গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিছু গুণগত পরিবর্তন আসবে বলে অনেকে আশা করেছিলেন। শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা গত দেড় দশকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে সব ধরনের চেষ্টা করে গেছেন—গুম, খুন ও মিথ্যা অভিযোগে বছরের পর বছর জেলে আটকে রাখা, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের সব কাজ করে গেছেন। এ ছাড়া বিরোধী দলের বহু প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো মামলা দিয়েছেন, যার উদ্দেশ্য ছিল সমাজে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করা। এর পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের নানাভাবে প্রতিনিয়ত চরিত্র হনন করে গেছেন। তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নিয়ে এমন কোনো নোংরা আক্রমণ নেই, যা তিনি করেননি। এমনকি তিনি বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে শুধু নোংরা কথাই বলেননি, তার মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করেছেন।

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনে এক সংবর্ধনা সভায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “খালেদা জিয়ার বয়স এখন আশির ওপরে। রোজই শুনি, ‘এই মরে-মরে, এই যায়-যায়।’ বয়স তো আশির ওপরে। এমনিই তো সময় হয়ে গেছে, তার মধ্যে অসুস্থ। এখন এত কান্নাকাটি করে তো লাভ নেই।” তিনি আরো বলেছিলেন, “খালেদা জিয়া কারাগারে ‘আরাম-আয়েশে থাকলেও’ মামলার তারিখ পড়লেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। আদালতের তারিখ চলে গেলেই তিনি ‘ভালো’ হয়ে যান।”

খালেদ জিয়া সম্পর্কে শেখ হাসিনার এমন নিষ্ঠুর ও অশালীন বক্তব্য শুধু বিএনপি নেতাকর্মীদের নয়, দেশের সাধারণ মানুষকেও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর এই পরিণতির জন্য তার প্রধান শত্রু ছিল নিজের মুখ; কারণ তিনি তার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি।

শেখ হাসিনার এই পতন শুধু আওয়ামী লীগ নয়, সব রাজনৈতিক দলের জন্য একটি শিক্ষার বিষয়। সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের কথা থেকে সেই দলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রভাববিস্তার করে থাকেন। একজন নেতা যে ভাষায় কথা বলেন, কর্মীরা সেভাবে তাকে অনুসরণ করেন।

দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, হাসিনার পতন থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের কথার মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। কিছুদিন থেকে দেশের প্রধান ও বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির অনেক নেতা যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। বিএনপির কেন্দ্র থেকে কয়েকজন নেতাকে সতর্ক করা হলেও চরিত্রহনন ও ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বক্তব্য দেওয়া থামছে না। অথচ বিএনপির নেতারা ছিলেন হাসিনার নোংরা কথার আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু।

কয়েকটি উদাহরন দেয়া যাক। শামসুজ্জামান দুদু দলের ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি এনসিপি নেতাদের প্রস্রাব করে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার বাসায় কে যান, কীভাবে যান, তা উল্লেখ করে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। আবার দলের আরেক ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু প্রধান উপদেষ্টার ধর্ম পালন, বিয়ে নিয়ে বিদ্রুপাত্নক মন্তব্য করেছেন। বিএনপির আরেক তরুণ নেতা রুমিন ফারহানা ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বাংলাদেশবিরোধী যেসব ভুয়া তথ্য ভারতীয় মিডিয়া সর্বক্ষণ প্রচার করে থাকে তিনি তাতে সমর্থন দিয়েছেন। তিনি এমনও বক্তব্য দিয়েছেন যে, প্রধান উপদেষ্টা সস্তা নাটক করেছেন।

নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণাকে কেন্দ্র করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দলের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির একটি অবস্থান আছে। দলটি চায় চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হোক। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির এই চাওয়া অসংগত নয়, কারণ এটি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হবে এবং সরকার গঠন করবে। যে দল জানে বিজয় নিশ্চিত, সে দলের নেতাদের দ্রুত নির্বাচন চাওয়া খুব স্বাভাবিক বিষয়।

অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপির এই দাবি নাকচ করে দিয়ে আগামী বছরের এপ্রিলে জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করেছে, যা নিয়ে বিএনপি আপত্তি জানিয়েছে। আবার কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রধান উপদেষ্টার সময়সীমাকে স্বাগত জানিয়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সময়সীমাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির শেষে নির্বাচন হলে ভালো হতো। অর্থাৎ নির্বাচন নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য নেই।

প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে এপ্রিলে সময়সীমা দেওয়ার পেছনে তিনি তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে বলেছেন, ‘সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি ম্যানডেটের ভিত্তিতে আমরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম। সে বিবেচনায় আগামী রোজার ঈদের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে আমরা একটি গ্রহণযোগ্য জায়গায় পৌঁছতে পারব বলে বিশ্বাস করি। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, যা কি না জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি আমাদের সম্মিলিত দায়, সে বিষয়ে আমরা দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পারব।’

প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংস্কার ও বিচারের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কেন এপ্রিলের সময়সীমা, তার ব্যাখ্যা এখান থেকে পাওয়া যায়। বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল থেকে অভিযোগ করা হয়েছে—এপ্রিলে কেন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা দেওয়া হলো, তার কোনো ব্যাখ্যা প্রধান উপদেষ্টা দিতে পারেননি।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক হয়েছে। সে বৈঠক শেষে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রধান উপদেষ্টাকে ব্যক্তিগত আক্রমণের প্রবণতা ছিল। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ভাষণে (প্রধান উপদেষ্টা) তিনি শব্দচয়নে রাজনৈতিক ভব্যতার সীমা অতিক্রম করায় সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।’

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে কোথায় ভব্যতার সীমা অতিক্রম করা হয়েছে, তা সুস্পষ্টভাবে বিএনপির বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে লক্ষ করে আক্রমণাত্মক শব্দ প্রয়োগ করেছেন, এমনটা তার ভাষণে খুঁজে পাওয়া যায়নি; বরং দুনিয়াজুড়ে একজন মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুনাম আছে। কিন্তু বিএনপি কেন তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে প্রধান উপদেষ্টা তার এই ভাষণে আগামী নির্বাচনে ভোটারদের কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি ভোটারদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনারা সব রাজনৈতিক দল এবং আপনাদের এলাকার প্রার্থীদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন যেন আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনেই যেসব সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে, তা কোনো ধরনের কাটাছেঁড়া ছাড়াই যেন তারা অনুমোদন করেন।

আপনারা ওয়াদা আদায় করে নেবেন যেন তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে কখনো কোনো ধরনের আপস করবেন না এবং দেশের বাইরের কোনো শক্তির কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেবেন না।’

তিনি ভোটারদের উদ্দেশে আরো বলেছেন, ‘আপনারা তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেবেন এই মর্মে যে, তারা কখনোই কোনো অবস্থাতেই আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করবেন না। আপনারা তাদের কাছে অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন যে, তারা সম্পূর্ণ সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবেন এবং সব ধরনের দুর্নীতি, দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেটবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রভৃতি গণবিরোধী কাজ থেকে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখবেন।’

তিনি ভোটারদের স্মরণ করে দিয়েছেন, “এবারের নির্বাচন শুধু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার বিষয় নয়, এটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা—‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার নির্বাচন। এই নির্বাচনে পরিচিত দলগুলোই থাকবে। তাদের পরিচিত মার্কাগুলোই থাকবে। কিন্তু ভোটারকে বের করে আনতে হবে যে, এই মার্কার পেছনে আপনার কাছে ভোটপ্রার্থীরা কে কতটুকু ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার জন্য প্রস্তুত, কে কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”

পুরোনো ধাঁচে চলা যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য প্রধান উপদেষ্টার এসব আহ্বান তাদের ক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে নতুন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, বিএনপি তা ধারণ করে বলে আমরা মনে করি। আগামী নির্বাচন ও সরকার পরিচালনায় বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে রাজনীতির পুরোনো কৌশল পরিত্যাগ করা; আওয়ামী লীগ যে বয়ান ও উপমা ব্যবহার করেছে, সেগুলো থেকে দূরে থাকা। নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে আনার জন্য বিএনপি শক্তভাবে প্রতিবাদ জানাতে পারে, এমনকি আন্দোলনেও নামতে পারে; কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণ ও চরিত্রহননের রাজনীতি বিএনপি সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা দিতে পারে। এরই মধ্যে বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও ছাত্রসংগঠনের সভাপতি যে ভাষায় কথা বলেছেন, তাতে রাজনীতিতে নতুন করে সহিংসতার আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

বিএনপির নেতাদের বোঝা উচিত, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বিএনপি সবচেয়ে বড় ও প্রধান রাজনৈতিক দল। সাধারণ মানুষ আশা করে বিএনপি হবে সবার অভিভাবক। ভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও বিএনপি সবাইকে এক ছাতার নিচে আনবে, এমনকি সরকারকে নির্দেশনা প্রদান করবে; কারণ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একমাত্র বিএনপির অভিজ্ঞতা আছে। মনে রাখতে হবে, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার চেয়ে সে বিজয়কে সুসংহত করা হবে বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বিজয়ের আগে যদি বিএনপির ব্যাপারে সাধারণ মানুষ আশাহত হয়, তাহলে শুধু দল নয়, তা হবে দেশের জন্য বিপর্যয়কর।

সূত্র, আমার দেশ