কাবুলের সঙ্গে দিল্লি এমন এক সময়ে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, যখন পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের দূরত্ব বাড়ছে, সূত্রপাত হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষেরও। কাবুল–দিল্লির সম্পর্কের নতুন সমীকরণে দেওবন্দের ভূমিকা কী? আফগানিস্তানের সঙ্গে দেওবন্দের ঐতিহাসিক সম্পর্ক, তালেবান ও দেওবন্দকে নিয়ে ভারতের ধর্মীয় কূটনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন মনযূরুল হক
১০ অক্টোবর। শরতের বাতাসে দিল্লির পাতা ঝরছে। ভারতের মাটিতে পা রাখলেন কাবুলের প্রভাবশালী নেতা মৌলভি আমির খান মুত্তাকি, যিনি আফগানিস্তানের ইসলামিক ইমারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ভারতে তাঁর ছয় দিনের সফর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির নতুন মানচিত্র আঁকছে।
দিল্লিতে নেমে মুক্তাকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বসলেন নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও উন্নয়ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে। যৌথ বিবৃতিতে বলা হলো, কাবুলে ভারত আবার দূতাবাস খুলবে, যা তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে বন্ধ। এরপর ১১ অক্টোবর মুত্তাকি গেলেন সাহারানপুরের দারুল উলুম দেওবন্দে; যা ইসলামিক ইমারতের কোনো জ্যেষ্ঠ নেতার প্রথম এই ভারতীয় মাদ্রাসা পরিদর্শন।
ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার কীভাবে কট্টর ইসলামপন্থী তালেবান সরকারের একজন মন্ত্রীকে গ্রহণ করল—এ রকম প্রশ্ন নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলছে নিশ্চয়ই। কাবুলের সঙ্গে দিল্লি এমন এক সময়ে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, যখন পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের দূরত্ব বাড়ছে, সীমান্তে রক্তাক্ত সংঘর্ষ চলছে। তাহলে দেওবন্দ পরিদর্শন কি শুধু প্রতীকী, নাকি এর মধ্যে কোনো গভীর রাজনৈতিক ইঙ্গিতও রয়েছে?
২.
২০২১ সালের আগস্ট তো বেশি দূরের সময় নয়। মার্কিন বাহিনী চলে যাওয়ার পর তালেবান ক্ষমতায় এলে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ভারত। চার বছর ‘সম্পর্কহীন’ থাকার পর তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবার দিল্লিতে এসে বললেন, অমৃতসর-কাবুল ফ্লাইট শুরু হবে শিগগিরই। চার দশকের যুদ্ধে ক্লান্ত আফগানিস্তানের মানুষ উন্নয়নের জন্য উদ্গ্রীব।
আফগানিস্তানের আগের সরকারের সময় ভারত সেখানে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে সালমা ড্যাম, জারঞ্জ-দেলারাম হাইওয়ে ও পার্লামেন্ট ভবনের মতো প্রকল্পে। এবার মুত্তাকি এসে আফগানিস্তানের খনিজ ক্ষেত্রেও ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অনেকে বলছেন, এটা ‘তালেবান ২.০’-এর ইঙ্গিত। আসলেই কি তাই, নাকি এটা ‘শত্রুর শত্রু হলো বন্ধু’ কৌশলের খেলা? ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তান, যারা এখন আফগানিস্তানের ইসলামিক ইমারতের শত্রু।
■ দেওবন্দের যে চিন্তাধারা তালেবানকে প্রভাবিত করেছে, সেটি এসেছে পাকিস্তানের ‘ছাঁকনি’ দিয়ে। ■ প্রথমবারের মতো দেওবন্দ মাদ্রাসার সঙ্গে এবং দেওবন্দি ভারতীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক রচিত হলো পাকিস্তানের ছায়ার বাইরে গিয়ে।
বোঝার জন্য বলি, আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক অনেকটাই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের সঙ্গে তুলনীয়। ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছে বটে; কিন্তু নানা যৌক্তিক কারণেই স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব রয়েছে। কিন্তু ভারত ছাড়া আমাদের আবার চলেও না। চিকিৎসা, শিক্ষা, ভ্রমণ এমনকি ঈদের বাজার করতে ভারতেই ভরসা ছিল এতকাল; এমনকি বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদেরও ‘শেষ আশ্রয়স্থল’ ভারত। বাংলাদেশের আলেম-ওলামাদের যদিও আগ্রাসী ভারতের প্রতি পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রয়েছে, কিন্তু দেওবন্দ মাদ্রাসার কারণে ভারতের আলেম-ওলামার সঙ্গে তাদের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগও রয়েছে। এ কারণেই বাংলাদেশে বড় কোনো ইসলামি সম্মেলন মানেই ভারতের কোনো আলেমের আগমন।
দিল্লি সফরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি
দিল্লি সফরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকিছবি: রয়টার্স
ঠিক একই চিত্র আফগানিস্তান-পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। ব্রিটিশবিরোধী, সোভিয়েতবিরোধী বা ইঙ্গ-মার্কিনবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তান লাখ লাখ আফগান মুহাজিরের বড় আশ্রয়স্থল ছিল। নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক আফগানিস্তানের জন্য যেভাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তা একাত্তরে বাংলাদেশের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তুলনীয়।
কিন্তু ব্রিটিশ ছকে আঁকা ডুরান্ড লাইন নিয়ে জন্মদাগের মতো গেঁথে আছে দুই দেশের আজন্ম ঝগড়া। পাকিস্তান সেখানে আফগানিস্তানের প্রতি তেমনই আধিপত্যবাদী, ভারত যেমন ফারাক্কা বিরোধ বা তিস্তার পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতি। অথচ আফগানিস্তানের মধ্যবিত্তের শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে বাজারসদাইয়ে নির্ভরতার জায়গা পাকিস্তান। এমনকি পাকিস্তানের ‘দেওবন্দি’ আলেমরাও আফগানিস্তানে বেশ জনপ্রিয়।
৩.
স্বভাবতই তালেবান আর পাকিস্তান ছিল ঘনিষ্ঠ। পাকিস্তানের মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন হিবতুল্লাহ আখুন্দজাদা থেকে মোল্লা ওমরের মতো তালেবান নেতারা। গত কয়েক দশকের যুদ্ধে পাকিস্তানের মাটি তাঁদের নিরাপদ আবাস ছিল—এটা যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি ২০০১ সালে তালেবানকে হটাতে পাকিস্তান সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে ঘাঁটি ছেড়ে দিয়েছিল—এটাও বাস্তব। ‘ওয়ার অন টেরর’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আমেরিকা ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে বোমা ফেলেছে; তখন ন্যাটোর ৭০ শতাংশ সরবরাহ গেছে পাকিস্তান দিয়ে। বিনিময়ে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ‘অনুদান’ নিয়ে আফগানদের গ্রেপ্তার করে গুয়ানতানামো বে কারাগারে পাঠাতে সাহায্য করেছে পাকিস্তান।
সেই সময় পাকিস্তান ভারতের প্রভাব ঠেকাতে আফগানিস্তানকে ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ’ হিসেবে দেখত। লাখো আফগান মুহাজিরকে পাকিস্তান থেকে বের করে দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত ও স্বীকৃতিহীন একটি দেশে পাঠানোর মাধ্যমে পাকিস্তান দুই দেশের মানুষের সম্পর্ককে আরও বিষ ঢেলেছে। পাকিস্তান একসময় তালেবান নেতৃত্বকে আশ্রয় দিয়েছিল আর এখন টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) নেতাদের হত্যার জন্য খুঁজছে। পাকিস্তান সরকারের এই অবস্থানকে তারা বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করছে। এর ফলে সংঘর্ষ বাধাটা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
৯ থেকে ১২ অক্টোবরের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষে পাকিস্তান বিমান হামলা চালিয়েছে কাবুল, খোস্ত, জালালাবাদে। পাল্টা জবাব দিয়েছে তালেবানও। তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকি তখন সফর করছেন পাকিস্তানের ‘চিরশত্রু দেশ’ ভারতে। এরই মধ্যে তিনি যান ভারতের সাহারানপুরে অবস্থিত বিখ্যাত দেওবন্দে।
৪.
দারুল উলুম দেওবন্দকে বলা যায় ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রতীক। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে দেওবন্দিরা ছিলেন সামনের সারিতে। আফগান ছাত্ররা দেওবন্দে পড়তে আসতেন। ফিরে গিয়ে তাঁরা কাবুল ও কান্দাহারে মাদ্রাসা গড়তেন; যা আজও আফগান ধর্মীয় জীবনে ছাপ ফেলে চলেছে। তখন এই যোগাযোগ ছিল শুধু শিক্ষার, রাষ্ট্রীয় নয়।
১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর পাকিস্তানের দেওবন্দি মাদ্রাসাগুলো থেকে হাজারো শিক্ষার্থী আফগানিস্তানে গিয়ে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে শরিক হন। এর পর থেকে আফগানিস্তানের সঙ্গে দেওবন্দের যোগাযোগ হতে থাকে পাকিস্তানের মাধ্যমে। আফগানিস্তানের ইসলামপ্রিয় মানুষ তখন থেকে ভারতকেও পাকিস্তানের চোখ দিয়ে দেখা শুরু করে। তালেবান গঠিত হয় এরও অন্তত দেড় দশক পর।
এটা বোঝা জরুরি যে দেওবন্দের যে চিন্তাধারা তালেবানকে প্রভাবিত করেছে, সেটি এসেছে পাকিস্তানের ‘ছাঁকনি’ দিয়ে; যেখানে ধর্মীয় ন্যারেটিভের সঙ্গে পাকিস্তানের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির মিশেল থাকাটাই স্বাভাবিক।
দেওবন্দ এখানে ভারতের দিক থেকে একটি চাবি বটে। তবে আফগানিস্তানের দিক থেকে ভাবলে এক ঢিলে দুই পাখি মারার গুলতি—বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে সরকারের স্বীকৃতি পাওয়া এবং দেওবন্দের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কঠোর ইসলামি আইন বাস্তবায়নের নৈতিক শক্তি অর্জন। উপরি হিসেবে পাচ্ছে পাকিস্তানের একচ্ছত্র নির্ভরতা কাটানোর বিকল্প পথ; আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের পরিচয় বদলানোর গরজও আছে তাদের।
পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের বিরোধ যদিও দেওবন্দি চিন্তার পাকিস্তানি সংস্করণ নিয়ে নয়; এটা নিছকই রাষ্ট্রের প্রশ্ন। কিন্তু আফগানিস্তানের রাষ্ট্রটা চালায় এখন দেওবন্দ অনুসারীরা, পাকিস্তানে তা নয়; বরং রাষ্ট্রগঠনের শুরুতেই দেওবন্দের দাবিকে পাকিস্তান প্রত্যাখ্যান করেছে।
পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন দেওবন্দের শাব্বির আহমদ উসমানি, যিনি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খানের উপস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে পাকিস্তানকে একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে, যা আদতে নাকচ হয়ে যায়।
পাকিস্তানের দেওবন্দি আলেমদের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক কিন্তু মন্দ নয়। হিবাতুল্লাহ আখুনজাদার সঙ্গে পাকিস্তানের প্রভাবশালী আলেম তাকি উসমানির পত্রবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে; যেখানে তিনি মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে আফগান সরকারের নীতি বদলানোর অনুরোধ করেছেন।
আরেকজন প্রভাবশালী দেওবন্দি আলেম ছিলেন সামিউল হক হক্কানি; যাঁর মাদ্রাসা থেকে মোল্লা ওমরসহ শীর্ষ অনেক তালেবান নেতা লেখাপড়া করেছেন। হক্কানি পাকিস্তানের দুবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামের রাজনৈতিক দলের প্রধান। এই জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম দলটি গঠিত হয় শাব্বির আহমদ উসমানির নেতৃত্বে দেওবন্দ প্রভাবিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ থেকে। উসমানি তখন পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করেন আর জমিয়ত ছিল অখণ্ড ভারত আন্দোলনের সমর্থক। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ এখনো ভারতে দেওবন্দিদের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠন।
আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকি দেওবন্দ মাদ্রাসা পরিদর্শন করে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। এই দলের বিবৃতিতে জানানো হয়, বৈঠকের প্রধান লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতীয় আলেমদের বন্ধন শক্তিশালী করা। এভাবে প্রথমবারের মতো দেওবন্দ মাদ্রাসার সঙ্গে এবং দেওবন্দি ভারতীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক রচিত হলো, পাকিস্তানের ছায়ার বাইরে গিয়ে।
ভারত সরকারের তরফ থেকে এটি একধরনের কূটনৈতিক সফলতা; যার মধ্য দিয়ে তারা আফগানিস্তানে তাদের বিনিয়োগ রক্ষা এবং পাকিস্তানের প্রভাব থেকে তালেবানকে মুক্ত রাখার বিশাল সম্ভাবনা ছাড়াও ধর্মীয় কূটনীতির প্রশস্ত পথ পেল। বিশ্লেষকদের মতে, এটি তালেবানের পাকিস্তানকেন্দ্রিক ‘দেওবন্দি’ থেকে ভারতীয় মূলের দিকে ফিরে আসার সংকেত। বোঝা যায়, তারা পাকিস্তানের ছায়া থেকে মুক্তি চাইছে। মুত্তাকি তাই সশরীর দেওবন্দে গিয়ে বললেন, ‘আমরা আপনাদের ঐতিহ্যের সন্তান।’
৫.
ভারত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যেমনই হোক, ধর্মীয় কূটনীতিতে বরাবরই কৌশলী। ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং কাশ্মীরের মুসলিমদের নিপীড়ক হয়েও ভারত এখনো আরব দেশগুলোসহ বেশির ভাগ মুসলিম দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে; বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করছে; মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের বিশাল শ্রমবাজার।
একাত্তরে যখন এ দেশের ইসলামপন্থীদের একাংশ মুক্তিযুদ্ধকে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ পাকিস্তান ভাঙার জন্য ভারতের ষড়যন্ত্র মনে করেছিল, তখন ভারতের ধর্মীয় কূটনীতির দায়িত্ব পালন করেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রধান এবং দেওবন্দ মাদ্রাসার শাইখুল হাদিস মাওলানা আসআদ মাদানি। তিনি এ দেশের আলেমদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে থাকতে উৎসাহ দেন এবং ভারতের মুসলমান সমাজে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেন।
বাংলাদেশের দেওবন্দি আলেম মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি (হাফেজ্জি হুজুর) এই সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে জালেম ঘোষণা করেন এবং বলেন, এই যুদ্ধ জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও ছিলেন দেওবন্দ থেকে পড়া মাওলানা।
লক্ষণীয়, বিজেপি সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করায় কাশ্মীরি জনতা যখন অস্থির হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম বরাবরের মতো কাশ্মীরিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়, তখনো ভারতের সার্বভৌমত্বের যুক্তি দিয়ে বিজেপি সরকারের নীতিকে সমর্থন করেন জমিয়ত নেতা মাহমুদ মাদানি। তিনি ধর্মীয় জায়গা থেকে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ধর্ম তার ডান চোখ হলে দেশ তার বাঁ চোখ। এবারও ধর্মীয় কূটনীতির পরীক্ষায় সফল হয় ভারত। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ দিয়ে ‘কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলিয়ে নিতে সক্ষম হয় তারা।
ফলে দেওবন্দপন্থী আফগান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক ভারতের জন্যও একটি সুযোগ। ভারত তাদের বলতে পারছে, তারা কখনো আফগানিস্তানকে শোষণ করেনি—সোভিয়েত যুগেও নয়; বরং মুজাহিদীনের আমলে প্রেসিডেন্ট বুরহানউদ্দিন রব্বানিকে সাহায্য করেছে ভারত। কারজাই আমলে তিন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে ‘নন-ইন্টারফেয়ার’ নীতিতে। মুত্তাকির তাই ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে খনিজ, কৃষি ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে আমন্ত্রণ জানাতে সংকোচ হয়নি।
দিল্লিতে বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশানে (ভিআইএফ) বক্তব্য দিচ্ছেন তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। থিংক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ভিআইএফের মূল সংগঠন বিবেকানন্দ কেন্দ্র, যেটির প্রতিষ্ঠাতা আরএসএসের পঞ্চাশের দশকের সাধারণ সম্পাদক একনাথ রানাদে। ভিআইএফের প্রতিষ্ঠাতা অজিত দোভাল, যিনি এখন ভারতের ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। ১১ অক্টোবর, ২০২৫ দিল্লিতে বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশানে (ভিআইএফ) বক্তব্য দিচ্ছেন তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। থিংক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ভিআইএফের মূল সংগঠন বিবেকানন্দ কেন্দ্র, যেটির প্রতিষ্ঠাতা আরএসএসের পঞ্চাশের দশকের সাধারণ সম্পাদক একনাথ রানাদে। ভিআইএফের প্রতিষ্ঠাতা অজিত দোভাল, যিনি এখন ভারতের ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। ১১ অক্টোবর, ২০২৫ছবি: বিবেকান্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশানের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
দেওবন্দ এখানে ভারতের দিক থেকে একটি চাবি বটে। তবে আফগানিস্তানের দিক থেকে ভাবলে এক ঢিলে দুই পাখি মারার গুলতি—বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে সরকারের স্বীকৃতি পাওয়া এবং দেওবন্দের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কঠোর ইসলামি আইন বাস্তবায়নের নৈতিক শক্তি অর্জন। উপরি হিসেবে পাচ্ছে পাকিস্তানের একচ্ছত্র নির্ভরতা কাটানোর বিকল্প পথ; আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের পরিচয় বদলানোর গরজও আছে তাদের।
মূলত দুই দেশই আটকা পড়েছে ‘ফোর ডি’র ফ্রেমওয়ার্কে—ডিপ্লোমেসি (দূতাবাস ও বিমান চলাচল), ডেভেলপমেন্ট (প্রকল্প মেরামত), ডায়ালগ আর দেওবন্দ—যা পাকিস্তানের হার্ড পাওয়ারকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রাখে।
বাংলাদেশের জনগণ যেমন ক্ষণে ক্ষণে ভারতকে বলার চেষ্টা করছে, ‘মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার দোহাই দিয়ে চিরকাল আধিপত্য করা যায় না’, তেমনি আফগান জনগণেরও পাকিস্তানকে বলার সময় এসেছে, ‘আফগানিস্তান কেবল পাকিস্তানের খেলার মাঠ নয়।’
আসল কথা হলো, ভারত হোক কিংবা পাকিস্তান, আঞ্চলিক শান্তি ফিরিয়ে আনতে চাইলে আধিপত্যের নীতি বাদ দিতে হবে। দেখার বিষয় হলো, যে দেওবন্দি চিন্তাধারাকে এত দিন ধরে বলা হয়েছে অকেজো, তা নতুন করে এ অঞ্চলে শান্তির দিগন্ত দেখাতে পারে কিনা?
● মনযূরুল হক লেখক ও সাংবাদিক