দশকের পর দশক ধরে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অরগানাইজেশন (ন্যাটো) যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে। যেকোনো প্রতিকূলতা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সংগঠনটি প্রবল আত্মবিশ্বাসী। এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের পেছনে ব্যাপক ব্যয় করেছে। স্টেলথ বিমান, নিখুঁত অস্ত্র, গোপন সাবমেরিন ও বিশালাকার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার পাশ্চাত্যের রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করে আসছে।
এই ক্ষমতাকে এত দিন ধরে অপরাজেয় মনে হচ্ছিল। সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখে ইউক্রেনের ওপর আক্রমণের সময় ২০টির বেশি রাশিয়ান ড্রোন প্রতিবেশী রাষ্ট্র পোল্যান্ডে ঢুকে পড়ে। ফলে ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে মিলিয়ন মিলিয়ন ইউরো খরচ করে বানানো অস্ত্রশস্ত্র জড়ো করতে হয়, যাতে তারা আকাশপথে আসন্ন যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এফ-১৬ ও এফ-৩৫ ফাইটার জেট, সামরিক হেলিকপ্টার এবং ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য প্যাট্রিয়ট মিসাইল সিস্টেম প্রভৃতি। শাহেদসহ বেশ কিছু বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। এর মধ্যে কতগুলো ছিল খুবই অল্প খরচে তৈরি ডামি ড্রোন।
ড্রোন প্রতিহত করার ব্যাপারটি শুধু ব্যয়বহুলই ছিল না, এটা পাশ্চাত্যের সামরিক সক্ষমতার মিথও ভেঙে দিয়েছে। ট্রিলিয়ন ডলারের বিশাল ‘মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’ ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে মাত্র দুই ডজন সস্তা ড্রোনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারল না। এরপর কিছুদিন অজ্ঞাত পরিচয় কিছু ড্রোন নরওয়ে, জার্মানি ও ডেনমার্কের কয়েকটি এয়ারপোর্ট বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে এয়ারলাইনগুলোর মিলিয়ন ইউরোর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর বেলজিয়ামে তো সামরিক ঘাঁটির পাশেই ড্রোন উড়তে দেখা গেছে।
ইউরোপীয় মিডিয়াগুলো অজ্ঞাত পরিচয় ড্রোন, এয়ার ডিফেন্স আর সম্ভাব্য রাশিয়ার আক্রমণের প্রতিবেদন দিয়ে ভরে গেছে। রোমানিয়া বলুন কিংবা পোল্যান্ড বা বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো—পূর্ব ইউরোপের ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর বর্ডারজুড়ে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে জনগণ আসলেই নিরাপদ বোধ করছে।
রাশিয়ার বাহিনী যদি আক্রমণে যেত তাহলে কী হতো, তা অনুমান করা কঠিন। একটি রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে ন্যাটোর ধারা-৫ অনুযায়ী কতগুলো রাষ্ট্র আসলেই আক্রান্ত রাষ্ট্রটির প্রতি সামরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসত? যারা এগিয়ে আসত তারা কত দ্রুত আসত? যতক্ষণে তারা আসত ততক্ষণে রাশিয়ার বাহিনী কতদূর এগিয়ে আসত? আসল প্রশ্ন হচ্ছে, ন্যাটো ও তার আধুনিক প্রযুক্তির পক্ষে কি এ রকম আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব?
ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে আমরা বুঝতে পারি এই প্রশ্নের উত্তর হবে ‘না’। রাশিয়ার বাহিনী যুদ্ধে যে সংযম দেখিয়েছে, তা কেবল একনায়কতন্ত্রের অধীনেই সম্ভব, যেখানে সৈন্যরা মারাত্মকভাবে মতাদর্শ-প্রভাবিত এবং তারা শত্রুর চেয়ে তাদের নেতাকে বেশি ভয় পায়।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে যে যুদ্ধকৌশল গড়ে উঠেছে, তা আর আগের মতো কার্যকর নয়; অন্তত জেনারেলরা এককালে যতটা দাবি করতেন ততটা নয়। ইউক্রেনের সম্মুখ সমরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, কীভাবে এখানে নিত্যনতুন সামরিক কৌশলের প্রয়োগ হচ্ছে।
বাজেট ও সামরিক সক্ষমতায় এত সমৃদ্ধ একটি দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইউক্রেনকেও দ্রুত মানিয়ে নিতে হয়েছে। ইউক্রেন রাশিয়ার অস্ত্রগুলোর বিপক্ষে ড্রোন ব্যবহার করতে শুরু করে, কিন্তু শত্রুপক্ষও হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। রাশিয়া ট্যাঙ্কের টারেটের উপর মেটাল কেস ব্যবহার করা শুরু করল, যাতে বোমার আঘাতেও টিকে থাকতে পারে।
আর্মি ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেমের ক্লাস্টার গোলাবারুদ দ্বারা পরিচালিত নিখুঁত আঘাত তাদের শিখিয়েছে—গোলাবারুদগুলো ছোট ছোট স্থানে ছড়িয়ে রাখতে, যাতে সৈন্য ও সরঞ্জামের ঘনত্ব এড়িয়ে চলা যায়।
উভয় পক্ষের ড্রোনই যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন পর্যবেক্ষণে রাখে, কিন্তু সামনে শুধু পোড়া মাটিই দেখা যায়—না কোনো ট্যাঙ্ক, না কোনো পদাতিক বাহিনী নজরে আসে। রাশিয়ার সম্মুখবাহিনী রাতের বেলা খুব গোপনীয়তার সঙ্গে সামনের দিকে এগোয়। দুই বা তিনজনের গ্রুপ আস্তে আস্তে বোমায় আক্রান্ত এলাকা পার হয়। এরপর তারা সারপ্রাইজ আক্রমণের জন্য একত্রিত হয়। উভয় পক্ষের সৈন্যরাই মাটির গভীরে খনন করে অবস্থান করছে। ফলে যা দেখা যায়, তা হচ্ছে শুধু আহত-নিহতের হিসাব, যা প্রতি সপ্তাহে সংখ্যায় প্রায় কয়েক হাজার।
ইউরোপ কি এ রকম যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত? ন্যাটো সৈন্যরা কি ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কোনো ধরনের যোগাযোগ ছাড়া এমন ছোট ছোট গর্ত ও ধ্বংসস্তূপের মধ্যে টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে অবস্থান করার জন্য প্রস্তুত?
গত বছর গ্যালাপ কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে এই প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তর পাওয়া গেছে। পোল্যান্ডে ৪৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, বিপন্ন বোধ করলে তারা সাগ্রহে তাদের দেশের জন্য কাজ করবেন। কিন্তু স্পেনে এই সংখ্যা ছিল ২৯ শতাংশ; জার্মানিতে মাত্র ২৩ শতাংশ; ইতালিতে আরো কম, মাত্র ১৪ শতাংশ; ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় এর গড় ছিল ৩২ শতাংশ।
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চতুর্থ বছরে পা দিতে দিতে ইউক্রেন নিজেই জনবল শক্তির অভাবে ভুগছে। ইউক্রেনীয় মিডিয়া ও পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা ক্রমেই অজনপ্রিয় হচ্ছে আর ইচ্ছাকৃতভাবে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়া থেকে পালিয়ে বেড়ানোর ঘটনাও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। পশ্চিমা অস্ত্র ও ফান্ডিং সত্ত্বেও সৈন্যের অভাবে ইউক্রেন প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ভালো করেনি, আবার কোনো অর্থপূর্ণ আক্রমণও চালাতে পারেনি।
যুক্তরাজ্যসহ ন্যাটোর ইউরোপীয় জোটে বর্তমানে ১৪ লাখ ৭০ হাজার সামরিক বাহিনীর সদস্য কর্মরত আছে। ইউক্রেনের সঙ্গে তুলনা করার আগ পর্যন্ত এই সংখ্যাটিকে একটি বিরাট সংখ্যা বলেই মনে হয়। কারণ এক হাজার কিলোমিটার জুড়ে ছয় লাখ রাশিয়ান ফোর্সের মোকাবিলা করছে আট লাখের ইউক্রেনীয় বাহিনী, তবুও ইউক্রেনীয় বাহিনী শুধু পিছু হটছে।
এর পরের প্রশ্নটি আরো গুরুতর—আসলেই কতগুলো দেশ ইস্টার্ন ফ্রন্টে তাদের সৈন্য পাঠাবে? আর পাঠালেও তারা সংখ্যায় কতজন হবে? ইস্টার্ন ফ্রন্টে যে কয়টা দেশ ন্যাটোভুক্ত শুধু তারাই কি কেবল নিজেদের ডিফেন্ড করার জন্য থেকে যাবে? আর পশ্চিমারা শুধু অস্ত্র দেবে? এর ফলে কি সংগঠনটির মধ্যে শুধু বিভেদ দেখা দেবে, নাকি এটা ভেঙেও যেতে পারে?
মোটামুটি ধরনের নিরাপত্তা রক্ষা করতে হলেও ইউরোপের সামনে মাত্র দুটি পথ খোলা আছে—এক. হয় ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ইউরো খরচ করে নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে, অন্যথায় ইউক্রেনকে পূর্ণ মাত্রায় আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে এই যুদ্ধের অবসান ঘটানো। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়াকে কোণঠাসা রাখতে তার দেশের প্রতিবছর ৬০ বিলিয়ন ডলার দরকার। এটা পাশ্চাত্যের ঘাড়ে অনেক বড় বোঝা, বিশেষ করে এই দুর্দিনে। কিন্তু ইউক্রেন যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার তুলনায় এটা কিছুই নয়—আর্থিক ক্ষতি, জীবনহানি, এলাকা হারানো, আর অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি তো আছেই।
ইউরোপ যখন ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসাব কষছে, তখন ইউক্রেনকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। যত দিন গড়াচ্ছে, এই যুদ্ধ পশ্চিমের দিকে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও তত বাড়ছে। এখন সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার।