকের মতে ছিল উপমহাদেশের প্রকৃত মুক্তিযাত্রার সূচনা।
১১ জন নাবিকের নেতৃত্বে বিদ্রোহের বিস্তার
১৯৪৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। তৎকালীন বোম্বে শহরের রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভির (RIN) সিগন্যাল প্রশিক্ষণ জাহাজ ‘তলোয়ার’-এ শুরু হয় এক ইতিহাস-ঘটানো বিদ্রোহ, সিনিয়র সিগন্যালম্যান এম এস খান ও টেলিগ্রাফার মদন সিংয়ের নেতৃত্বে ১১ জন নাবিক নিজেদের ‘স্ট্রাইক কমিটি’ গঠন করেন। ধর্মঘট কমিটির মূল স্লোগান ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘ভারতবাসী এক হও’ ও ‘ব্রিটিশ গেট আউট’। বিদ্রোহ শুরু হওয়ার মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে করাচি, বিশাখাপত্তনম, মাদ্রাজ, কলকাতাসহ ৭৮টি জাহাজ ও ২০টি স্থলঘাঁটিতে। প্রায় ২০ হাজার নাবিক এই আন্দোলনে যোগ দেন। বোম্বেতে আন্দোলনরত নাবিকদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন শহরের বেসামরিক শ্রমিক, রেলকর্মী, মিলশ্রমিক ও সাধারণ মানুষ। কয়েক দিনেই শহরে গণআন্দোলনের রূপ নেয় এই বিদ্রোহ। বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এই বিদ্রোহ শুধু একটি সাময়িক বিক্ষোভ ছিল না, এটি ছিল আত্মমর্যাদা, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় ঐক্যের এক জ্বলন্ত বহিঃপ্রকাশ, যেখানে পরিচয়ের একমাত্র মানদণ্ড ছিল দেশপ্রেম।
এই বিদ্রোহের আদর্শিক উৎসস্থল ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর চিন্তা ও চেতনা। বাঙালি এই বিপ্লবী নেতা আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক হিসেবে শুধু অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি, তিনি ভারতীয় সেনা ও নৌবাহিনীর মধ্যে আত্মমর্যাদা এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের বীজ বপন করেন তার রেডিও বার্তা, ভাষণ ও রাজনৈতিক দর্শনের মাধ্যমে। ‘চলো দিল্লি’ স্লোগানে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের ব্রিটিশ আদালতে বিচার চলাকালে পুরো দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে, যা পরবর্তী বছর রূপ নেয় নৌ-বিদ্রোহে।
এই বিদ্রোহ নেতাজির ভাবাদর্শের এমন এক জীবন্ত রূপ ছিল যে, অনেকেই একে তার ‘মরণোত্তর বিজয়’ (Posthumous Victory) হিসেবে বর্ণনা করেন, যেখানে শারীরিকভাবে অনুপস্থিত নেতাজি তার চেতনার মধ্য দিয়ে ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে ব্রিটিশবিরোধী এক ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র অভ্যুত্থানে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার উপলব্ধি
নেতাজি ও এই নৌ-বিদ্রোহকে ঘিরে ইতিহাস নতুন করে চর্চিত হচ্ছে সাম্প্রতিক বছরগুলোয়। ২০২৩ সালের ১৭ জুন অত্যন্ত প্রভাবশালী ভারতের বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এক বক্তৃতায় বলেন, ‘যদি নেতাজি বেঁচে থাকতেন, দেশ বিভক্ত হতো না। এমনকি জিন্নাহ নিজেও তার নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আজাদ হিন্দ ফৌজের’ (Indian National Army বা INA) প্রভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে মানসিক বিপ্লব শুরু হয়, যার চূড়ান্ত রূপ ছিল ১৯৪৬ সালের নৌ-বিদ্রোহ।’ ব্রিটিশরা তখন বুঝতে পারে, ভারতীয় বাহিনীর আনুগত্য আর ধরে রাখা সম্ভব নয়। গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের তুলনায় এই সামরিক বিদ্রোহ ব্রিটিশদের মনোবলে অনেক গভীর আঘাত হানে। ফলে, ‘ভারত শাসন’ আর কৌশলগতভাবে টেকসই নয়, এই বাস্তবতা থেকেই দ্রুত স্বাধীনতা প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এখন যখন অজিতই নেতাজি ও নৌ-বিদ্রোহকে স্বাধীনতার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে তুলে ধরেন, তখন সেই পুরোনো আলাপ নতুন তাৎপর্য পায়।
একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি ও উপলব্ধি
২০০৪ সালে ঢাকায় একটি দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা বৈঠকে আমার সাক্ষাৎ হয় সেই অজিত ডোভালের সঙ্গেই। তিনি তখন ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর পরিচালক। আলোচনার একপর্যায়ে তিনি উলফার (ULFA) কিছু নেতার একটি তালিকা আমাদের হাতে তুলে দেন এবং অভিযোগ তোলেন, বাংলাদেশ তাদের লুকিয়ে রাখছে। আমি পাল্টা যুক্তি দিই যে, ভারতেরই কিছু কর্মকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাকে স্মরণ করিয়ে দিই, কীভাবে ভারতের সহায়তায় শান্তিবাহিনী চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল এবং আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। অজিত ডোভাল খুব মনোযোগ সহকারে আমার কথা শুনেছিলেন। আলোচনা তেমন এগোয়নি, কারণ আমরা উভয়েই আমাদের অবস্থানে অটল ছিলাম। তিনি হয়তো সেদিন আমাদের কাছ থেকে সেভাবে কিছু আদায় করতে পারেননি, যেমনটি তিনি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের একটি সরকারের আমলে করতে সক্ষম হন, যখন মোদি সরকারের সময়ে ১০ বছর অবসর গ্রহণের পর নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদমর্যাদায় ২০১৪ সালে ফের নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তবে আমার কাছে তার ব্যক্তিত্ব ধীর ও বিচক্ষণ মনে হয়েছিল, একজন গোয়েন্দাপ্রধানের তুলনায় বরং একজন পরিপক্ব কূটনীতিকের মতো। কিন্তু অনেক বছর পর যখন তিনি বলেন, ‘নেতাজি থাকলে ভারত ভাগ হতো না’, ও নৌ-বিদ্রোহকে স্বাধীনতার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে তুলে ধরেন, তখন আমি বুঝি, তার চিন্তা শুধুই নিরাপত্তা নয়, তিনি ইতিহাস ও ভূরাজনীতির বৃহৎ চিত্রও ভাবেন। তার সেই মন্তব্যকে আমি দেখি ইতিহাসের বিকল্প পাঠ গঠনের কৌশল হিসেবে, যেখানে গান্ধী নয়, বরং নেতাজির মদতপুষ্ট সামরিক বিদ্রোহই ছিল স্বাধীনতার আসল সূচনা।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির স্বীকারোক্তি
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ বিস্মৃত তথ্য হলো, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলির ১৯৫৬ সালের কলকাতা সফরের সময় দেওয়া বক্তব্য। তিনি বলেন, ‘ভারত ছাড়ার পেছনে গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ ও ১৯৪৬ সালের নৌ-বিদ্রোহ।’
এই বক্তব্য শুধু মৌখিক ছিল না, ব্রিটিশ প্রশাসনিক দলিল, গোয়েন্দা রিপোর্ট, এমনকি উইনস্টন চার্চিলের ব্যক্তিগত নথিপত্রেও এই মূল্যায়নের প্রতিফলন দেখা যায়। এমনকি অ্যাডমিরাল লর্ড মাউন্টব্যাটেন, যিনি স্বাধীনতা হস্তান্তরের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন, তিনিও স্বীকার করেন ‘ব্রিটিশরা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের চেয়ে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর বিদ্রোহকে ভয় পেয়েছিল।’ নৌ-বিদ্রোহের মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরই মার্চ ১৯৪৬-এ ব্রিটিশ সরকার ‘কেবিনেট মিশন’ পাঠায় ভারত ভাগ ও স্বাধীনতার আলোচনার জন্য। এই বিদ্রোহই ব্রিটিশ সরকারকে ত্বরান্বিত করে স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনায় বসতে। সুভাষ বসু এবং তার অনুগামী সশস্ত্র বাহিনীর ভয় ব্রিটিশ প্রশাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। অথচ দুঃখজনকভাবে এই অনন্য দৃষ্টিকোণটি আজও ভারতের মূলধারার পাঠ্যপুস্তকে প্রায় অনুপস্থিত। স্বাধীনতার বর্ণনায় সৈনিক ও বিদ্রোহীদের অবদান যেন নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে।
কাকে বলা হবে প্রকৃত ‘স্বাধীনতার স্থপতি’?
১৪ ও ১৫ আগস্ট ২০২৫—ভারত ও পাকিস্তান তাদের ৭৮তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছে। এই প্রেক্ষাপটে সময় এসেছে ইতিহাসকে নতুন চোখে দেখার। স্বাধীনতার পথ শুধু অহিংস আন্দোলন কিংবা কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; সশস্ত্র বিদ্রোহ, আত্মত্যাগ ও সৈনিক প্রতিবাদও ছিল এর অবিচ্ছেদ্য অংশ।
১৯৪৬ সালের রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভির নৌ-বিদ্রোহ ছিল সেই চূড়ান্ত ধাক্কা, যা ব্রিটিশদের স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিল, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী আর তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। মাত্র ১১ জন নাবিকের নেতৃত্বে, ২০,০০০ বিদ্রোহী ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানে বন্দর কাঁপিয়ে তুলেছিল আর তখনই উপমহাদেশের স্বাধীনতার ঘড়ি বেজে উঠেছিল। বাঙালি নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর ভাবাদর্শ, আজাদ হিন্দ ফৌজের আত্মত্যাগ এবং এই নৌ-বিদ্রোহ—সবকিছু মিলিয়ে নির্মিত হয় এক বিকল্প মুক্তির ইতিহাস। সেই ইতিহাসে প্রশ্ন উঠে আসে, কে সত্যিই উপমহাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল? গান্ধী না নেতাজি? অহিংসতা না বিদ্রোহ?
হয়তো এখনই সময় নতুন প্রজন্মকে শেখানোর, ‘জাতির পিতা’ (Founding Father) নয়, ছিল একাধিক ‘স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠাতাশক্তি’ (Founding Forces)। আর সেই শক্তিগুলোর অন্যতম ছিল ১৯৪৬ সালের নৌ-বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ শুধু একটি সামরিক বিক্ষোভ ছিল না; এটি ছিল উপমহাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত সূচনাবিন্দু, এক প্রতীকী ঘুসি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বুকে। ইতিহাস হয়তো মুখে মুখে গান গায় অহিংসতার, কিন্তু বাস্তবতা বলে, যেসব রণাঙ্গনের বারুদের গন্ধ ব্রিটিশদের কাঁপিয়ে তুলেছিল, তাদের মধ্যে নৌ-বিদ্রোহ ছিল অনন্য। নৌ-বিদ্রোহ একটি প্রশ্ন তোলে, কে ছিল সত্যিকারের স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক? যারা আলোচনার টেবিলে বসেছিল, নাকি যারা হাতে অস্ত্র নিয়ে ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে দিয়েছিল?
লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য বিইউপি