শেখ হাসিনার দেড় দশকের নিপীড়নমূলক শাসনের পক্ষে বৈধতা উৎপাদনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে এ দেশের কথিত সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম। সে সময় গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বক্তব্য এবং বিবৃতিগুলো পর্যালোচনা করলে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের আগে সারা দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও প্রকাশ্য রাজপথে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গুলি করে হত্যা এবং পঙ্গু করা হয়েছিলো। তখন সুশীল সমাজের এই প্রতিনিধিরা শুধু নীরব ছিল না, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাতে সমর্থন দিয়েছে। গণমাধ্যমে মৌলবাদ দমনের নামে সরকারের নিপীড়নের পক্ষে সাফাই গেয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং রাজনৈতিক নিপীড়ন নিয়ে যখন সোচ্চার ছিল, তখন একমাত্র ‘অধিকার’ ছাড়া সব মানবাধিকারের দোকানদাররা ছিলেন অনেকটা নীরব। তাদের অনেকে গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে সরকারের নিপীড়নকে সমর্থন দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের সমর্থনের জোরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ আসনে বিজয়ী হয়ে তার ফ্যাসিবাদী শাসন ভিত্তি মজবুত করেছিলেন। ফলে এ দেশের কথিত সুশীল সমাজের সম্পর্ক অনেক নিবিড় ও জোরালো। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর এই সুশীল সমাজের অনেকে তাদের রূপ বদলে ফেলেন।
হাসিনার পতন আন্দোলনের একেবারে শেষের দিকে তাদের অনেকে তাতে যোগ দেন। যদিও এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া এবং মাঠের নেতৃত্ব ছিল নিপীড়িত রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে। এই আন্দোলন যদি প্রকাশ্য বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের নেতৃত্বে হতো, তাহলে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ এই আন্দোলন বিএনপি- জামায়াতের আন্দোলন বলে দমনের পক্ষে বৈধতা উৎপাদন করত।
যদিও অরাজনৈতিক এই আন্দোলনের পেছনে যে রাজনৈতিক দলগুলোর বড় ধরনের ভূমিকা আছে, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হয়নি। শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডে এখন আমরা শুনতে পাচ্ছি, শিবির ও ছাত্রদলকে নির্মূলের জন্য তিনি বারবার নির্দেশনা দিয়েছেন। একপর্যায়ে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বছর পর আমরা সুশীল সমাজের সেই প্রতিনিধিদের আবার আগের রূপে ফিরে আসতে দেখছি। জাতিকে বিভেদ ও বিভাজনের মতলবি কৌশলের পাশাপাশি তারা এখন গ্রেপ্তার হওয়া আওয়ামী লুটেরাদের মুক্তি দাবি করছেন। সম্প্রতি সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত ১১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি জনতা ব্যাংক লুটের হোতা অধ্যাপক আবুল বারকাতের মুক্তি দাবি করেছেন।
আওয়ামী আমলে দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে লোপাট হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক এর বাইরে ছিল না। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয়েছিল অধ্যাপক আবুল বারকাতকে। তিনি অ্যাননটেক্স গ্রুপ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিলেন। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
ঋণ কম দেখাতে ব্যাংক তাদের নিরীক্ষিত বার্ষিক প্রতিবেদনে এই প্রতিষ্ঠানকে তিনটি পৃথক গ্রুপ বলে উল্লেখ করে। নিয়মনীতি ভেঙে এক গ্রাহককে বেশি ঋণ দেওয়ার তথ্য লুকাতেই এই চাতুরীর আশ্রয় নেওয়া হয়। এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার কারণে ব্যাংকটিকে ধ্বংস করার জন্য আবুল বারকাতকে অভিযুক্ত করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, ‘বারকাত (জনতা ব্যাংক) এটাকে শেষ করে দিয়েছে। অথচ এটা ছিল দেশের একটা সেরা ব্যাংক।’
এ ধরনের একজন অপরাধীকে দুর্নীতি দমন কমিশন সুস্পষ্ট অভিযোগের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার করে। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আবুল বারকাতের মুক্তি দাবি করে দেওয়া বিবৃতিতে বলেছেন, বিবৃতিতে দেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, গবেষক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবুল বারকাতকে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অধ্যাপক বারকাত গত প্রায় ৪০ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। বিবৃতিতে নাগরিকরা জানিয়েছেন, তারা অধ্যাপক বারকাতের সরল-নির্মোহ প্রাত্যহিক জীবনযাপন দেখেছেন এবং তার সম্পর্কে জানেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই তাকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানো তাদের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে আছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হামিদা হোসেন, সুলতানা কামাল, জেড আই খান পান্না, রাশেদা কে চৌধূরী, শিরিন প. হক, খুশী কবির, শাহীন আনাম, অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী, অধ্যাপক এম এম আকাশ, অধ্যাপক মো. ফেরদৌস হোসেন, স্বপন আদনান, মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক সেলিম রায়হান, শামসুল হুদা, অধ্যাপক রুমানা হক, সুব্রত চৌধুরী, সঞ্জীব দ্রং, সাঈদ আহমেদ, মনীন্দ্র কুমার নাথ, তসলিমা ইসলাম, কাজল দেবনাথ, অধ্যাপক অতনু রব্বানী, দীপায়ন খীসা, এস এম আবদুল্লাহ প্রমুখ। (প্রথম আলো ১৭ আগস্ট ২০২৫)
এই বিবৃতির মাধ্যমে জালিয়াতি ও ব্যাংকলুটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির পক্ষে শুধু এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা দাঁড়াননি, তারা বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছেন। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে প্রশ্ন, মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ও স্বাধীনতার ঘোষক, সাবেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রী ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ৮০ বছর বয়সি বেগম খালেদা জিয়াকে যখন মিথ্যা মামলায় কারাগারে নেওয়া হয়েছিল, তখন তাদের বিবেক কোথায় ছিল?
বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে আরেকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এতিমখানার টাকা ট্রান্সফারজনিত জটিলতার কারণে মামলা করা হয়েছিল। যে টাকা ব্যাংকে আছে। অথচ হাসিনা ও গণবিরোধী প্রচারমাধ্যম প্রতিনিয়নত তার বিরুদ্ধে এতিমের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করতেন। ভুয়া মামলায় জেলে নেওয়ার পর তিনি গুরুতর লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হন। হাসপাতালে তার সুচিকিৎসা হয়নি। বারবার বিদেশে চিকিৎসার জন্য আবেদন করা হয়েছিল। তখন এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কোনো বিবৃতি দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি। এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী একজন নারীর সুচিকিৎসার দাবি পর্যন্ত করেননি।
এখন একজন লুটেরার মুক্তিযুদ্ধ কিংবা শিক্ষক পরিচয় সামনে এনে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। এই কথিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামগুলো এ দেশের মানুষের কাছে অপরিচিত নয়। হাসিনার দেড় দশকের শাসনে এই ব্যক্তিদের অনেকে দুঃশাসনের পক্ষে বয়ান তৈরি করেছেন। এই বিবৃতি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। আগামী দিনে আওয়ামী দুর্বৃত্ত লুটেরাদের কীভাবে আইনি প্রক্রিয়া থেকে বের করে সমাজে স্বাভাবিক করা হবে, তার একটি নমুনা মাত্র। এমনকি নির্যাতিত হিসেবে তুলে ধরা হতে পারে। এদের অপরাধকে আড়াল করতে সেই পুরোনো মুক্তিযুদ্ধ কার্ড আবার খেলা হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বছর যেতে না যেতেই তারা প্রকাশ্য আবুল বারকাতের মতো চিহ্নিত আর্থিক খাতের একজন বড় দুর্বৃত্তকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। আমরা হয়তো আগামী দিনে দেখব বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত রাবীন্দ্রিক অর্থনীতিবিদ আতিউর রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে সম্মানে তারা কোনো পদে বসানোর দাবি জানাবেন। কিংবা মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে ছাত্র-জনতার হত্যার অন্যতম নির্দেশদাতা ঢাকার কসাই হিসেবে পরিচিত আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে বিবৃতি দিতে পারেন। আবুল বারকাতের বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে এই কথিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিবৃতি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। তারা যে ছাত্র-জনতার হত্যাকারীদের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নানা চেষ্টা চালাবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই বিবৃতির মধ্যে লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের অশনিসংকেত।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বছরের মধ্যে অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির মধ্যে বিভেদ-বিভাজন বাড়ছে। এই সুযোগে ফ্যাসিবাদের পুরোনো সহযোগীরা আগের রূপে ফিরে আসছেন। আগামী দিনে তারা আবার গণমাধ্যমে সরব হবেন। আবুল বারকাতের মুক্তির দাবি একটি টেস্ট কেস মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সামনে রেখে তারা আবার সমাজের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির খেলায় মেতে উঠবেন। ইতোমধ্যে তারা মৌলবাদের উত্থানের ন্যারেটিভ সামনে আনতে সক্ষম হয়েছেন। ভুলে গেলে চলবে না—এই ন্যারেটিভের ওপর ভিত্তি করে জন্ম হয়েছিল শাহবাগের। সেখান থেকে দেড় দশকে ফ্যাসিবাদের জগদ্দল পাথর জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিল। প্রায় দেড় হাজার মানুষের আত্মগোপন ও ২০ হাজার মানুষের পঙ্গুত্ব এবং অন্ধত্ববরণের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান ঘটেছে। কিন্তু এক বছর না যেতেই ফ্যাসিবাদের সহযোগী সফট পাওয়ার সরব হয়ে উঠেছে। তারা এখন বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। এরপরও যদি ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের হুঁশ না হয়, তাহলে সামনে অন্ধকার সময় অপেক্ষা করছে।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ