সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, কিছু শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের রুমে গিয়ে একজন শিক্ষকের পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন করছেন। সেই শিক্ষক সম্পর্কে অভিযোগ, তিনি বিগত স্বৈরশাসনের সময় বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছেন। শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের ধরন ছিল তীব্র; একজন বলেন, ‘আমরাই আপনাকে এই পদে বসিয়েছি। আপনি নিজের যোগ্যতায় আসেননি।’ একই ধরনের অসন্তোষ দেখা গেছে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও, যেখানে একটি জনপ্রিয় ফেসবুক গ্রুপে এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের বিবৃতিতে শিক্ষক পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে গোপালগঞ্জে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়নি।
ফেসবুকে এসব ঘটনা ঘিরে বিতর্ক, সমর্থন এবং বিরোধিতার নানা প্রকাশ দেখা গেছে। কেউ কেউ এর জন্য দোষারোপ করছেন প্রফেসর ইউনূসকে, যিনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষার্থীরাই আমাকে নিয়োগ দিয়েছে।’ এটি শিক্ষার্থীদের এক ধরনের কর্তৃত্বের মনোভাব দিয়েছে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এসব আলোচনার মধ্যেও আমরা মূল প্রশ্নটি হারিয়ে ফেলছি : কেন উপাচার্যদের প্রতি এত অসন্তোষ জমেছে? কেন একজন উপাচার্যকে শুনতে হচ্ছে—‘আপনি নিজের যোগ্যতায় আসেননি’?
এই প্রশ্নের উত্তর কাঠামোগত বিশ্লেষণে নিহিত। বাংলাদেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া (ঢাবি, রাবি, জাবি ও চবি) অন্য কোথাও উপাচার্য নিয়োগ একাডেমিক কাউন্সিলের মাধ্যমে হয় না। উপরন্তু, এসব স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়েও সিনেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের ভূমিকা নামমাত্র। বাস্তবে, উপাচার্য নিয়োগ হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে, যেটি ‘টপ ডাউন’ প্রক্রিয়ার অংশ। এই প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্য উপাচার্যকে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও আদর্শিক ছাঁচে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়। এই ছাঁচটি গঠিত হয় শিক্ষক রাজনীতি, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা এবং ক্ষমতাসীনদের কাছে আনুগত্যের মিশ্রণে।
এই গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আছে একটি নির্দিষ্ট লাইফস্টাইল। শিক্ষকদের রাজনৈতিক ফেডারেশনের নেতৃত্বে ওঠা, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে থাকা আর শেষে দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা—এসবই একজন উপাচার্য হওয়ার রোডম্যাপ। কেউ কেউ সংবাদপত্রে শত শত কলাম লিখে আদর্শিক আনুগত্য প্রমাণ করেন। কারো প্রভাবশালী নেতার বাসায় নিয়মিত যাতায়াত, আবার কেউ সাংসদের মতো অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফারেন্সে আমন্ত্রণ জানিয়ে সিগন্যাল পাঠান। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়, যা উপাচার্য পদে নিয়োগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
একজন শিক্ষকের কাছে শিক্ষকতা নয়, বরং রাজনৈতিক যোগাযোগ, আনুগত্য আর দলীয় রাজনীতির প্রতি নিবেদিত থাকার বিষয়টাই হয়ে ওঠে উপাচার্য হওয়ার মাপকাঠি। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয় হারিয়ে ফেলে তার মূল চরিত্র—একটি জ্ঞানভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও মুক্ত চিন্তার কেন্দ্র। যে শিক্ষকরা ছাত্র-বন্ধুসুলভ এবং চিন্তার স্বাধীনতাকে মূল্য দেন, তারা এই প্রতিযোগিতায় ক্রমেই পেছনে পড়ে যান। ফলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে উঠে আসেন এমন শিক্ষকরা, যাদের কাছে প্রশাসনিক পদ মানেই নিয়ন্ত্রণ, নয় শোষণমূলক কর্তৃত্ব।
যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদ শূন্য হয়, তখন এই ‘সিস্টেমে’ গড়া লোকদের মধ্য থেকে একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সুপারিশ আসে দলের ভেতর থেকে, অনেক সময় অর্থ বা জনবল সরবরাহও এই প্রক্রিয়ার অংশ হয়। এমনকি কখনো কখনো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেন পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ে। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সিন্ডিকেট বা একাডেমিক কাউন্সিলের মতামত একেবারে উপেক্ষিত থাকে। ফলে নিযুক্ত উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রদায়ের কাছে নয়, বরং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্যরা বেশির ভাগ সময় বাইরের লোক হন। ফলে প্রশাসন পরিচালনায় তিনি প্রথমেই নির্ভর করেন দলীয় শিক্ষক ও ছাত্রনেতাদের ওপর। এতে গড়ে উঠে এক ধরনের প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক, যেখানে প্রশাসনিক পদবণ্টন, প্রমোশন, সুযোগ-সুবিধা—সবকিছু হয় পক্ষপাতদুষ্টভাবে। একদিকে সুবিধাভোগীরা এগিয়ে যান, অন্যদিকে প্রগতিশীল বা নিরপেক্ষ শিক্ষকরা প্রান্তিক হয়ে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পরিবেশ হয়ে ওঠে একটি বিভক্ত, দলবাজ এবং নিপীড়নমূলক কাঠামো।
এই সংস্কৃতির ফলে শিক্ষকরা লিখতে ভয় পান, সমালোচনা করতে ভয় পান। উপাচার্যের বিরুদ্ধে কথা বললে প্রমোশন আটকে যেতে পারে, এমন বাস্তবতা তৈরি হয়। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক হয়ে পড়ে কৃত্রিম। শিক্ষার্থীরা বুঝে ফেলেন যে তার শিক্ষক আদর্শ নয়, বরং পক্ষবিশেষের প্রতিনিধি। একাডেমিক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও চলাফেরার অধিকার সীমিত হয়ে পড়ে। এই সবকিছু মিলিয়ে উপাচার্যের প্রতি যে অসন্তোষ জমে, তা বিস্ফোরিত হয় কোনো একটি ঘটনার মাধ্যমে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই নৈরাজ্যিক নিয়োগপ্রক্রিয়ার ফলেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ জমেছে। ফলে যখন অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তারা নিজেদের কর্তৃত্বের বাস্তবায়ন দেখতে পান, তখন অনেক ক্ষেত্রে তারা দায়িত্ব ও শালীনতার সীমা ভুলে যান। অথচ এই জায়গাতেই অভ্যুত্থানের চেতনা সফল-ব্যর্থ হওয়ার পরীক্ষা। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন তোলা জরুরি, কিন্তু সেই প্রশ্ন হোক যুক্তিপূর্ণ, শ্রদ্ধাশীল এবং নৈতিক ভিত্তিতে দাঁড়ানো।
আমি নিজে এমন একজন উপাচার্যের কথা জানি, যিনি হাসতে হাসতে বলতেন, ‘ছেলেকে মেয়ে আর মেয়েকে ছেলে ছাড়া উপাচার্য সবই পারেন।’ এ কথাটি যেন এক ধরনের ‘সীমাহীন ক্ষমতা’-চর্চার প্রতীক। এমন প্রশাসনিক কাঠামোতে গণতান্ত্রিক রেজিস্ট্যান্স গড়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। আন্দোলন হয়, কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী ট্যাগের ভয়ে তা দমনযোগ্য থাকে। ফলে আবরার, আবু বকর, সাম্যদের প্রাণ দিতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাপ মোচনে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় এক ধরনের রাজনৈতিক থিয়েটারে, যেখানে সত্য এবং ন্যায়ের জায়গা দখল করে নেয় আনুগত্য এবং সুবিধাবাদ।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে অভ্যুত্থান হয়েছিল, তা এই কাঠামোতে একটি ফাটল তৈরি করেছিল। শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় দুটোর মালিকানা দাবি করেছিল। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পরিবর্তন হয়, তবে নিয়োগের পদ্ধতি বদলায়নি। আগের জায়গায় একাধিক রাজনৈতিক দলের সুপারিশ আর শিক্ষার্থীদের ‘ভূমিকা’ যোগ হয় মাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ স্বীকার করেছেন, ‘ছাত্রদের অনুরোধেই এই দায়িত্ব নিয়েছি।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো—এতে কাঠামোগত কিছু কি পাল্টেছে?
রাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদ না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক চরিত্র পাল্টায়নি। পুরোনো ক্ষমতাবান শিক্ষকরা এখনো জায়গা আঁকড়ে ধরে আছেন। একজন সহকর্মী বলেছেন, ফেসবুকে লেখার কারণে তিনি প্রমোশন পাননি। আরেকজন জানালেন, যারা আগে উপাচার্যের আশপাশে ঘুরতেন, তারাই এখনো ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রশাসনিক পরিবর্তন হয়নি মানেই শিক্ষার পরিবেশও বদলায়নি।
যদি স্বচ্ছ মানদণ্ড না থাকে, তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দিয়ে উপাচার্য বদলানো যাবে, কিন্তু পরিবর্তন আসবে না। কুয়েট, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য বদল হলেও তা টেকেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অসুখ অনেক গভীরে। এর সমাধান শুধু উপাচার্য বদল নয়, বরং একটি সমন্বিত কাঠামোগত সংস্কার।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীরা ন্যূনতম অধিকার পাচ্ছে না। হল, ক্যানটিন, ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, শিক্ষক—সবকিছুতে সংকট। শিক্ষকদের প্রমোশনের জন্য আন্দোলন করতে হয়। আর অভ্যুত্থানবিরোধী শিক্ষকরা নির্ভয়ে পদোন্নতি পাচ্ছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি বহাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো এবং মানবিক পরিবেশ—দুটোই অবনতির দিকে যাচ্ছে।
এই বাস্তবতায় চট্টগ্রামের ঘটনার মতো ঘটনা হয়তো আরো ঘটবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার অনুরোধ, প্রশ্ন করুন, কিন্তু অপমান নয়। উপাচার্যকে জবাবদিহির মধ্যে আনা গণতন্ত্রের চর্চা; কিন্তু তাকে লাঞ্ছনা করা গণতন্ত্রের বিপরীত। স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্ববোধ জরুরি। আন্দোলনেরও শিষ্টাচার আছে। শিক্ষার্থীদের ত্যাগ যেন অহংকারে পরিণত না হয়, বরং তা হোক পরিণত এবং দূরদর্শী নাগরিকের পরিচয়।
ইউজিসির উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা। স্বচ্ছ সার্চ কমিটির মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের যৌথ মতামত প্রতিফলিত হবে। একাডেমিক নেতৃত্বকে আদর্শিকতা, মানবিকতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে।
উপাচার্যদের নিজেকে শুধু প্রশাসক নয়, শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যেন শিক্ষার্থীরা দেখে বলে, ‘স্যার, আমরা গর্ব করি যে আপনি আমাদের শিক্ষক।’ আপনি যেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একজন মডেল হয়ে উঠতে পারেন, একজন এমন শিক্ষক, যাকে দেখে শিক্ষার্থীরা বিশ্বাস করতে পারে—গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং মর্যাদা এখনো বেঁচে আছে আমাদের শিক্ষাঙ্গনে। শুধু তাহলেই বিশ্ববিদ্যালয় আবার মুক্তচিন্তা, ন্যায়বিচার ও মর্যাদার জায়গা হয়ে উঠতে পারে।
লেখক : শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র