জনপ্রশাসন ও এর আওতাভুক্ত সিভিল সার্ভিস সংস্কার যেকোনো দেশের জন্যই একটি জটিল প্রক্রিয়া।বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে, যেখানে নীতিগত ও কাঠামোগত, উভয় ক্ষেত্রেই তা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে প্রশাসনিক দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একাধিক সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছিল। এসব কমিশন তৎকালীন নানা গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ পেশ করলেও, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত গতি প্রায়ই অর্জিত হয়নি।
অন্যদিকে, সমৃদ্ধ দেশগুলোর অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা প্রশাসনিক সংস্কারকে একটি ধারাবাহিক ও কার্যকর প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ করে সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। ঐতিহাসিকভাবেই বৈশ্বিক নেতৃত্বে থাকা শক্তিধর দেশগুলোর প্রশাসনিক মডেল প্রায়ই অন্যান্য রাষ্ট্রের জন্য দিকনির্দেশক ভূমিকা পালন করে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস মডেল আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত। বিশ্বের অনেক দেশেই এই মডেলটি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সর্বশেষ জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ২০২৫-এ ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস’ নামে একটি পরিমার্জিত ও বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত মডেল প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে।
আজ থেকে দেড়শ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল প্রশাসনে ‘স্পয়েলস সিস্টেম’ চালু ছিল, যেখানে রাজনৈতিক আনুগত্যই ছিল নিয়োগের প্রধান মানদণ্ড। তবে ১৮৮৩ সালে ‘পেন্ডলটন অ্যাক্ট’ প্রণয়নের মাধ্যমে এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে এবং মেধা ও যোগ্যতাকে গুরুত্ব দিয়ে একটি ন্যায্য ও পেশাদার সিভিল সার্ভিস গঠনের পথে অগ্রসর হয় যুক্তরাষ্ট্র। পরে ১৯৭৮ সালে ‘সিভিল সার্ভিস রিফর্ম অ্যাক্ট’ কার্যকরের মাধ্যমে ‘অফিস অব পার্সোনেল ম্যানেজমেন্ট’ এবং ‘মেরিট সিস্টেমস প্রোটেকশন বোর্ড’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আজও যুক্তরাষ্ট্রে মেধাভিত্তিক স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের অধীনে এক্সিকিউটিভ শিডিউলে অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক পদাধিকারীরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সিভিল সার্ভিসের আওতার বাইরে থাকা এই পাঁচ-স্তরীয় কাঠামোর অন্তর্গত ‘সেক্রেটারি’, ‘ডেপুটি সেক্রেটারি’ এবং ‘আন্ডার সেক্রেটারি’ পদগুলো অন্যান্য দেশের যথাক্রমে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর সমপর্যায়ের হিসেবে বিবেচিত।
২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের অসামরিক ও সামরিক জনপ্রশাসন কাঠামোর অধীনে বিভিন্ন পাবলিক সার্ভিসে প্রায় ৪৩ লাখ গণকর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। এই বৃহৎ কর্মীবাহিনী মূলত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত : সিভিল সার্ভিস ও ইউনিফর্মড সার্ভিস। ইউনিফর্মড সার্ভিসের পদগুলোয় কর্মরত ছাড়া, নির্বাহী/শাসন, আইন ও বিচার বিভাগের আওতায় সব নিয়োগভিত্তিক পদগুলোয় যারা কর্মরত, তারা সবাই সিভিল সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের আওতাভুক্ত মূলধারার সিভিল সার্ভিস তিন ধরনেরÑ১. কম্পেটিটিভ সার্ভিস/ক্লাসিফায়েড সার্ভিস, ২. এক্সসেপ্টেড সার্ভিস/আনক্লাসিফায়েড সার্ভিস, ৩. সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস।
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত চার ধররনর নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হলেনÑস্থায়ী ক্যারিয়ার অ্যাপয়েন্টি ও নন-ক্যারিয়ার অ্যাপয়েন্টি এবং অস্থায়ী লিমিটেড-টার্ম অ্যাপয়েন্টি ও লিমিটেড-ইমার্জেন্সি অ্যাপয়েন্টি। ক্যারিয়ার অ্যাপয়েন্টিরা প্রতিযোগিতামূলক ও মেধাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ দেন।
নন-ক্যারিয়ার অ্যাপয়েন্টিরা চাহিদা ও যোগ্যতা অনুযায়ী মনোনয়নের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এ ধরনের মনোনয়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও অভিপ্রায়ের ফল হিসেবে ঘটে। সাধারণত প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হলে বেশির ভাগ নন-ক্যারিয়ার অ্যাপয়েন্টি পদত্যাগ করেন। অতিরিক্ত রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিরোধে নন-ক্যারিয়ার অ্যাপয়েন্টিদের নিয়োগ সার্বিকভাবে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ সীমায় রাখার বিধান রয়েছে; অনেকে এই নিয়োগকে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ‘স্পয়েলস সিস্টেম’-এর শেষ অবশিষ্টাংশ হিসেবে বিবেচনা করেন।
অন্যদিকে, নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যপূরণে সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য অস্থায়ী লিমিটেড টার্ম অ্যাপয়েন্টমেন্টে নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া, জরুরি, অপ্রত্যাশিত বা বিপর্যয়ের পরিস্থিতিতে ১৮ মাসের লিমিটেড ইমার্জেন্সি টার্ম অ্যাপয়েন্টমেন্টে নিয়োগ করা হয়। সামগ্রিকভাবে, এই দুই ধরনের লিমিটেড অ্যাপয়েন্টির সংখ্যা সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস পদের মোট সংখ্যার ৫ শতাংশের বেশি হতে পারে না।
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসের আওতাভুক্ত পদগুলো প্রধানত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত : ক্যারিয়ার-রিজার্ভড এবং জেনারেল। প্রায় অর্ধেক পদ ক্যারিয়ার-রিজার্ভড এবং বাকি অর্ধেক জেনারেল শ্রেণিভুক্ত। ক্যারিয়ার-রিজার্ভড পদ শুধু ক্যারিয়ার কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত। অন্যদিকে, জেনারেল পদ উপর্যুক্ত চার ধরনের জন্যই উন্মুক্ত।
কর্মকর্তাদের পদমর্যাদা ও বেতন একে অন্যের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত নয়; বরং এ দুটি বিষয়ই প্রধানত কর্মদক্ষতা ও পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করে। সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসের জন্য কোনো নির্দিষ্ট পে-গ্রেড নেই, তবে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ পে-ব্যান্ড নির্ধারিত রয়েছে।
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস অফিসার ডাইরেক্টর সমমান থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি সমমান পদে কাজ করে থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন।
২০০৮ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যারিয়ার সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস অফিসারদের অধিকাংশের বয়স ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে এবং তাদের কর্মজীবনে গড়ে ২০ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা থাকে। সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস সদস্যদের পদ ও পদায়ন অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা সাধারণত মার্কিন সামরিক বাহিনীর এক তারকা ও তদূর্ধ্ব জেনারেল/ফ্ল্যাগ অফিসারদের পদমর্যাদার সমতুল্য হিসেবে গণ্য করা হয়।
কার্যকারিতা ও সুশাসনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসের কাঠামো থেকে কিছু সংস্থা ও পদকে সচেতনভাবে পৃথক রাখা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে আইনসভা ও বিচার বিভাগের অধীন সংস্থা, স্বাধীন সরকারি করপোরেশন, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক কমিশন, বিভিন্ন নিরাপত্তা, আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা এবং কূটনৈতিক মিশনের নির্দিষ্ট কিছু পদ ইত্যাদি।
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস গঠনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সুশাসনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে ফেডারেল সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ব্যবস্থাপনা দক্ষতা দ্বারা সহায়তা প্রদান এবং বিভিন্ন স্তরের ক্যারিয়ার সিভিল সার্ভেন্টদের জন্য কার্যকর নেতৃত্ব নিশ্চিত করা। পাশাপাশি, এই কাঠামোর লক্ষ্য ছিল কর্মকর্তাদের ‘জেনারেলিস্ট’ বা ‘ম্যান্ডারিন’ হিসেবে গড়ে তোলা, যাতে তারা বিভিন্ন সংস্থায় রোটেশনের মাধ্যমে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি নীতি-বাস্তবায়ন ও নীতিনির্ধারণের মধ্যে কার্যকর সেতুবন্ধ বজায় রাখতে পারেন।
বাস্তবে, অধিকাংশ সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস কর্মকর্তা নিজ নিজ এক্সিকিউটিভ ডিপার্টমেন্ট (মন্ত্রণালয়) এবং আওতাভুক্ত সংস্থায়, অর্থাৎ একই সেক্টরে, কর্মজীবনের বড় সময়টুকু অতিবাহিত করে থাকেন। এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্রমবর্ধমান জটিলতা ও বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা।
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সিভিল সার্ভিস জনস্বার্থে কাজ করে। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর অযাচিত হস্তক্ষেপ সুশাসনকে কর্তৃত্ববাদী ও দুর্বল শাসনে পরিণত করে। ফলে টেকসই উন্নয়ন থমকে গিয়ে, দারিদ্র্য-বেকারত্ব দূরীকরণ এবং পরিবেশগত চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে বাধা সৃষ্টি হয়। তাই দক্ষতাভিত্তিক পেশাদার সিভিল সার্ভিস কাঠামো এই সমন্বিত রূপান্তরের পথে অগ্রগতির অন্যতম চাবিকাঠি।
এই উদ্দেশ্যে গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম যদি শুধু বিদ্যমান কর্মরতদের একক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়, তাহলে তা স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে ওঠে। ফলে সংস্কার কার্যক্রম টেকসই না হয়ে বরং জনকল্যাণকে ব্যাহত করে। অন্যদিকে, কোনো একক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে সংস্কার কার্যক্রম ছেড়ে দিলেও সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী স্বার্থে সংস্কার কার্যক্রম পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। তাই জনপ্রশাসন ও এর আওতাভুক্ত সিভিল সার্ভিসের সংস্কার অবশ্যই হতে হবে সুষম, স্বচ্ছ ও অংশীজন অন্তর্ভুক্তিমূলক; যেখানে বিশেষজ্ঞ মতামত, নাগরিক চাহিদা এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে জনকল্যাণই হবে চূড়ান্ত মানদণ্ড। কারণ সব সংস্কার-প্রচেষ্টার মূল লক্ষ্য একটাইÑজনকল্যাণ।
লেখক : বিসিএস কর্মকর্তা, তথ্য