গত ১১ আগস্ট রাতে এক চমকপ্রদ ঘটনার জন্ম হয়। সাহারা চৌধুরী নামের সিলেট মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ‘এন্টার্কটিকা চৌধুরী’ নামে তার নিজের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন এবং মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎসকে লক্ষ করে দুটি কার্টুন ক্যারিকেচার প্রকাশ করেন। কার্টুনে তাদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী দুই শিক্ষক থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাহারা চৌধুরীকে বহিষ্কার করে।

কিন্তু এখানেই বিতর্ক নতুন দিকে মোড় নেয়। সাহারা চৌধুরীর একটি অনলাইন মেনিফেস্টোতে পাশ্চাত্যের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর আদলে সন্ত্রাসবাদকে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হলেও, কয়েকজন শিক্ষক, গবেষক, লেখক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার ১৬২ জন নাগরিক একটি বিবৃতিতে হত্যার হুমকি দাতাকে সমর্থন করেন। তারা সন্ত্রাসবাদের নিন্দা না জানিয়ে উল্টো হুমকির শিকার দুই শিক্ষককে অপরাধী সাব্যস্ত বলেন। উপরন্তু তারা সাহারা চৌধুরীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার এবং ভুক্তভোগী দুই শিক্ষককে ‘অসংবেদনশীল আচরণ’ ও ‘ঘৃণা ছড়ানোর’ দায়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি করেন।

আমরা বিস্ময়ে লক্ষ করি, নিজেদের উচ্চশিক্ষিত, মুক্তমনা ও প্রগতিশীল দাবি করা এই ‘বিশিষ্ট’ নাগরিকদের মধ্যে আছেন দেশের প্রথম সারির বহু সাবেক ও উদীয়মান বামপন্থি বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী। অথচ তাদের কাউকেই কখনো মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অধিকার রক্ষায় দাঁড়াতে দেখা যায়নি। এবারও তারা হত্যার হুমকি পাওয়া শিক্ষকদের জীবন অধিকার রক্ষা না করে বরং হুমকিদাতার পক্ষ নিয়েছেন এবং ভিকটিমদের উল্টো দোষারোপ করেছেন। ভিকটিম-ব্লেমিংয়ের চেয়ে স্পষ্ট আর কোনো উদাহরণ কী হতে পারে?

বাংলাদেশের বামপন্থি লিবারেলদের মধ্যে এই প্রবণতা নতুন নয়। ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনকে মনে করা যাক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ন্যায়সংগত দাবির আড়ালে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জামায়াত-বিএনপির কিছু নেতাকে ঘায়েল করার আওয়ামী ষড়যন্ত্র দিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু এই ক্ষুদ্রসংখ্যক রাজনীতিকের স্থলে দ্রুতই সমগ্র বাঙালি মুসলমানকে নিয়ে আসে শহুরে অভিজাত সেক্যুলারিজমের ধ্বজাধারী বাম-প্রগতিশীল গোষ্ঠী। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোরজবরদস্তি করে যুদ্ধাপরাধের দায় চাপিয়ে দেয় অভিযুক্তদের ওপর। কিন্তু বাম-প্রগতিশীল গোষ্ঠী দলীয় রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে সব বাঙালি মুসলমানকেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হিসেবে বয়ান নির্মাণ করে, ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমানদের সবাইকেই অপরাধী সাব্যস্ত করে। ফলে, শাহবাগে ইসলামবিরোধী নানা স্লোগান, ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ দেখা যায়। বাঙালি মুসলমানের পোশাক পাঞ্জাবি-টুপি আর হিজাবকে জাতীয় শত্রুর চিহ্ন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এমনকি শাহবাগের আন্দোলনকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ এবং ‘থাবা বাবা’ নামের এক স্বঘোষিত ইসলামবিদ্বেষী ও রাসুলের অবমাননাকারীকে শহীদ হিসেবে উদযাপন করা হয়। গ্রামীণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগণের বিশ্বাস ও নানা আচার-ব্যবহারকে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করা হয়। অনেকের কাছেই আন্দোলনটি বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক পরিচয় মুছে ফেলার প্রচেষ্টা হিসেবে প্রতীয়মান হয়, যা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বামপন্থি রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ থেকে আরো দূরে ঠেলে দেয়।

একইভাবে এনজিও রাজনীতি বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের কাছে প্রগতিশীলতার বদলে এক ধরনের এলিট আধিপত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। এনজিওদের নারী অধিকার ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলো আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হলেও গ্রামের মানুষ প্রায়ই এটিকে দেখে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতার প্রতি অবমাননা ও অসম্মান হিসেবে। যেমন : কিছু অঞ্চলে মসজিদ-মাদরাসাকে পাশ কাটিয়ে বিদেশি দাতা সংস্থার অর্থে ‘কমিউনিটি সেন্টার’ বানানো হয়েছে, বিদেশি সংস্কৃতির নানা ধ্যানধারণা বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে, যেগুলো স্থানীয় সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন : দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং সামাজিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে এলজিবিটিকিউবিষয়ক নানা আইন ও নীতিমালা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবলে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে স্বভাবতই স্থানীয় মানুষ গ্রহণ করতে চায়নি। ফলে এনজিওদের ‘উন্নয়ন’ কার্যক্রম সাধারণ মানুষের কাছে তাদের জীবনধারার প্রতি তাচ্ছিল্য ও ক্ষেত্রবিশেষে হুমকি হিসেবে ধরা দিয়েছে। শুরুতেই উল্লিখিত সাহারা চৌধুরীকে নিয়ে ঘটা বিতর্কিত ঘটনাটি এমনই একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়, যাকে অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান লিবারেলদের একটা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হিসেবে দেখে।

আরেকটি উদাহরণ দেখা যায়, নারীর অধিকার নিয়ে দ্বিমুখী অবস্থানে, বিশেষ করে সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকারবিষয়ক আইনপ্রণয়নের উদ্যোগে। একইভাবে, যখন গ্রামীণ নারী ইসলামি বিশ্বাসের জায়গা থেকে হিজাব পরেন বা ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে নিজের ক্ষমতায়নের প্রশ্নে কণ্ঠ মেলান, তখন অভিজাত প্রগতিশীলরা তাদের ‘অশিক্ষিত’ বা ‘চাপের মুখে বাধ্য’ হিসেবে লেবেল দেন। অথচ একই প্রগতিশীলরা পশ্চিমা প্রেক্ষাপটে হিজাব পরিহিত মুসলিম নারীকে বৈচিত্র্যের উদাহরণ হিসেবে উদযাপন করেন। দেশের অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে এরই উল্টো আচরণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাদের ভণ্ডামি।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সংস্কৃতিও এই ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি। প্রগতিশীল শিক্ষকমণ্ডলী যখন নিজেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রদের ধর্মীয় চর্চাকে ‘প্রতিক্রিয়াশীলতা’ বলে আখ্যা দেন। তারা ছাত্রদের ধর্মীয় পরিচয়কে পরিত্যাগ করতে বা গোপন করতে বাধ্য করেন। মাদরাসা-ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্রদের ভর্তি প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত করা হয়, কম দেওয়া থেকে শুরু করে তাদের প্রতি এমনকি সরকারি চাকরিতে নিয়োগেও বৈষম্য করা হয়। অথচ একই শিক্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারে গিয়ে ‘তরুণদের মুক্ত মতপ্রকাশের অধিকার’ নিয়ে বক্তৃতা দেন।

সব মিলিয়ে স্পষ্ট হয়, অভিজাত প্রগতিশীল শ্রেণি একদিকে ‘স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও মুক্তচিন্তা’র কথা বলে, কিন্তু অন্যদিকে মনের মধ্যে লালিত ইসলামবিদ্বেষের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রতি গভীর অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। এভাবেই ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশের লিবারেলরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে চলেছে, যা বাংলাদেশে বামপন্থা ও উদারনীতিক মূল্যবোধকে দ্রুত বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য তাই দরকার বাংলাদেশের লিবারেলদের জন্য জরুরি একটি আত্মসমালোচনামূলক পুনর্মূল্যায়ন। বাম-প্রগতিশীলদের শুধু জাতীয় ঐক্যের স্লোগান দিয়ে কোনো কাজ হবে না। তাদের নিজেদের ভণ্ডামি, পক্ষপাত এবং ভিকটিম-ব্লেমিং স্বীকার করে নিয়ে নিজেদের রাজনীতি, কথা ও কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আগে জনতার আস্থা অর্জন করতে হবে। অন্যথায়, তাদের সঙ্গে সাধারণ মুসলমানদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান আরো গভীর হবে, বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বর এবং বহুমুখী গণতন্ত্রের ধারক হিসেবে স্বীকৃত বামপন্থার রাজনীতি বাংলাদেশে আরো জনবিচ্ছিন্ন হবে। ফলে তাদের জন্য বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করা দুরূহ হয়ে উঠবে।

সূত্র, আমার দেশ