বিশ্ব নারীবাদের তরঙ্গে প্লাবিত হয়ে বাংলাদেশ সরকারও নারী কমিশন করেছে, যা ইতোমধ্যে বিতর্কিত হয়েছে নানা কারণে। আর মানুষও যার যার অবস্থান থেকে হরেক রকম মতামত দিয়ে যাচ্ছেন, তবে বেশির ভাগ মতামতই বেশ বিভ্রান্তিকর এবং ক্ষতিকরও বটে। আওয়ামদের বিভিন্ন ডগমা ও আইডিওলজি থাকতে পারে, কিন্তু নিরপেক্ষ জায়গা থেকে ফেমিনিজম বা নারীবাদের ডিসকোর্স নিয়ে কথা বলা উচিত। তাই, এ বিষয়টি নিয়ে একটু মোজাকারা করা লাজেমি অনুভব করলাম। তাছাড়া অনেক পাঠকও এ বিষয়ে লেখার জন্য অনুরোধ করে ছিলেন। আজকের লেখাটি লেখার সময় ভিক্টোরিয়ান যুগের বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক ও কবি থমাস হার্ডির টেস অব দ্য ডি’আরবারভিলস (Tess of the d’Urbervilles) ট্র্যাজিক উপন্যাসটির কথা ইয়াদে এলো, যেখানে প্রধান চরিত্র টেস ডার্বিফিল্ড এক অসহায়, দরিদ্র এবং নিরীহ গ্রাম্য মেয়ে।
পরিবারের দারিদ্র্যের কারণে টেসকে পাঠানো হয় তাদের কথিত আত্মীয় অ্যালেক ডি’আর্বারভিলসের বাড়িতে সাহায্যের জন্য। সেখানে অ্যালেক টেসকে ধর্ষণ করে, কিন্তু সমাজ টেসকে তুহমত দেয় এবং টেসকে কেউ ‘শুদ্ধ’ নারী মনে করে না, যদিও সে নিজের দোষে কিছু করেনি। পরে সে অ্যাঞ্জেল ক্লেয়ার নামের একজনকে ভালোবাসে, কিন্তু বিয়ের পর যখন অ্যাঞ্জেল তার অতীত জানতে পারে, তখন সেও টেসকে ত্যাগ করে। একপর্যায়ে বঞ্চনা ও অত্যাচারের শিকার হয়ে টেস অ্যালেককে হত্যা করে এবং শেষ পর্যন্ত ফাঁসি হয়।
এই উপন্যাসে টেস হলো সমাজের নারী নির্যাতনের প্রতীক। তার জীবনে যা ঘটে, তাতে তার দায় নেই, কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বারবার তাকে দোষী করে। হার্ডি দেখিয়েছেন একজন নারী কীভাবে নৈতিকতা, শ্রদ্ধা ও স্বাধীনতা হারায় শুধু পুরুষের খামখেয়ালি ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। টেসের গল্প নারী-নির্যাতন ও সামাজিক বৈষম্যের করুণ দলিল। এবার মূল আলাপে যাওয়ার আছে কাতরা পরিমাণ নারীবাদের আইডিয়া নেওয়া যাক। বস্তুত ফেমিনিজম (Feminism) শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ ফেমিনা (femina) থেকে, যার সঙ্গে ইজম (ism) যুক্ত হয়ে একটি মতবাদ বা তত্ত্ব বোঝায়। বাংলা অনুবাদে একে বলা হয় ‘নারীবাদ’। একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমাদের সমাজের অনেক আদমি মনে করেন, নারীবাদ শুধু নারীর সমস্যা বা নারীর পক্ষেই কথা বলে, কথাটি সহিহ নয়; বরং এটি সমাজে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, শোষণ ও ক্ষমতার অপ্রতুল বণ্টনের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন। নারীবাদ পুরুষের ওপর আরোপিত কঠোর সামাজিক ভূমিকার বিরুদ্ধেও কথা বলে। যেমন—‘পুরুষ কাঁদে না’, ‘পুরুষ মানেই শক্ত’, ‘পুরুষ মানেই রোজগারদাতা’ ইত্যাদি ধারণাগুলোও নারীবাদ চ্যালেঞ্জ করে। ফেমিনিজম বলে, পিতৃতন্ত্র পেট্রিয়ার্কি (patriarchy) শুধু নারীকেই নয়, পুরুষকেও বেঁধে রাখে।
আদতে, নারীবাদ শুধু একটি সামাজিক আন্দোলন নয়, এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং দার্শনিক আন্দোলন ও মতাদর্শ, যা নারীর সমান অধিকার, স্বাধীনতা এবং মর্যাদার পক্ষে অবস্থান নেয়, নারীর ওপর পেট্রিয়ারকিয়াল শোষণ বন্ধ, সমজাতীয় মর্যাদা ও মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে। এর থিয়রেটিক্যাল ভিত্তি ও রাজনীতি শুধু পশ্চিমে গড়ে ওঠেনি; বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সমাজিক কাঠামোর সঙ্গে সেটি অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত।
এটি শুধু নারীর অধিকারের জন্য লড়াই নয়, বরং একটি সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতা বা অ্যান্ড্রোসেন্ট্রিজম ভেঙে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থার জন্য একটি দর্শন। ফেমিনিজম সমাজে নারীর সমতা, অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি বিপ্লবাত্মক চিন্তাধারা ও আন্দোলন হলেও এর বিরুদ্ধে নানা সময় নানা দিক থেকে সমালোচনা এসেছে। এই সমালোচনাগুলো ফেমিনিজমের অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতা, বাস্তবায়নে বৈষম্য ও তাত্ত্বিক সংকটের দিকে ইঙ্গিত করে।
নারীবাদের ইতিহাস একদিনে শুরু হয়নি। এটি সময়ের সঙ্গে বিকশিত হয়েছে, নতুন চাহিদা এবং নতুন চেতনার আলোকে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রাচীন গ্রিস, রোম কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদের অধিকাংশ সময়েই দেখা হতো গৃহস্থালির উপকরণ, পুরুষতান্ত্রিক সম্পত্তি অথবা ‘সমাজের সম্মানের প্রতীক’ হিসেবে। নারীকে নির্ধারিত ভূমিকা, যেমন স্ত্রী, জননী, গৃহকর্ত্রীর বাইরে ভাবাই যেত না। প্লেটো তার দ্য রিপাবলিকে (The Republic) নারীর কিছু সামাজিক দায়িত্ব পালনের কথা বললেও, এর বিরোধিতা করেন অ্যারিস্টটল, যিনি নারীদের ‘অসম্পূর্ণ পুরুষ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
বিশ্বসভ্যতার শুরু থেকে নারীকে বিভিন্ন সময় ও সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়েছে। আদিম সমাজে নারী প্রধানত প্রজনন ক্ষমতা এবং প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক হিসেবে পূজিত হতো। সেই সময় নারীর শরীর ও মাতৃত্বকে অলৌকিক এবং শক্তির উৎস হিসেবে দেখা হতো। এই ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায় মাতৃদেবী পূজা বা মাদার গডেস কাল্টে (Mother Goddess Cult), যেমন মিসরের আইসিস (Isis), ভারতের ‘দেবীমা’ কিংবা গ্রিকদের গাইয়া (Gaia)।
যাই হোক, ভাষার নারী আর বাস্তবের নারী কি এক? মোটেই এক না। ভাষার নারী লিঙ্গুইস্টিক ওমেন (linguistic woman) এবং বাস্তবের নারী রিয়েল ওম্যান (Real woman) এই দুইয়ের মধ্যে একটি বেশুমার ফারাক রয়েছে। নারীর উপস্থাপনাকে কেন্দ্র করে নারীবাদী দার্শনিকরা প্রশ্ন তুলেছেন—আমরা যাকে ‘নারী’ বলি—সে কি সমাজ-নির্ধারিত একটি ভাষাগত গঠন, না কি একজন বাস্তব অস্তিত্বের অধিকারী মানুষ? এই প্রশ্নের উত্তরে ফরাসি নারীবাদী লেখিকা ও দার্শনিক সিমোন ডি বোভোয়ার (Simone de Beau-voir) তার বিখ্যাত বই The Second Sex (1949)-এ বলেন, ওয়ান ইজ নট বর্ন, বাট র্যাদার বিকামস, আ ওম্যান (One is not born, but rather becomes, a woman)। অর্থাৎ নারী জন্মগত নয়, বরং সমাজ ও ভাষার মাধ্যমে নারী হয়ে ওঠে।
এখানে ‘নারী’ একধরনের সাংস্কৃতিক নির্মাণ, যা সমাজ, ভাষা ও আচরণের মাধ্যমে আরোপ করে। এই ভাবনা ভাষার নারী এবং বাস্তব নারীর বিভাজনকে স্পষ্ট করে তোলে। সমাজ যেমন নারীকে ‘লজ্জাশীলা’, ‘ত্যাগী’, ‘পবিত্র’ হিসেবে ভাষায় প্রতিষ্ঠা দেয়, বাস্তব নারী ততটাই বৈচিত্র্যময়, চিন্তাশীল এবং স্বাধীন, যা এই সামাজিক কল্পনার সীমানার বাইরে। আদতে ভাষার নারী হলো সেই নারী যাকে সমাজ, সাহিত্য, ধর্ম এবং পুরুষতান্ত্রিক ভাষা গড়ে তোলে। তিনি একজন ‘কল্পিত নারী’, যিনি সবসময় কোমল, নিঃস্বার্থ, ত্যাগী, লাজুক বা কামনাসর্বস্ব—এ ধরনের সামাজিক কাঠামো অনুযায়ী নির্ধারিত। সাহিত্য, সিনেমা কিংবা লোকজ ভাষায় নারীকে প্রায়ই এ ধরনের ধর্মীয়, যৌন অথবা আদর্শ গৃহিণী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। যেমন—‘বিনয়ী বধূ’, ‘মাতৃত্বময়ী জননী’, ‘প্রেমিকারূপী আত্মদানকারী নারী’ বা ‘পাপী নারী’ ইত্যাদি পরিচিতি মূলত পুরুষতান্ত্রিক কল্পনায় তৈরি নারী চরিত্র। এই নারী চরিত্র বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন নয়, বরং সমাজ কী ধরনের নারী চায়—তারই রূপায়ণ।
অন্যদিকে, বাস্তবের নারী একজন জীবন্ত মানুষ, যার চিন্তা, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, ভয়, যৌনতা, রাগ, প্রতিবাদ ও স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। তিনি শুধু মা, বোন, স্ত্রী কিংবা মেয়ে নন; তিনি একজন ব্যক্তি, যার নিজস্ব পরিচয় সমাজের আরোপিত ছাঁচের বাইরে গড়ে ওঠে। বাস্তব নারী সংগ্রাম করে কখনো পরিবারে, কখনো কর্মক্ষেত্রে, কখনো রাজনীতিতে, আবার কখনো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে। বাস্তব নারী কখনো শুধু কোমল নয়—তিনি প্রতিবাদী, সৃজনশীল, জটিল এবং অসম্পূর্ণ, যেমনটা একজন মানুষ হয়। এই ফারাক সবচেয়ে বেশি বোঝা যায় সাহিত্য ও সিনেমার নারীচরিত্রে।
উদাহরণস্বরূপ, অনেক গল্পে দেখা যায়, নারী চরিত্র শুধু পুরুষ নায়কের জীবনকে এগিয়ে নিতে আসে—তার নিজের কোনো উদ্দেশ্য বা স্বাতন্ত্র্য নেই। কিন্তু বাস্তবের নারীরা শুধু ‘সহযোগী’ নয়, তারা নিজেরাও কেন্দ্রীয় চরিত্র হতে চায়। মিশেল ফুকো ও (Michel Foucault) ও জ্যাক দেরিদার (Jacques Derrida) ভাষাতাত্ত্বিক তত্ত্বেও দেখা যায়, ভাষা হলো ক্ষমতার ক্ষেত্র। ফুকো (Foucault) দেখিয়েছেন, কীভাবে জ্ঞান ও ভাষাব্যবস্থার মাধ্যমে দেহ (বিশেষ করে নারীর দেহ) নিয়ন্ত্রণ করা হয়। দেরিদারের (Derrida) ডিকনস্ট্রাকশন (deconstruction) ধারণা আমাদের শেখায়—ভাষায় উপস্থিত অর্থ কখনোই নিরপেক্ষ নয়। দেরিদারের তত্ত্ব অনুসারে, ভাষার নারী (যেমন : ‘মা’, ‘বাঁধা’, ‘লাজুক’, ‘অপবিত্র’) একটি নির্মিত চিত্র, যা বহু পুরোনো দার্শনিক বাইনারিতে তৈরি হয়েছে—পুরুষ/নারী, যুক্তি/আবেগ, সক্রিয়/নিষ্ক্রিয়—যেখানে নারী সবসময় দ্বিতীয়, অবদমিত বা নির্ভরশীল।
লুস ইরিগারে (Luce Irigaray) বলেন, নারীকে ভাষায় এমনভাবে চিত্রিত করা হয়, যা আসলে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন—একে তিনি বলেন, ফ্যালোসেন্ট্রিক ল্যাঙ্গুয়েজ (phallocentric language)। ইরিগার (Irigaray) দাবি করেন, নারীর অভিজ্ঞতা প্রকাশের জন্য একটি ভিন্ন ভাষার প্রয়োজন, যা পুরুষের ভাষা কাঠামোকে ভেঙে দেবে।
ইলেন সিক্সো (Hélène Cixous) এ প্রসঙ্গে তার দ্য ল্যাফ অব দ্য মেডুসা (The Laugh of the Medusa) প্রবন্ধে বলেন—
‘Woman must write herself : must write about women and bring women to writing...’
তিনি একরিত্যর ফেঁমিনিন (écriture féminine) বা নারীর নিজস্ব লেখার ধারা তৈরি করার আহ্বান জানান, যেখানে নারীরা তাদের শরীর, আবেগ, কামনা ও ভাষা নিয়ে স্বাধীনভাবে লেখে। ভাষার নারী যদি হয় পুরুষতন্ত্রের ভাষায় আঁকা চিত্র, তাহলে বাস্তব নারী তার ভাষা নিজেই নির্মাণ করে। জুডিথ বাটলার (Judith Butler) তার বই জেন্ডার ট্রাবল (Gender Trouble) বলেন, লিঙ্গ জেন্ডার (gender) আসলে একটি পারফরম্যান্স (performance)। ভাষা, আচরণ, পোশাক—এসবের মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত ‘নারী’ বা ‘পুরুষ’ হয়ে উঠি। সুতরাং, ‘নারী’ একটি প্রাকৃতিক বা চিরন্তন সত্তা নয়, বরং ভাষার ভেতর গঠিত একধরনের সামাজিক অনুশীলন সোশ্যাল স্ক্রিপ্ট (social script)। এখানে ভাষার নারী হলো এই প্রথাগত স্ক্রিপ্টের রূপ, আর বাস্তব নারী সেই স্ক্রিপ্টকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা রাখে।
জুলাই সনদে হোক জাতীয় ঐক্যজুলাই সনদে হোক জাতীয় ঐক্য
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের উত্থানে নারী তার শক্তির জায়গা হারাতে থাকে এবং হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রিত ও পরাধীন সত্তা। এই বদলটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্মীয় ব্যাখ্যা বা ধর্মবেত্তাদের অপব্যাখ্যার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাচীনকালে, বিশেষ করে পৌরাণিক ধর্মীয় টেক্সট ও সৃষ্টির কাহিনিতে নারীকে দ্বৈতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ সময় নারীর অবস্থান ছিল পবিত্রতা ও ভয়—এই দুই মেরুর মধ্যে দোদুল্যমান। যেমন—হিন্দু ধর্মে নারীর অবস্থান দ্বৈত প্রকৃতির। একদিকে নারীকে ‘দেবী’, ‘শক্তি’, ‘জননী’ হিসেবে পূজিত করা হয়—যেমন দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতী। তবে অন্যদিকে, ধর্মীয় শাস্ত্রগুলোয় নারীকে পুরুষের অধীন, অবাধ্যতার উৎস, এমনকি পাপের কারণ হিসেবেও চিত্রিত করা হয়েছে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে— ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি (Na stri svatantryam arhati)।
নারী কখনো স্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্য নয়। কিশোরী অবস্থায় বাবার অধীনে, বিবাহিত অবস্থায় স্বামীর অধীনে আর বিধবা হলে ছেলের অধীনে থাকতে হবে।
এখানে নারীর স্বতন্ত্রতা অস্বীকৃত হয়েছে এবং তার জীবনের পথ পুরুষনির্ভর করে তোলা হয়েছে। ইসলাম নারীকে সম্মান, মর্যাদা ও নিরাপত্তা দিয়েছে। কোরআনে নারীর অধিকারের কথা বলা হয়েছে—উত্তরাধিকার, বিয়ে, তালাক, শিক্ষার সুযোগ ইত্যাদি।
এ কথা সত্যি, ইসলামের মতো অন্য কোনো ধর্ম নারীকে এত কদর, তাজিম ও অধিকার দেয়নি।
বাইবেলে নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে মূলত পুরুষের সহচর হিসেবে। আদমের সহধর্মিণী হিসেবে হাওয়ার সৃষ্টি করা হয় এবং সৃষ্টির গল্পে প্রথম পাপের জন্য ইভকে দায়ী করা হয় : ‘It was the woman who was deceived and became a sinner.’ (1 Timothy 2:14), এই বর্ণনায় নারীকে ‘পাপের উৎস’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়। ইহুদি ধর্মীয় রীতিনীতিতে নারীর ভূমিকা গৃহকেন্দ্রিক এবং ধর্মীয় নেতৃত্ব পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রার্থনায় বলা হয়—থ্যাংক গড ফর নট মেকিং মি আ ওম্যান (Thank God for not making me a woman), যা নারীকে অবমূল্যায়নের একটি স্পষ্ট নিদর্শন। শুরুতে বৌদ্ধধর্মে নারীকে নির্বাণপ্রাপ্তির যোগ্য হিসেবে গণ্য করা হয়নি। তথাগত গৌতম বুদ্ধ প্রথমে নারীদের সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করতে নিষেধ করেছিলেন, পরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুমতি দেন। থেরিগাথাতে কিছু নারী বুদ্ধ অনুসারিণী হিসেবে উপস্থিত হলেও বৌদ্ধ দর্শনে নারীকে পুরুষের সমকক্ষ হিসেবে দেখা হয়নি। নারীর জন্মকে কার্মিকভাবে ‘অবাঞ্ছিত’ মনে করা হয়েছে। গ্রিক পুরাণেও প্যান্ডোরাকে ট্রাবল-ব্রিংগার (trouble-bringer) হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
মধ্যযুগে নারীদের অবস্থা ছিল আরো করুণ, বিশেষত ইউরোপের খ্রিষ্টান সমাজে ধর্মীয় পাঠে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখানো হয়। তবে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে বা মধ্যযুগের সুফি সাহিত্যে নারীর আত্মিক ক্ষমতা ও শক্তির কিছু স্বীকৃত চিত্র দেখা যায়, যেমন—শক্তি তত্ত্ব, মা দুর্গার পূজা ইত্যাদি। তাছাড়া মধ্যযুগে খ্রিষ্টীয় সমাজে নারীকে অবিশ্বস্ত, কামনাসর্বস্ব এবং দুর্বল হিসেবে গণ্য করা হতো। সেই কারণে চর্চ এবং ইনকুইজিশনের যুগে বহু নারীকে ডাইনি বা উইচ (witch) হিসেবে পুড়িয়ে মারা হয়।
মধ্যযুগে ধর্মীয় প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে নারী হয়ে ওঠে সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সমাজে নারীকে ‘মন্দ’ ও ‘পাপগ্রস্ত’ রূপে দেখা হতো। নারীর পড়াশোনা বা সম্পত্তির অধিকার ছিল না।
পাঠক, জগতে আসলে নারী ও পুরুষ বলতে কিছু নেই, এটি একটা গল্প বা ইমাজিনেইশন। আর এই গল্পে আমরা সবাই বিশ্বাস করি বলেই এটার অস্তিত্ব আমাদের মধ্যে আছে, বাস্তবে এটি একটি ট্রানসেনডেন্টাল বা মেটাফিজিক্যাল বিষয়। আরো সহজ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, ধরুন ‘ঢাকা’ শহর, পৃথিবীতে ঢাকা শহর বলতে কিছু নেই, যেটা আছে সেটা একটা গল্প, আর আমরা সবাই বিশ্বাস করি বলেই এটি ঢাকা শহর, আপনি ঢাকা শহরে ঢুকে সুউচ্চ ইমারত থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট ও আরো হরেক ধরনের মেটারিয়ালিস্টিক জিনিসপত্র ঠাহর করতে পারবেন, কিন্তু ঢাকা শহর তালাশ করেও পাবেন না। তাই বলে কি রক্তমাংসের মানুষের অস্তিত্ব নেই? আলবত আছে, কিন্তু নারী নামের কোনো অজুতের মজুত নেই, এটি একটা গল্প। নারী লিখতে এসব বর্ণ লাগে নারি (ন+আ+র+ই), এখন দেখুন নিরামিষ (ন+ই+র+আ+ম+ই+ষ+ল) শব্দটিতেও নারী লেখার সবগুলো বর্ণ আছে, তাহলে এগুলো বললে কি মাংস, মাছ, ডিম ইত্যাদি প্রাণিজ উপাদানমুক্ত খাবারকে বোঝায়? নিশ্চয়ই না, আসলে নামগুলো লজিক্যালি আসেনি, যারা এই নামটা দিয়েছেন তারা এত ভেবেচিন্তে নামটি দেননি, মনে এলো নাম একটা দিয়ে দিল, তাই নামগুলো আর্বিট্রারি। এখানে আপনি যুক্তি খুঁজে পাবেন না।
বাংলাদেশি সমাজেও ভাষার নারী ও বাস্তব নারীর ব্যবধান স্পষ্ট। একদিকে সমাজ বা সাহিত্য নারীকে বলে, ‘মেয়ে মানেই শান্ত, ঘরোয়া, লজ্জাবতী’; অন্যদিকে বাস্তবে সেই নারীই হয়তো হচ্ছে পরিবারের রোজগারে সদস্য, নির্যাতনের শিকার অথবা রাজনৈতিকভাবে সচেতন একজন মানুষ। তবু সমাজ এখনো ভাষার নারীকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যার ফলে বাস্তব নারীর কণ্ঠস্বর অবদমিত হয়।
বাংলাদেশে সামাজিক ভাষা, ধর্মীয় ভাষ্য এবং সাহিত্যে নারীর উপস্থাপন—সব জায়গায় ভাষার নারী এবং বাস্তব নারীর মধ্যে ফারাক লক্ষ করা যায়। যেমন—সাহিত্যে দেখা যায় ‘বিরহিণী নারী’, ‘নির্যাতিতা নারী’, ‘আদর্শ গৃহবধূ’ ইত্যাদি রূপ, যা সমাজ চায়। কিন্তু বাস্তবে সেই নারীই শ্রমজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী। (চলবে)
লেখক : সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও গবেষক ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন, জার্মানি