নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরব ও মুসলিম বিশ্বের কয়েকজন নেতার সঙ্গে সাইডলাইনে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর নেতারা ছাড়াও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ট্রাম্প গাজায় যুদ্ধ বন্ধে তার ২১ দফা পরিকল্পনা বা প্রস্তাব মুসলিম নেতাদের কাছে তুলে ধরেন। আলাপ-আলোচনার পর মুসলিম নেতারা প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করেন। কিন্তু এরপর ট্রাম্প ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসে ফিরে গত সোমবার যে ২০ দফা প্রস্তাব প্রকাশ করেন, তা নিউ ইয়র্কে আরব ও মুসলিম নেতাদের অনুমোদন করা প্রস্তাব থেকে অনেকটাই ভিন্ন ধরনের। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বিবৃতিতে। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রকাশ করা ২০ দফা প্রস্তাব আমাদের নয়।
ট্রাম্পের এই শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশের পর এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কয়েকটি আরব দেশ। গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে আলোচনায় দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যস্থতা করে আসছে কাতার। কিন্তু কাতারকে বাদ দিয়ে ট্রাম্প নিজেই শান্তি প্রস্তাব ঘোষণা করা ক্ষোভ প্রকাশ করে দেশটি। অন্যদিকে, গাজার লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে সিনাই এলাকায় ঠেলে দেওয়ার ইসরাইলি পরিকল্পনায় এবং ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কোনো ভূমিকা না রাখায় ক্ষুব্ধ মিসর।
কিন্তু ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়ে যেসব আরব দেশ বিবৃতি দিয়েছে, তার মধ্যে কাতার ও মিসরের নামও আছে। অথচ ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় গাজার ফিলিস্তিনিদের ন্যূনতম ভূমিকা পালনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এ নিয়ে আরব ও মুসলিম নেতারা টুঁ শব্দও করছেন না। গত দুই বছরে ইসরাইলি আগ্রাসন, গণহত্যা ও পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষে ৬৫,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পর গাজার নতুন ব্যবস্থাপনায় এই ভূখণ্ডের মানুষের সামান্যতম ভূমিকাও না থাকার দায়ভার কি ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করা আরব ও মুসলিম নেতাদের কাঁধে বর্তায় না? এটা কি গাজার ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তাদের বিশ্বাসঘাতকতা নয়?
যুক্তরাষ্ট্রসহ হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া সারা বিশ্ব যখন ইসরাইলের দখলদারিত্ব ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, সে সময় আরব দেশগুলোর ট্রাম্পের ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষাকারী একটি চুক্তিতে সম্মতি দেওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা গাজায় নতুন ধরনের দখলদারিত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। গাজার ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে যে মুক্তি আর মিলছে না, তা এখন বলাই যায়। কারণ আরব ও মুসলিম বিশ্বের নেতারা এমন একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন, যেটাতে স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা নেই এবং আর কখনোই তা হওয়ার সম্ভাবনাও থাকছে না।
আরব দেশগুলোর নেতারা হয়তো দাবি করবেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনায় সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে তারা গাজায় ইসরাইলের দখলদারিত্ব, জাতিগত নির্মূল ও গণহত্যা বন্ধ করতে পেরেছেন। একই সঙ্গে হতো এটাও বলবেন, তারা গাজায় জাতিসংঘের সাহায্য সংস্থাগুলো ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু এসব কিছুরই নিয়ন্ত্রণ যে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর হাতে থাকবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু ইসরাইল যে গাজায় জাতিগত নির্মূল ও গণহত্যা বন্ধ করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ ট্রাম্পের নতুন চুক্তি অনুযায়ী ইসরাইলি সেনারা গাজা ছেড়ে চলে যাবে না। ইসরাইলি বাহিনী গাজা থেকে কখন প্রত্যাহার করা হবে, তার নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা দেওয়া নেই চুক্তিতে।
অন্যদিকে, গাজার নিরাপত্তার জন্য প্রস্তাবিত ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্সের (আইএসএফ) কাছে কখন এবং গাজার কতটুকু এলাকার দায়িত্ব হস্তান্তর করবে, সেটিও নির্ধারণ করবেন নেতানিয়াহু। এছাড়া গাজায় কী পরিমাণ ত্রাণ ঢুকবে এবং পুনর্গঠনের জন্য কী পরিমাণ নির্মাণসামগ্রী আসবে, সেটাও নির্ধারণ করার ক্ষমতা নেতানিয়াহুর হাতেই থাকছে। কিন্তু গাজায় ফিলিস্তিনিদের কোনো নতুন নেতৃত্ব যে জন্ম নেবে না, তা নিশ্চিত করা হয়েছে ট্রাম্পের চুক্তিতে। কারণ গাজার পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনিদের কোনো ভূমিকা রাখা হয়নি। এছাড়া এই চুক্তিতে আরো যে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে, তা হলো অধিকৃত পশ্চিম তীরের সঙ্গে গাজার সম্পৃক্ততার কোনো সুযোগ বা সম্ভাবনাই রাখা হচ্ছে না। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে অধিকৃত পশ্চিমতীরের খণ্ডিত অংশ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
ট্রাম্পের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু কয়েকটি শর্ত দিয়েছেন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে (পিএ)। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যে মামলা করেছে, তা প্রত্যাহার করতে হবে। এছাড়া ইসরাইলি হামলায় নিহত প্রতিরোধযোদ্ধাদের পরিবারকে অর্থ সহায়তা প্রদান বন্ধ করতে হবে, বদলাতে হবে ফিলিস্তিনি স্কুলগুলোয় শিক্ষা কারিকুলাম, ফিলিস্তিনি মিডিয়াগুলোর লাগাম টেনে ধরতে হবে। এরপরই ইসরাইল চিন্তা করে দেখবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তারা কতটুকু সম্পর্ক বজায় রাখবে।
তুরস্ক, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, মিসর, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী যারাই ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, তাদের কেউই গাজা প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়ার আগে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আলোচনা করার কোনো প্রয়োজন মনে করেননি। ফিলিস্তিনিদের কোনো সংস্থাকে যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার পুনর্গঠন ও শাসন পরিকল্পনায় যুক্ত রাখা হয়নি।
বরং ট্রাম্পের পরিকল্পনা মেনে নিতে হামাসকে বাধ্য করা হচ্ছে, যাকে সোজা কথায় হামাসের আত্মসমর্পণ বলা যেতে পারে। গত দুই বছরে ইসরাইল যুদ্ধের ময়দানে জঙ্গিবিমান, ট্যাংক, ড্রোন ও রোবট দিয়ে হামাসকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারেনি। কিন্তু এখন আরব ও মুসলিম নেতাদের সহায়তায় সেই কাজটিই সহজে করছেন ট্রাম্প। এটা আরব ও মুসলিম নেতাদের জন্য এক চরম লজ্জার ঘটনা।
গাজা নিয়ে ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনার বিপরীতে আরবদের পাল্টা পরিকল্পনা কোথায়? বাস্তবে কোনো পরিকল্পনা নেই। ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূখণ্ড দখল করে ইহুদি বর্ণবাদী দেশটি তার সীমানা বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু তা প্রতিহত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা কোথায় আরব দেশগুলোর মধ্যে?
এমনকি নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে গাজা নিয়ে যে খসড়া প্রস্তাবে আরব নেতারা সমর্থন দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রকাশ করা চূড়ান্ত প্রস্তাবে হামাসকে দেওয়া শর্তে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এতে সব শর্তই ইসরাইলের পক্ষে রাখা হয়েছে। কিন্তু তা নিয়েও আরব নেতারা কোনো কথা বলছেন না। ট্রাম্পের সঙ্গে আরব নেতাদের বৈঠকে ঠিক করা হয়েছিল প্রতিদিন গাজায় ত্রাণবাহী ৬০০ ট্রাক প্রবেশ করবে।
কিন্তু ট্রাম্পের চূড়ান্ত পরিকল্পনায় ৬০০ ট্রাকের স্থলে ‘ফুল সাপোর্ট’ বা ‘পূর্ণ সমর্থন’র কথা বলা হয়েছে। এতে কোনো সংখ্যাই উল্লেখ করা হয়নি। যুদ্ধবিরতির পর গাজা থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল খসড়া প্রস্তাবে। কিন্তু ট্রাম্পের চূড়ান্ত বিবৃতিতে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নের ওপর সেনা প্রত্যাহার নির্ভর করবে বলে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, জাতিসংঘে ট্রাম্প এবং আরব ও মুসলিম নেতাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যে খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করা হয়, তা ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ ও ট্রাম্পের জামাতা জারেড কুশনার নিয়ে যান নিউ ইয়র্কে নেতানিয়াহুর হোটেলে। সেখানেই তারা মিলে সব শর্তে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। এরপর তা ট্রাম্পের কাছে নিয়ে গেলে তিনি তা প্রকাশ করেন।
টাইমস অব ইসরাইলের ভাষায় খসড়া প্রস্তাবে ‘সম্পাদনা’ করার মাধ্যমে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। কাতারের কর্মকর্তারা এই ‘সম্পাদনা’ নিয়ে এতটাই ক্ষুব্ধ হন যে, তারা সরাসরি ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন, যাতে ট্রাম্প গাজা পরিকল্পনা ঘোষণা বিলম্বিত করেন। কিন্তু কাতারের কর্মকর্তাদের ফোন কেটে দেওয়া হয় বারবার।
হামাসের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ইস্যুগুলো তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, তাদের কাছে থাকা জিম্মিদের হস্তান্তরের আগে যুদ্ধ বন্ধ ও সম্পূর্ণ ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার করা। হামাস যেখানে অস্ত্র জমা করবে, তার একটি চূড়ান্ত সীমা থাকবে। কিন্তু নেতানিয়াহু, উইটকফ ও জারেড কুশনার খসড়া প্রস্তাবের এসব ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন এনে নিজেদের মতো করে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, যার সবই গেছে ইসরাইলের পক্ষে। ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে এমন একটি ম্যাপ প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে দেখা যায়, কিছু এলাকা থেকে সামান্যসংখ্যক সেনা প্রত্যাহার করা হবে এবং গাজার অধিকাংশ এলাকাতেই ইসরাইলি সেনারা মোতায়েন থাকবেন।
ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো নিশ্চয়তা ট্রাম্পের ২০ দফা চুক্তিতে দেওয়া হয়নি। এই চুক্তির ২০ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, ‘একটি রাজনৈতিক পরিবেশে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী সহাবস্থানের জন্য ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করবে যুক্তরাষ্ট্র।’ ১৯ নম্বর ধারায় ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার শব্দ ব্যবহারের পরিবর্তে তাদের ‘আকাঙ্ক্ষা’র কথা বলা হয়েছে। সেই ‘আকাঙ্ক্ষা’র সঙ্গে আবার গাজার পুনঃউন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের যথাযথ সংস্কারের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় সালিশকারী হিসেবে কে থাকবে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল।
হামাসের ও গাজার ভাগ্য নির্ধারণকারী এই যুদ্ধবিরতি চুক্তির সব শর্তই ইসরাইলের পক্ষে যাওয়ায় নেতানিয়াহু খুশি। তার মুখে চওড়া হাসি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। আরব নেতাদের বদৌলতে এবং ট্রাম্প ও তার সহযোগীদের কূটচালে হামাস ও গাজার ফিলিস্তিনিদের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী