ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনকে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে জমজমাট নির্বাচনী প্রচারণা। প্রার্থীরা ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন। এমনিতে দীর্ঘদিন পর ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তার ওপর আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের আমলে দেশে নির্বাচন ও ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল না। এ কারণে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেশে নির্বাচনের আবহ ফিরিয়ে এনেছে। দেশের মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন। ওদিকে রাকসু নির্বাচনের কার্যক্রমও এগিয়ে চলছে।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু সিদ্ধান্ত ঠিক জুতসই মনে হচ্ছে না। কোথায় যেন একধরনের খামতি লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা নিয়ে জনমনে নানা ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।

এত উৎসাহ–উদ্দীপনার নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের ভোট প্রদান থেকে বঞ্চিত করতে পারে বা নিরুৎসাহিত করতে পারে। অথচ হওয়ার কথা ছিল বিপরীত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন সব উদ্যোগ গ্রহণ করবে, যাতে শিক্ষার্থীরা আগ্রহ নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যান ও ভোট প্রদান করেন। ভোট হচ্ছে গণতন্ত্রচর্চার চূড়ান্ত রূপ। ভোট হচ্ছে গণতন্ত্রের উৎসব, তা যে পর্যায়ের নির্বাচনই হোক না কেন।

প্রথম যে জিনিস দেখে খটকা লাগল, তা হচ্ছে ঢাবিতে বন্ধের সময় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোটের সময় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ছুটি ঘোষণার কারণে ভোট প্রদানের হার কমে যেতে পারে বলে প্রার্থীরা আশঙ্কা করেছেন। ভোটের দিন বড়জোর পরীক্ষা ও ক্লাস বন্ধ রাখা যেতে পারে। কিন্তু ভোটের আগের দিন ও পরের দিনসহ টানা কয়েক দিনের ছুটির কারণে অনেক শিক্ষার্থীই ভোটের প্রতি আগ্রহ হারাতে পারেন। তাঁদের অনেকেই বাড়ি চলে যেতে পারেন।

প্রতিপক্ষের ভোট কমাতে কোনো কোনো প্যানেল সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে যেতে উৎসাহিত করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তাও কেউ কেউ দিচ্ছেন বলে কানাঘুষা রয়েছে। এসব অভিযোগের অকাট্য প্রমাণ কেউ সম্ভবত দেখাতে পারবে না। কিন্তু অভিযোগগুলো উড়িয়ে দেওয়ারও সুযোগ কম।

এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে ঢাবি কর্তৃপক্ষ ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারে। কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য হবে শিক্ষার্থীদের ভোট প্রদানে উৎসাহিত করা। সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা।

আমাদের মনে রাখতে হবে, এই তরুণ ভোটারদের অনেকেই জীবনে প্রথম ভোট করবেন যেকোনো ধরনের নির্বাচনে। নির্বাচন ও ভোটের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াতে ছুটি না দিয়ে বরং অন্য ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারত কর্তৃপক্ষ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট প্রদান কীভাবে গুরুত্ব রাখে, সে বিষয়ে আলোচনা, বিতর্ক, চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পারত। এসব অনুষ্ঠানে শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা একযোগে অংশগ্রহণ করতে পারতেন।

এসব না করে ছুটি প্রদানের কারণে ভোটের হার কমে যাবে। ভোটের দিন ক্লাস–পরীক্ষা বন্ধ রাখা যৌক্তিক, কিন্তু এর আগে–পরে ছুটি দেওয়া ঠিক হয়নি।

ওদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দুটি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলেও পরে পরিবর্তন করেছে। পূজার ছুটির মধ্যে নির্বাচনের দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল। এটা ছিল অত্যন্ত অবিবেচকের মতো একটি সিদ্ধান্ত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা পূজার ছুটিতে বাড়ি যাবেন ও ভোট দিতে পারবেন না। একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মের বিশ্বাসী শিক্ষার্থীদের নির্বাচনের বাইরে রাখার পরিকল্পনা করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ—এমন অভিযোগ ওঠার পর অবশ্য কর্তৃপক্ষ নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন করে।

প্রথমে রাকসু নির্বাচনে প্রথম বর্ষের চার হাজার শিক্ষার্থীদের ভোটার তালিকায় রাখা হয়নি। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসে অবস্থান করবেন, কিন্তু ভোট দিতে পারবেন না। এতে তাঁদের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রতিনিধি মনোনয়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হওয়ার সুযোগ ছিল। পরে আন্দোলনের মুখে রাবি কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভোটার ও প্রার্থ হওয়ার সুযোগ দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোটকেন্দ্র স্থাপন নিয়েও প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন গণমাধ্যমের কাছে। ডাকসু নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা অপ্রতুল বলে কয়েকজন প্রার্থী অভিযোগ করেছেন। ডাকসু নির্বাচনে ভোটার ৩৯ হাজার ৭৭৫ জন। নির্বাচনে মোট প্রার্থীর সংখ্যা ৪৭১। ভিপি পদে আছেন ৪৫ জন, জিএস পদে ১৯ জন। ডাকসু ও হল সংসদ মিলিয়ে একেকজন শিক্ষার্থীকে ৪১টি ভোট দিতে হবে। ডাকসুতে ২৮টি ও হল সংসদে ১৩টি ভোট দিতে হবে একজন শিক্ষার্থীকে।

সারা দিনে প্রায় ৪০ হাজার ভোটারকে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে হলে ভোটকেন্দ্র ও বুথ বাড়াতে হবে। কারণ, ভোটকেন্দ্রে লম্বা লাইন বা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হবেন না। আটটি ভোট কেন্দ্র না করে হল ভিত্তিক কেন্দ্র করলে শিক্ষার্থীরা দ্রুততম সময়ে ভোট প্রদান করতে পারবে। কেন্দ্রগুলো হলে হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। পৃথক স্থানে একটি হলের জন্য একটি করে ভোট কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত হবে।

ভোটারদের হাতে থাকবে কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ পাতার ব্যালট। এতগুলো পাতা থেকে পছন্দের প্রার্থীকে বের করে বৃত্ত ভরাট করতে হবে। যত দূর জানা গেছে, ওএমআর ব্যালট শিট দেওয়া হবে ভোটারদের। আমরা যদি ধরে নিই, একজন ভোটারের ৮ থেকে ১০ মিনিট লাগবে ভোট সম্পন্ন করতে, তবে একটি বুথে ঘণ্টায় ৬/৭ জন ভোট দিতে পারবেন।

সারা দিনে প্রায় ৪০ হাজার ভোটারকে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে হলে ভোটকেন্দ্র ও বুথ বাড়াতে হবে। কারণ, ভোটকেন্দ্রে লম্বা লাইন বা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হবেন না। আটটি ভোট কেন্দ্র না করে হল ভিত্তিক কেন্দ্র করলে শিক্ষার্থীরা দ্রুততম সময়ে ভোট প্রদান করতে পারবে। কেন্দ্রগুলো হলে হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। পৃথক স্থানে একটি হলের জন্য একটি করে ভোট কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত হবে।

যত দূর জানতে পেরেছি, পর্যাপ্ত ওএমআর মেশিন না পাওয়ায় ঢাবি কর্তৃপক্ষ ফলাফল প্রদানে বিলম্ব হবে বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছে। অধিকসংখ্যক ওএমআর মেশিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সংগ্রহ করতে পারত। এখনো সময় আছে। বেশি সংখ্যক ওএমআর সংগ্রহ করে দ্রুত ফলাফল ঘোষণার উদ্যোগ নিতে হবে।

ভোট প্রদান ও ফলাফল ঘোষণার প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন ও আরামদায়ক করতে হবে। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। এখন ভোটকেন্দ্রে এসে যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারাতে পারেন। ভোটারবান্ধব ভোট প্রদান প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলোকে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষগুলো এমন সব সিদ্ধান্ত প্রদান করছে, যা হটকারী না বলে পারা যাচ্ছে না। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাবমূর্তি মোটেও উজ্জ্বল হবে না; বরং ভোট প্রদানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে। আমরা আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্তই গ্রহণ করবে।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সূত্র, প্রথম আলো