ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম হয় ইংল্যান্ডে ১৬০১ সালে। ভারতবর্ষে তাদের আগমন মোগল আমলে ১৬১০-এর দিকে। ওই সময় তারা পর্তুগিজ বণিকদের তাড়িয়ে প্রথম ঘাঁটি গাড়ে সুরাটে। ১৬১৪ সালে তাদের প্রতিনিধি টমাস রো, সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে এক বাণিজ্য চুক্তি সই করে। সেই চুক্তির সুবাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের অন্যান্য জায়গায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ডালপালা বিস্তৃত করতে শুরু করে। তারপর প্রায় ১৫০ বছর বণিক বেশে তারা বাস করে এদেশে। অবশেষে ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যুদ্ধে হারিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বণিক থেকে ভারতের মালিক হওয়ার পথ খোলাসা করে।
বৃহত্তর বাংলা-বিহার প্রদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শুল্কমুক্ত অবাধ বাণিজ্য প্রসারে তৎকালীন নবাব আলীবর্দী খাঁ একসময় তাদের পথের কাঁটা হয়ে ওঠেন। তাই ১৭৫২-তেই তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ‘যে করেই হোক নবাবকে সরিয়ে কোম্পানির বশংবদ কারো হাতে সুবে বাংলার শাসনভার তুলে দিতে হবে’। ১৭৫৬ সালে নবাবের মৃত্যু হলে তার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা মাত্র ২৩ বছর বয়সে বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন। আশপাশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক এবং সামরিক উপস্থিতির তাৎপর্য কত ভয়াবহ এবং মারাত্মক হতে পারে যুবক নবাব তা ভালো করেই বুঝতে পারেন। তার রাজকার্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নাকগলানো নবাব খুব অপছন্দ করতেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে একসময় নবাব কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করেন। বিনা কারণে এবং নবাবের অনুমতি ছাড়া কোম্পানির লোকজন দ্বারা ফোর্ট উইলিয়ামে অতিরিক্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ জড়ো করা। ১৭১৭ সালে মোগলদের থেকে পাওয়া ট্রেড পারমিটের অজুহাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় ব্যবসার জন্য নবাবকে নিয়মমাফিক শুল্ক দিতে অস্বীকার করা। এতে নবাবের রাজস্ব আয়ে মারাত্মক ঘাটতি দেখা দেওয়া। রাজভল্লবের ছেলে চন্দ্রদাশ ঢাকায় সরকারের বিশাল অঙ্কের তহবিল তছরুপ করে পালিয়ে গেলে নবাবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোম্পানি কর্তৃক তাকে ফোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় দেওয়া। এ ছাড়া কোম্পানির পক্ষে নবাবের স্বার্থের বিরুদ্ধে মাড়ওয়ারি মার্চেন্ট জগৎ শেট এবং নবাবের বিদ্রোহী খালা ঘসেটি বেগমকে সব ধরনের আশকারা দেওয়া। ইত্যাদি কারণে নবাব হওয়ার পরক্ষণেই সিরাজের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।
শাসনভার হাতে নেওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই সিরাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ফোর্ট উলিয়াম দখল করে কলকাতার নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেন। কলকাতার নাম বদলিয়ে করেন আলীনগর। ফোর্ট উলিয়ামের নাম দেন আলীনগর দুর্গ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সে দখলদারি তিনি বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি। পরের বছরই ২ জানুয়ারি কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ এবং এডমিরাল চার্লস ওয়াটসন মাদ্রাজের ফোর্ট জর্জ থেকে সৈন্যসামন্ত নিয়ে এসে ফোর্ট উলিয়াম ও কলকাতা ফের নিয়ে নেয়। একই সঙ্গে তারা ফরাসিদের হাত থেকে চন্দননগরেরও নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারপর নবাব ৫ ফেব্রুয়ারি আবার কলকাতা আক্রমণ করেন কিন্তু প্রত্যুষে অতর্কিতে কোম্পানি বাহিনী তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে নবাবের সৈন্যরা আর সামনে এগোতে পারেনি। যুদ্ধ অমীমাংসিত থাকে এবং দুপক্ষের মধ্যে আলীনগর সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে আগের বছর নবাবের কলকাতা দখলের সময় ইংরেজদের যে ক্ষতি হয়েছিল, নবাব তা পুষিয়ে দিতে রাজি হন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, স্বপ্ন থেকে বাস্তবতার দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যায়।
১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কু’দে তার মাধ্যমে নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্দেশ্যে তারা আর্মেনিয়ান মার্চেন্ট খাজা পেট্রুসের মাধ্যমে নবাবের এক সিনিয়র জেনারেল ইয়ার লতিফ খান এবং প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের সঙ্গে গোপন শলাপরামর্শ শুরু করে। কাশিমবাজার কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটসকে কূটকৌশলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারণ তার একটা বিশেষ সুবিধা ছিল। ইংরেজ হয়েও সে অনর্গল বাংলা এবং ফারসিতে কথা বলতে পারত। দফায় দফায় আলোচনার পর ইংরেজরা লতিফ খানের পরিবর্তে মীর জাফরকেই নবাবের উত্তরসূরি হিসেবে ঠিক করে। সেই মতো ১৭৫৭ সালের ৫ জুন ক্লাইভের সঙ্গে মীর জাফরের চূড়ান্ত গোপন ষড়যন্ত্র চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
মীর জাফর ছাড়াও ওই ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ হয় ঘসেটি বেগম, মাড়ওয়ারি মার্চেন্ট জগৎশেট, শিখ মার্চেন্ট উমিচাঁদ, রায়দুর্লভসহ অনেকে। এরা সবাই ছিল নবাবের ঘনিষ্ঠ এবং অত্যন্ত কাছের মানুষ। কাউকে ক্ষমতার টোপ এবং কাউকে টাকার লোভ দেখিয়ে ইংরেজরা তাদের বাগে আনে। তারপর ৮০০ থেকে ১০০০ ইউরোপীয়, ২০০০ থেকে ২২০০ ভারতীয় সিপাহি ও আটটি কামান নিয়ে ক্লাইভের নেতৃত্বে কোম্পানির লোকজন ১৭৫৭ সালের ১৩ জুন চন্দননগর থেকে পলাশীর দিকে যুদ্ধযাত্রা করে। পথে থেমে থেমে পাঁচ দিনে কাটোয়া দুর্গে এসে পৌঁছায়। ২২ জুন বিকেলে রওনা দিয়ে ভাগীরতী নদী পার হয়ে ২৩ তারিখ রাত ১টার সময় কলকাতা থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে নবাবের রাজধানী মুর্শিদাবাদের কাছে পলাশী নামক এক ছোট্ট গ্রামের আমবাগানে এসে ক্যাম্প স্থাপন করে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায় সিরাজের সৈন্যরা মুর্শিদাবাদ থেকে পলাশীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের সঙ্গে আছে ১৫,০০০ অশ্বারোহী, ৩৫,০০০ পদাতিক বাহিনী এবং ফরাসিদের পরিচালনায় ৪০টি কামান। সকাল ৬টায় প্রথম নবাবের সেনাবাহিনী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর কামান আক্রমণ শুরু করে। কোম্পানির লোকজন প্রথম কয়েক ঘণ্টা আত্মরক্ষায় নিরুত্তর চুপচাপ বসেছিল।
দুপুরের দিকে এক ঘণ্টার মতো প্রবল বর্ষণ হয়। এতে নবাবের কামান এবং অধিকাংশ গোলাবারুদ ভিজে জবুথবু হয়ে যায়। অন্যদিকে কোম্পানিপক্ষ তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ঢেকে রাখায় তেমন ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। বৃষ্টির পর নবাবের সৈন্যরা যখন ক্যাম্পে বিশ্রাম নিচ্ছিল, তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শত্রুপক্ষের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভাগীরতীর পাড়ে একটু উঁচু জায়গায় নবাবের পক্ষে ফরাসিরা একটি কামান খুব কার্যকরভাবে চালাচ্ছিল, কিন্তু ইংরেজরা সেটা সহজেই দখল করে নেয়। বৃষ্টিভেজা অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে সিরাজের বাহিনী মোটেও সুবিধা করতে পারেনি। নবাবের অশ্বারোহীরা কোম্পানি গোলন্দাজ বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। অনেকে মারাও যায়। এরই মধ্যে নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর কমান্ডার ও সেনা খাজাঞ্ছী মীরমদনসহ চার-পাঁচজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকর্তা শাহাদাতবরণ করেন। নবাবের ক্যাম্পে হতাশা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
সুন্দর নির্বাচন সব মানুষের প্রত্যাশাসুন্দর নির্বাচন সব মানুষের প্রত্যাশা
কোনো কোনো ঐতিহাসিকদের মতে, সে সময় ষড়যন্ত্রের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মীর জাফর নবাবকে দিল এক কুবুদ্ধি। বলল, ‘আজকের মতো যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করুন।’ মীর জাফরের এই প্রস্তাবে রাজি হওয়া ছিল নবাবের জন্য আত্মহত্যার শামিল। অন্য ঐতিহাসিকদের মতে, সে সময় নবাব মীর জাফরকে অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর জোর হামলা চালাতে বলেন। অশ্বারোহীদের কমান্ড ছিল মীর জাফরের হাতে। কিন্তু মীর জাফর নবাবের আদেশ উপেক্ষা করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তখন ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা একে একে কাজ করতে শুরু করে। নবাবের পক্ষের একদল সৈন্য চুপ করে বসে পড়ে, আরেক দল আগেভাগেই আত্মসমর্পণ করতে চায়, আরেক দল বন্দুক ঘুরিয়ে সিরাজের বাধ্য সৈন্যদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। ইত্যবসরে ক্লাইভের চিফ অফিসার কিলপ্যাট্রিক ক্ষিপ্রগতিতে নবাবের ক্যাম্পের ওপর নতুন করে আক্রমণ রচনা করে। বিশৃঙ্খল অবস্থায় নবাবের সৈন্যবাহিনী শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। ভাগ্যবিড়ম্বনা বুঝতে পেরে নবাব পিছু হটার নির্দেশ দেন। নবাবের সেনাবাহিনীতে হতাশা ও বিশৃঙ্খলা চরমে ওঠে। রণে ভঙ্গ দিয়ে তারা এলোপাতাড়ি দৌড়াতে থাকে। কোম্পানির লোকজন নবাবের ক্যাম্পের কামান, গোলাবারুদ ও রসদপত্রের দখল নিয়ে নেয়। নবাব পরাজয় বরণ করে আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে যান। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। কোম্পানির পক্ষে মারা যায় মাত্র ২২ জন এবং আহত হয় ৫০-এর মতো। তাদের বেশির ভাগই ভারতীয় সৈনিক। পক্ষান্তরে নবাবের দিকে শহীদ হয় প্রায় ৫০০ এবং জখম হয় আরো অনেক বেশি।
প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই এর ফলাফল নির্ধারিত হয়ে যায়। মসনদের লোভে নবাবের সেনাপতি মীর জাফর তার ভাগ্যকে গোপন ষড়যন্ত্র চুক্তির মাধ্যমে ক্লাইভের হাতে তুলে দেয়। নবাবের অনেক সৈন্য থাকা সত্ত্বেও কোনো লাভ হয়নি। কারণ তারা অনেকেই কোম্পানি থেকে মোটা অঙ্কের ঘুস নিয়ে বসেছিল। পলাশীর ময়দানে তারা সিরাজের হয়ে যুদ্ধ করতে যায়নি। গিয়েছিল ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পরাজয়ের শেষ এবং চূড়ান্ত মহড়া দিতে। নবাব নদীপথে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিহার সীমান্তে ধরা পড়েন এবং মীর জাফরের ছেলে মীরনের নির্দেশে জনৈক ইরানি প্রহরী মোহাম্মদ আলী বেগের হাতে জুলাই মাসের ২ তারিখ নৃশংসভাবে নিহত হন।
প্রাসাদের আশপাশে এত ষড়যন্ত্র হচ্ছিল, তারপরও রাজকাজে অনভিজ্ঞ নবাব ছিলেন একেবারেই গাফেল। এ ছাড়া ১৭৫৬ সালে আফগান সেনাপতি আহমদ শাহ আবদালী দিল্লি আক্রমণ করে এবং ব্যাপক লুটপাট করে। তখন নবাব তার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে চৌকস ইউনিটকে জেনারেল রাজা রাম নারায়ণের নেতৃত্বে পশ্চিম সীমান্তে পাঠিয়ে দেন। ঐতিহাসিকদের মতে, ‘সেই ইউনিট পলাশীতে থাকলে হয়তো বা যুদ্ধের ফলাফল অন্যরকম হতে পারত’।
পলাশীর যুদ্ধে নবাবের মর্মান্তিক পরাজয়ের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায় নবাবের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র এবং যাবতীয় ধনভান্ডার। তা দিয়ে ইংরেজরা গোটা ভারতবর্ষে তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে। ওই সময় ইউরোপে সাত বছর ধরে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধ চলছিল (১৭৫৬-৬৩)। পলাশীর যুদ্ধে নবাবের দিকে ছিল একটি ছোট্ট ফরাসি বাহিনী। যুদ্ধের পর নবাবের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘লা কোম্পেনি দ্য ইন্ডে অরিয়েন্টালের’ ও ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। পুরো বাজার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিয়ে তারা ভারত থেকে পাততাড়ি গুটায়। আর বাংলা-বিহার-ওড়িশার শাসনভার আস্তে আস্তে ইংরেজদের কবজায় চলে যায়।
মীর জাফর নবাব হয়ে কোম্পানির কথামতো চলতে থাকে। ঘসেটি বেগম এবং অন্যান্য প্রভাবশালী নারীদের ঢাকায় নিয়ে বন্দিশালায় রাখা হয়। পরে তারা নৌকোডুবিতে মারা যায়। ঐতিহাসিকদের ধারণা, মীর জাফরের নির্দেশেই তাদের নদীতে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। একপর্যায়ে মীর জাফর ব্রিটিশদের কূটচাল বুঝতে পেরে তলে তলে বিগড়ে যায়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে আরেক ষড়যন্ত্র করে। ওই পরিকল্পনায় ওলন্দাজরা ৭০০ নাবিকসহ সাতটি জাহাজ হুগলী নদী দিয়ে কলকাতার কাছে পাঠায়। সুচতুর ইংরেজরা বুঝতে পেরে ওলন্দাজদের মোকাবিলা করার জন্য আগে থেকেই কর্নেল ফোর্ডের নেতৃত্বে একদল সৈন্য কলকাতার দিকে পাঠিয়ে দেয়। তারা চিন্সুরার যুদ্ধে ১৭৫৯ সালের ২৫ নভেম্বর ওলন্দাজদের শক্ত হাতে মোকাবিলা করে এবং পরাজিত করে। পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নবাবি তহবিল থেকে মীর জাফর ইংরেজদের যথেষ্ট পরিমাণ টাকাপয়সা দিতে পারেনি বলে তারা ১৭৬০ সালে মীর জাফরকে সরিয়ে তার জামাতা মীর কাশিম আলী খানকে বাংলার মসনদে বসায়। প্রথম থেকেই মীর কাশিম পুরোপুরি কোম্পানির বাধ্য না হওয়ায় বুক্সারের যুদ্ধে ১৭৬৪ সালে তাকে পরাজিত করে বাংলার একচ্ছত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরাসরি তাদের করতলগত করে এবং মীর জাফরকে আবার নবাব বানায় এবং ওইবার সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৭৬৫) বাংলার নবাব ছিল। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা ছিল কোম্পানির হাতে। ক্ষমতা না থাকলেও নামেমাত্র নবাব পরিবারের অস্তিত্ব ছিল অনেক যুগ ধরে। ১৮৮০ সালে শেষ নবাব মনসুর আলী খান থেকে ইংরেজরা নবাবি টাইটেল কেড়ে নেয় এবং তার ছেলে সৈয়দ হাসান আলী মীর্জা খান বাহাদুরকে ‘মুর্শিদাবাদের নবাব’ খেতাব দেয়। হাসান আলীর বংশধররা ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এই খেতাব ব্যবহার করেন।
যুদ্ধের আগের মুচলেকা অনুযায়ী নবাবের রাজকোষ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পায় ২৫ লাখ পাউন্ড। ক্লাইভ ব্যক্তিগতভাবে এককালীন পায় ২ লাখ ৩৪ হাজার পাউন্ড এবং ফোর্ট উইলিয়ামের খাজনা বাবদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে প্রতিবছর পেতে থাকে আরো ৩০ হাজার পাউন্ড করে। সে যতদিন বেঁচেছিল, ততদিনই এটা পেয়েছে। ১৭৫৮ সালে উইলিয়াম ওয়াটস, ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর হয়। মীর জাফরের মৃত্যুর পর ১৭৬৫ সালে ক্লাইভ বাংলার গভর্নরশিপ লাভ করে এবং গাঁজায় আসক্ত হয়ে ১৭৭৪ সালে আত্মহত্যা করে। নবাবের ফোর্ট উইলিয়াম দখলকালে যেসব ব্রিটিশ নাগরিক ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তারা নবাবের রাজকোষ থেকে পায় ৫০ লাখ টাকা। ওই সময় ক্ষতিগ্রস্ত চেন্টুস, মূর্স এবং কৃষ্ণাঙ্গদের দেওয়া হয় ২০ লাখ এবং আর্মেনিয়ানদের জন্য রাখা হয় ৭ লাখ টাকা। এভাবে তারা পরাজিত নবাবের অর্থবিত্ত লুটপাট করে নেয়। নবাবের রাজকোষ থেকে তারা কী পরিমাণ টাকা লুটে নিয়েছিল, তার মূল্যমান বোঝার জন্য বলা হয়ে থাকে, ‘সে সময় সারা বছরে মাত্র ৮০০ পাউন্ড খরচ করে একজন ব্রিটিশ জমিদার খুব শানশওকতের সঙ্গে ইংল্যান্ডে জীবনযাপন করতে পারত’।
পলাশীতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের পথে সবচেয়ে বড় বাধা দূর হয়। ওই পরাজয়ের ফলে অবশেষে ভারতবাসী হারায় তাদের স্বাধীনতা। ব্রিটিশরা বণিক থেকে হয়ে উঠে ভারতের সর্বময় মালিক। সেই মালিকানা তারা ধরে রাখে প্রায় ২০০ বছর। পলাশী যুদ্ধের ফলে ফরাসি এবং ওলন্দাজদের ভাত উঠে যায় ভারতবর্ষ থেকে। ব্রিটিশরা ভারতকে লুটেপুটে খাওয়ার একচ্ছত্র অধিকার দীর্ঘদিনের জন্য স্থায়ী করে ফেলে। ওই যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের কারণ মোটেও সামরিক ছিল না। আসল কারণ ছিল নিজেদের মধ্যে বিভক্তি, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলাদলি, হিংসা-বিদ্বেষ, বিশৃঙ্খলা ও ষড়যন্ত্র। বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এখনো যে মারাত্মক অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং হিংসা-প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে, তাতে আমার ভয় হয়, আমরা কী আবার স্বাধীনতা হারাতে বসেছি। মারাত্মক জাতীয় বিপর্যয় এড়ানোর জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইতিহাস থেকে নিচের শিক্ষাগুলো নিয়ে সময় থাকতে সাবধান হওয়া উচিত।
১. ভাগাভাগি, বিশ্বাসঘাতকতা ও নিজস্ব স্বার্থে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান একটি জাতির স্বাধীনতা ধ্বংস করতে পারে। ২. বাণিজ্যিক চুক্তি বা বিদেশি কোম্পানিকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা বিপজ্জনক। ৩. দেশের নেতৃত্বে দূরদর্শী, নীতিবান এবং অভিজ্ঞ নেতৃত্ব থাকা অত্যন্ত জরুরি। ৪. স্বার্থান্ধতা ও দাসমানসিকতা শেষ পর্যন্ত কাউকেই রক্ষা করে না। ৫. পরাধীনতা শুধু রাজনৈতিক নয়। এটি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মিক পরাধীনতাও। ‘যে জাতি নিজের ইতিহাস ভুলে যায়, সে বারবার পরাজিত হয় অন্যের হাতে।’
লেখক : অর্থনীতির অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর : জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ