ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার পতনের বর্ষপূর্তি ৫ আগস্ট। এই দিবস সামনে রেখে নাশকতার বহুমুখী ষড়যন্ত্র চলছে। পতিত স্বৈরাচার ও তার শাসনামলের সুবিধাভোগীরা দেশ-বিদেশে নানা ফন্দি আঁটছে ড. ইউনূসের সরকারকে বেকায়দায় ফেলার। সম্প্রতি তারা জোরদার করেছে এই প্রক্রিয়া। ৫ আগস্টের আগেই বড় ধরনের নাশকতার একটি পরিকল্পনার তথ্য ধরা পড়েছে গোয়েন্দা জালে। এ জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বার-কয়েক উল্লেখ করেছেন তার সরকারের যুদ্ধাবস্থার কথা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ত্রিমুখী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার সরকারের এই যুদ্ধ পতিত স্বৈরাচার, ভারত ও নির্বাচন ইস্যুতে দেশের প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে।
এ ছাড়া বড় ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চলছে সরকারের বড় অংশীদার সেনাবাহিনীর সঙ্গে। তার সরকারেরই একটি মহল কৌশলে জিইয়ে রেখেছে এই যুদ্ধ, যা ড. ইউনূস সরকারকে যেমন দুর্বল করছে, তেমনি ঠেলে দিচ্ছে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। ড. ইউনূসের সঙ্গে তার নিয়োগদাতাদেরও চলছে মনোমালিন্য। এমনিতে উপদেষ্টা পরিষদ এবং সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা অনেকটা ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে সরকারকে। উপদেষ্টা নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা এবং সরকারের অভ্যন্তরে একাধিক সরকারের অস্তিত্বের বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। ফলে সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছেন না ড. ইউনূস। এ ছাড়া প্রশাসনিক অদক্ষতা, অনভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে দ্রুত ম্লান হয়ে যাচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা। সবকিছু মিলিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সরকারের স্থায়িত্ব এবং গণঅভ্যুত্থানের বেহাত হওয়া নিয়ে।
বাংলাদেশে গত বছর ৫ আগস্ট স্বৈরশাসকের পতন ঘটায় স্বপ্নবাজ তরুণ শিক্ষার্থী ও গণমানুষ। অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে দেশ ও জাতিকে। ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান বিশ্ব ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালায় স্বৈরাচার। গণভবনে অবাধ প্রবেশাধিকার পায় দেশের গণমানুষ। নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন ও অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু করে ভিন্নমাত্রার এক বাংলাদেশ। গণঅভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা ফ্যাসিবাদমুক্ত একটি বৈষম্যহীন, মানবিক, কল্যাণকর, আইনের শাসনের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আজকের নতুন প্রজন্ম দেখছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার। চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের একটি বছর অতিক্রান্ত হতে চলছে। জাতীয় জীবনে মোটেও নাতিদীর্ঘ নয় এ সময়কাল। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার এ সময় ধারে-কাছে পৌঁছাতে পারেনি জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণের। মুখ থুবড়ে পড়েছে মৌলিক রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়া। দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই পতিত স্বৈরাচার ও তার সহযোগীদের বিচারকর্মের। নিশ্চিত হয়নি শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের সুচিকিৎসা। অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে জনজীবনে। আন্দোলন-অবরোধের শতমুখী বিস্তার উসকে দিচ্ছে নৈরাজ্য। নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে গণপিটুনিতে মৃত্যু। নব্য চাঁদাবাজ, দখলদাররা নির্বিঘ্নে হাঁটছে পতিত স্বৈরাচারের অনুসৃত অন্ধকার গলিতে। সর্বত চলমান রাজনীতিতে প্রকট হয়ে উঠছে অতীতমুখী রীতিনীতি। সৌজন্য-সহমর্মিতার জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে অশুভ প্রতিযোগিতা, অসৌজন্য ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা।
রাজনীতিতে ক্রমাগত নির্বাচনই হয়ে উঠছে গণঅভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা। যার একমাত্র ও প্রধান উদ্দেশ্য ক্ষমতার মসনদ। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি ঘিরেই চলছে সব কূটকৌশল। এখানে জনপ্রত্যাশা গৌণ।
অতীতের ধারাবাহিকতায় ক্রমেই দেশের চেয়ে দল এবং দলের চেয়ে বড় হয়ে উঠছে ব্যক্তির প্রাধান্য। অন্যদিকে ম্লান হয়ে যাচ্ছে মৌলিক রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের স্বপ্ন। কথিত সংস্কার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো কালক্ষেপণ করছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক ইস্যু নিয়ে। প্যাডসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের নেতারাও আলোচনায় আতিথ্য গ্রহণ করছেন। ঝড় তুলছেন চায়ের কাপে। অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করছে সংস্কারকাজের বড় অংশীদারত্ব। বাগড়া দিচ্ছে জনমুখী নানা ইস্যুতে। নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দলীয় স্বার্থে সংস্কার কার্যক্রম নিশ্চিত করতে চাচ্ছে দলগুলো। এখানে প্রশ্ন উঠেছে, এসব রাজনৈতিক দল কি ১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে? তারা প্রতিনিধিত্ব করে নিজ দলের নেতা কর্মীদের। তারা নির্বাচিত কোনো জনপ্রতিনিধি নন। এসব রাজনৈতিক নেতৃত্বের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কারে দেশের জনগণের মতামতের কোনো প্রতিফলন নেই। ক্ষমতাকেন্দ্রিক দু-চারটি বিষয় ছাড়া ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে উল্লেখ নেই মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কারের ইস্যু। বিশেষ করে ভবিষ্যতে স্বৈরশাসনের উত্থান রোধ করতে হলে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির অবসান, রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করা, দলের অভ্যন্তরীণ আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা, কমিটি ও মনোনয়ন-বাণিজ্যসহ মৌলিক রাজনৈতিক ইস্যুতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। এ ছাড়া জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এবং শ্রম-অধিকার বিষয় নিয়ে সংস্কার উদ্যোগ নেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের। এসব বিষয়ে ন্যূনতম সংস্কার ছাড়া পূর্ণতা পাবে না জুলাই সনদ।
রাজনৈতিক দলগুলোই রাষ্ট্র পরিচালনা করে। কিন্তু নিজ দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনস্বার্থে কোনো সংস্কার তারা কখনোই করতে পারেনি অতীতে। এ জন্য প্রয়োজন জনগণের ম্যান্ডেট। মৌলিক রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গণভোট জরুরি। জনগণের ম্যান্ডেটহীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, একমাত্র গণভোটের মাধ্যমেই পূরণ হতে পারে কাঙ্ক্ষিত এবং টেকসই রাষ্ট্র সংস্কার। যার মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হতে পারে চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশিত নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন আলোচনা করছে সংস্কার নিয়ে ঐকমত্যে আসার জন্য। কিন্তু সম্ভব হয়নি ঐকমত্যে পৌঁছানো। রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে বাংলাদেশ আবার ফিরে যাবে চব্বিশের অভ্যুত্থানের পূর্বাবস্থায়। এ কারণেই সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কার কমিশন। অপরাজনীতির কারণে অর্ধশতাব্দীকালেও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়নি বাংলাদেশে। বারবার উত্থান ঘটেছে ফ্যাসিবাদের। সরকার বদলেছে কিন্তু মৌলিক গুণগত কোনো পরিবর্তন আসেনি রাজনীতিতে।
সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। এ জন্য ঢেলে সাজাতে হবে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। পরিবর্তন আনতে হবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে। সংস্কারের মূল বিষয়গুলো প্রচারমাধ্যম ছাড়াও লিফলেট আকারে পৌঁছে দিতে হবে দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে। সাধারণ মানুষকে অবহিত করতে হবে সংস্কারের বিষয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিশ্রম ও মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কার হলে একজন নাগরিক নতুন কী সুবিধা পাবেন, তা জানাতে হবে জনগণকে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার সংস্কার করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়া। অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি যৌক্তিক সময় দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে দেশের মানুষ। জনগণ মনে করে, রাষ্ট্র সংস্কার আগে, নির্বাচন পরে। তবে এসময়কালে সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিধান করতে হবে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর মূল্য ও সহজপ্রাপ্য। বলা যায়, এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের তেমন কোনো সাফল্য নেই। এসব নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে সমাজ ও রাষ্ট্রে। আর এই সুযোগটি গ্রহণের অপেক্ষায় রয়েছে কিছু রাজনৈতিক দল। অতিদ্রুত নির্বাচন দাবিতে মাঠ গরম করতে চাচ্ছে দলগুলো। সংস্কারকাজ অসম্পূর্ণ রেখে যেকোনো মূল্যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল হলে বেহাত হবে গণঅভ্যুত্থান। সব ধরনের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে। গণঅভ্যুত্থান বেহাত হওয়ার সব পথ ও সম্ভাবনা রুখে দিতে হবে ছাত্র-জনতাকে।
নির্বাচন হলেই সাধারণ মানুষের ভাগ্যের যে কোনো পরিবর্তন হয় না, দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করেছে জাতীয় সংসদের বিগত ১২টি নির্বাচনে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে তাদের ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন হবে—এমন সামান্যতম কোনো নজির বা প্রমাণ তারা এখনো পায়নি। জনগণ চায় না পতিত স্বৈরাচার পালানোর আগে রাষ্ট্র পরিচালনার দৌড় ক্ষান্ত দিয়ে ক্ষমতার কাঠিটি যেখানে ফেলে গেছে, সেখান থেকে সেই কাঠি নিয়ে আরেকটি দল দৌড় শুরু করুক। রাজনীতির এই রিলে রেসে বিরতি টেনে দিয়েছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান। নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে একটু দম নিয়ে দৌড়াতে হবে। এই দম নেওয়াটাই হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কার। এখানে অধৈর্য কিংবা অস্থিরতার সুযোগ নেই। দেড় হাজার শহীদ ও পঁচিশ সহস্রাধিক আহত মানুষের পরিবারের সদস্যদের আহাজারি এখনো শোনা যায় ইথারে কান পাতলে। অথচ বছর না ঘুরতেই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব নিয়ে চলছে বাহাস। খাটো করার চেষ্টা চলছে ছাত্র-জনতার অবদানকে। এসবই ফাটল ধরাচ্ছে জাতীয় ঐক্যের স্তম্ভে। সরকারের নির্মোহ ও শক্তিশালী ভূমিকা প্রয়োজন। পতিত স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা এখনো বিচরণ করছে রাষ্ট্রের পরতে পরতে। যেনতেন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান দেশ ও জাতিকে আরো গভীর সংকটে নিপতিত করবে। সব প্রতিবন্ধকতা সামাল দিয়েই এগোতে হবে ড. ইউনূসের সরকারকে। হাজারো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত গণঅভ্যুত্থান বেহাত হতে দেওয়া যাবে না।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক