আমাদের দেশ ছোট হলেও আমরা জাতি বড়। কত বড়, অনেক ক্ষেত্রে, তা দু’শতাব্দীরও অধিক ধরে আমাদের হীনম্মন্যতায় ভোগানোর নানা কলাকৌশলের মুখে আমরা ভুলেই যেন গিয়েছি।

রোমান্টিক স্বজাতিপ্রেম থেকে নয়, কাঠখোট্টা তথ্য-তত্ত্ব বিশ্লেষক, গবেষক ও বিশেষজ্ঞ হিসেবেই বলতে পারি, অন্যান্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে যা-ই হোক না কেন, অন্তত রাষ্ট্রনৈতিক উন্নয়ন পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ, কয়েক শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক নিপীড়নে তার সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে ফেলার পরেও আজও সারা জগতের হাতে গোনা শীর্ষস্থানীয় মাত্র গুটি কতেক—আর এশিয়ায়, একমাত্র জাপানের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।

উন্নয়নের এই অর্জন কোনো এক বা কয়েক ব্যক্তি, দল, সরকার, দিন বা বছরের বিষয় নয়; সারাটা জাতির হাজারো বছরের সংগ্রামের প্রজন্ম প্রজন্মান্তরের ফসল এই অবস্থান।

এই অবস্থানকে ধরে রেখে আরো অগ্রসর হওয়ার দরকার আছে। সেজন্য দরকার নিজের এই অবস্থান সম্পর্কে সার্বক্ষণিক সগর্ব সচেতনতা।

উন্নয়নের পর্যায়ক্রম

উন্নতির প্রকারভেদ আছে। বস্তুগত উন্নতি, অর্থনৈতিক উন্নতি, মানবিক উন্নতি ও রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক উন্নতি এক নয়; যদিও একটি দ্বারা অন্যটি ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। সাধারণত হয়েও থাকে।

সব উন্নতিরই ক্রম থাকে। সাধারণত এসব বিবিধ প্রকারের উন্নতির প্রত্যেকেরই যার যার পর্যায়ক্রম আছে। যেমন, উদাহরণস্বরূপ, উৎপাদন প্রক্রিয়া বিচারে, পাশ্চাত্যের প্রচলিত তত্ত্বমতে, সর্বনিম্নে হলো ফলকুড়ানো-শিকারি অর্থনীতি, তার ওপরে পশুপালক-যাযাবর অর্থনীতি, তার ওপর জমিদারি-কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, তার ওপরে শিল্প-পুঁজিবাদী অর্থনীতি, তার ওপরে ওই তত্ত্বেরই মার্কসীয় ধারামতে, সমাজবাদী অর্থনীতি, তার ওপরে সাম্যবাদী অর্থনীতি। দুই পর্যায়ের মাঝখানেও অনেকটা কৃত্রিমভাবে কোনো আধ-পন্থি পর্যায় করা যায়। যেমন শিল্প-পুঁজিবাদী আর সমাজবাদী পর্যায়ের মাঝামাঝি কল্যাণ-রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি একসময় সমাজবাদী ও তার মধ্য দিয়ে সাম্যবাদী অর্থনীতির অলীক স্বপ্নে ধাবমান—প্রায় দরিদ্র বিশ্ব ও পাশ্চাত্যেরও বিশাল মজদুর শ্রেণিকে পুঁজিবাদী বলয়ের ভেতরেই ধরে রাখার অংশত সফল চেষ্টা করা হয় বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বিলাতের কিনসের মতো অর্থনীতিবিদদের বুদ্ধিমতো। তাতে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক ‘বিপ্লব’-এর পথ রুদ্ধ হয়ে তথাকথিত সাম্যবাদের অবাস্তব স্বপ্নের সোনার হরিণের পেছনে ছোটা বিশ্বের বিশালতর মজদুরদের ব্যবহার করে কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী স্বৈরশাসনের প্রায় পৌনে শতাব্দীর ব্যবস্থা ধসে পড়লে কিনসীয় আধা-সমাজবাদকে তাকে তুলে রেখে ক্রমেই বিশ্বকে আবার নিরঙ্কুশ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলমান করা হয় বিংশ শতাব্দীর শেষ মাথায়। এক বিংশ শতাব্দীত তা ফের বেগবান করা হচ্ছে।

বস্তুগত অর্থনৈতিক উন্নয়নের মতোই রাজনৈতিক উন্নয়নেরও রয়েছে পর্যায়ক্রম। এখানে তার বিস্তারিত সামগ্রিক বর্ণনায় যাব না। শুধু তার কিছু মৌলিক অংশের একটু বিস্তারিত বর্ণনায়ই ব্যাপৃত হব।

রাজ্য

সর্বমৌলিক পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো একজন পরিবার-প্রধানের নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনাধীন যা, তা-ই। প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যে তার গোড়াপত্তনের কারণেই সেখানে সূচিত প্রাচীনতম মনুষ্যভাষায় তাকে সম্ভবত রা’সয় বলা হতো। সে ভাষায়—এবং তা থেকেই পরবর্তী সময়ে উদ্ভূত আজকের বিশ্বের সব ভাষার কোনো কোনোটায়, আজও—‘রা’স’ বা ‘রাস’ অর্থ মাথা। ওই ভাষা, আর তার প্রভাবে আজকেও অনেক ভাষার ব্যাকরণের নিয়মে, কোনো শব্দের পর ‘য়’ যোগ হলে, সেখানে ‘য়’-এর অর্থ হয়, ‘সংক্রান্ত’, ‘ভিত্তিক’, ‘কেন্দ্রিক’, বা ‘মোতাবেক’। উদাহরণস্বরূপ, বাংলায়, ‘বিভাগ’-এর সঙ্গে ‘য়’ যোগ করলে তা হয়, ‘বিভাগয়’, যা উচ্চারণের সুবিধার জন্য ‘বিভাগীয়’ রূপে উচ্চারিত হয়। অর্থ হয়ে দাঁড়ায় ‘বিভাগ-সংক্রান্ত’, ‘বিভাগ-ভিত্তিক’, ‘বিভাগ-কেন্দ্রিক’ বা ‘বিভাগ-মোতাবেক’। একইভাবে, ‘বঙ্গীয়’, ‘কাকতালীয়’, ‘সংসদীয়’ ইত্যাদি। একইভাবে, উচ্চারণাভ্যাসের কিঞ্চিৎ তারতম্যে, শেষের এই ‘য়’, কখনো কখনো ‘য়ঃ’ বা ‘য়া’ বলেও উচ্চারিত হয় বিভিন্ন ভাষায়। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ‘ইসলামিয়া’, ঢাকার চকবাজারের ইমদাদিয়া লাইব্রেরির ‘ইমদাদিয়া’, বাঙ্গালীয়ানার, ‘বাঙ্গালীয়া’ প্রভৃতি।

এ নিয়মেই মাথা তথা প্রধান, অর্থের ‘রা’স’ থেকে পরিবারের ‘রা’স’, অর্থাৎ ‘মাথা’, তথা প্রধান-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাটিকে ‘রা’সয়’, বা ‘রাস্য়’ বলা হয়। প্রাচীন কালে ‘য়’ ও ‘য’ উভয়কেই পারস্পরিক বিকল্প হিসেবে উচ্চারিত করা হতো। আজও অনেক ক্ষেত্রে তেমনটি হয়। তাই ‘রাস্য়’-কে তার ‘য়’-কে ‘য’-তে, আর ‘য’-কে ‘য’-ফলায় রূপান্তরিত করে ‘রাস্য’ বলে উচ্চারণ করা হয় সম্ভবত।

একইভাবে, বিভিন্ন জাতির জিহ্বার গঠনে কখনো কখনো কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্যের কারণ, প্রায়ই ‘স’, কোথাও কোথাও ‘শ’, কোথাও কোথাও ‘ছ’, কোথাও কোথাও ‘জ’ বলে উচ্চারিত হয়। হয়তো এভাবেই একসময়, ‘রাস্য’ ‘রাজ্য’ বলে উচ্চারিত হয়।

সম্ভবত এভাবেই পরিবার শাসনব্যবস্থাটি ‘রাজ্য’ বলে পরিচিত, বিকশিত ও বিস্তৃত হয়। পরিবার বিস্তৃত হয়ে গোত্রে রূপান্তরিত হলে, গোত্রজুড়ে যে শাসনব্যবস্থা, তা-ই রাজ্য বলে পরিচিত হয়। গোত্রপ্রধান হতেন পিতা বা পিতামহ বা প্রপিতামহ হিসেবে যিনি জন্মসূত্রে সকলের রক্ত-সম্পর্কীয় জ্যেষ্ঠতম পিতৃপুরুষ, তথা গোত্র, বা ‘গোষ্ঠী’-এর ‘মাথা’, বা ‘রাস’। আজও কোথাও কোথাও, কোনো কোনো ভাষায় গোত্র-শাসনের প্রধান, বা ‘মাথা’ বা ‘রাস’-কে ‘রাস’ বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইথিওপিয়ায় ‘আমহারি’, আর ইরিত্রিয়ায় ‘তিগ্রিন্যা’ ভাষায়। এখান থেকেই ইথিওপিয়ার প্রয়াত, আমহারা-গোত্রপ্রধান স্বৈরাচারী সম্রাট হাইলে সেলাসিকে তার অন্য নাম ‘তাফারী’-এর সঙ্গে ‘রাস’ যোগ করে ‘রাস-তাফারী’ বলা হতো, আর সুদূর জামাইকার কৃষ্ণাঙ্গদের ভেতর তার ভক্ত পূজারিরা তাকে খোদার অবতার মনে করে ‘রাস-তাফারীয়’ ধর্মের সূচনা করে।

পরিবার থেকে গোত্রে পরিণত হওয়ার পর একই পিতৃপুরুষের অধস্তন পুরুষসমূহের জাতকদের নিয়ে যে বৃহত্তর গোত্রার্ধ একই শোণিতধারার জনগোষ্ঠী একই ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষদের জাতক—ও তাদের সঙ্গে বিবিরূপ বন্ধনের মাধ্যমে একই মূল্যবোধব্যবস্থায় আবদ্ধদের নিয়ে উদ্ভূত জনগোষ্ঠী একই জাতক থেকে জাত বলে একটি স্বতন্ত্র ‘জাত’ বলে পরিচিত হয়, তার শাসন, তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থাটির প্রধানকেও ‘রাস’ বলা হয়। পূর্বে দেখেছি কখনো কখনো ‘স’-কে ‘জ’ বলে উচ্চারণ করা হয়। ফলে এভাবে উদ্ভূত স্বতন্ত্র ‘জাত’-এর প্রধানকে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত উচ্চারণাভ্যাসের কারণে ‘রাস’-এর জায়গায় ‘রাজ’ও বলা হয় কোথাও।

রাষ্ট্র

‘জ’ আর ‘দ’ যে প্রায়ই কোনো কোনো জনগোষ্ঠীর উচ্চারণাভ্যাসের ভেতর দিয়ে পরস্পরের বিকল্প হিসেবে উদ্ভূত হয়, তা আজও দেখা যায়—আরব্যোপদ্বীপে যা ‘কাদী’ বলে উচ্চারিত হতো, তা তুরষ্কে এসে ‘কাজী’ হয়ে পড়ে তুর্কী-আফগানদের মাধ্যমে হিন্দুস্তান হয়ে বাংলায় ‘কাজী’ বলেই পরিচিত হয়। আরবে যা ‘দ্যু’ (অর্থ, ‘আলো’) বলে উচ্চারিত হয়, ভারতে তা এসে তা ‘দ্যুতি’ হয়, কিন্তু তা গ্রিসে গিয়ে ‘জ্যু’ বা ‘জয়ু’ হয়ে, ‘জয়ুস’ হয়ে পূজিত হয়, আর অন্য দিকে পারস্যে গিয়ে ‘দয়ু’ বা ‘দয়উ’ হয়ে ‘দেউ’ বা ‘দেও’ হয়ে ভারতে এসে ‘দেব’ হয়।

দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়দের উচ্চারণাভ্যাসে ‘দ’, ‘ধ’, ‘ড’, ‘ঢ’, ‘ত’, ‘থ’, ‘ট’, ‘ঠ’, ‘ড়’—সব এক হয়ে যায় প্রায়ই। অনেক ইউরোপীয়দের-সহ অনেকের ক্ষেত্রেও এমন বা এর কাছাকাছি হয়।

এভাবে স্থান-কাল-পাত্রভেদে ‘জ’, ‘দ’ আর ‘ট’-এর পারস্পরিক বিকল্পায়নের ভেতর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মূল ‘রা’স’ বা ‘রাস’, ভারতে এসে ‘রাজ’ হয়ে, একসময় ‘রাট’ বলেও উচ্চারিত হয়। ফলে, ‘রাজ’ বা ‘রাজ্য’-কে কখনো কখনো ‘রাট’ও বলা হয়, যা আবার কখনো কখনো ‘রাষ্ট্র’ হয়ে পড়ে, যেমন ‘উট’ হয়ে পড়ে ‘উষ্ট্র’।

‘রাস’-কেন্দ্রিক পরিবার বা গোত্র-শাসন, তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে যে ব্যাকরণগত কারণে ও পদ্ধতি অনুসরণে ‘রাস’ থেকে ‘রাস্য’ বলা হয়, তারই আরো বিকশিত ও বিস্তৃততর জনগোষ্ঠী, তথা স্বতন্ত্র ‘জাত’-এ শাসন, বা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সেই একই ব্যাকরণগত কারণ ও পদ্ধতি অনুসরণে, ‘রাজ’ থেকে ‘রাজ্য’ বলা হয়। আর ‘জাত’-এর সঙ্গে, পূর্বরণিত নিয়মে ‘য়’ যোগ করে, ওই রাজ্যাধীন জনগোষ্ঠী ‘জাতয়’, বা ‘জাতিয়’, বা সংক্ষেপে ‘জাতি’ বলে পরিচিত হয়।

পরিবার—ও সেখান থেকে, উদ্ভূত গোত্র-ভিত্তিক—জাতির নিজস্ব স্বতন্ত্র ‘জাতিয়’, তথা ‘জাতীয়’ শাসন, বা রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেই ‘রাজ্য’, তা’ই ‘জাতি-রাজ্য’। বা ‘জাতি-রাষ্ট্র’ (nation-state) । সুস্থ রাজনৈতিক উন্নয়ন বিবর্তনের ধারায় পরবর্তী যে পর্যায়—জাতি-রাজ্যপুঞ্জ বা ‘ইউনিয়ন’—তার পূর্বে এটাই সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিকভাবে উন্নত শাসন বা রাজনৈতিক ব্যবস্থা।

সাম্রাজ্য

জাতি-রাজ্যের তার পরবর্তী উন্নয়ন পর্যায়, জাতি-রাজ্যপুঞ্জে প্রায় সবসময়ই ব্যাহত হয়ে শাসন বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতিক্রমই শুধু থেমে যায় না, বরং তা জাতি-রাজ্য পর্যায় থেকেও বিচ্যুত হয়ে পড়ে। এতে তা পূর্বের তুলনায় বরং অনুন্নতই হয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় এই ব্যাহত হয়ে পড়াটা সাধারণত হয়ে থাকে রাজনৈতিক ব্যবস্থাটির জাতি-রাজ্য পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পরে, বা তার পূর্বেই ব্যবস্থাটি সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হওয়ার কারণে। বাহ্যিকভাবে জাতি-রাজ্যপুঞ্জ (union), আর সাম্রাজ্য (empire) দেখতে একই রকম—দুটোতেই একাধিক, এবং সাধারণত অনেকগুলো রাজ্য একই শাসনব্যবস্থার অধীন হয়ে থাকে। কিন্তু দু’য়ের ভেতর একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে একই সঙ্গে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, একই শাসন-ব্যবস্থাধীন রাজ্যগুলোর ভেতর একটি বাকি সবগুলোকে শাসন করে। কিন্তু ইউনিয়নের ক্ষেত্রে এমনটি নয়, এখানে একসঙ্গে যোগ দেওয়া ছোট-বড় সব রাজ্যই একপর্যায়ে সমান, আর কয়েকটি মৌলিক বিষয় ছাড়া অন্য সব বিষয়ে স্বায়ত্তশাসিত।

ইউনিয়ন

১৯ শতকের বিশের দশকের শেষপ্রান্তে ইউনিয়নের একটি অনুকরণীয় ‘মডেল’ রূপে ‘সোবিয়েৎ ইউনিয়নে’ রূপান্তরিত হওয়ার পূর্বে ‘রাশিয়ান সাম্রাজ্য’ রাশিয়া-শাসিত অনেকগুলো রাজ্যের সমষ্টি ছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কম্যুনিস্ট শাসন-জাত অন্যান্য নানা সমস্যার জন্য সোবিয়েৎ ইউনিয়ন নিন্দনীয় হয়ে অবশেষে পরিত্যক্ত হলেও, ইউনিয়ন হিসেবে তা পূর্বতন রুশ সাম্রাজ্যে তদাধীন অন্য সব রাজ্যের রাশিয়া দ্বারা শাসনের অবসান ঘটায়, যার ফলে পুরো সোবিয়েৎ ইউনিয়নের ইস্পাতকঠিন স্বৈরশাসক হিসেবে রাশিয়া ভিন্ন ইউনিয়নের অন্য, ক্ষুদ্রতর একটি রাজ্য, জর্জিয়ার স্টালিনের উত্থান ও দীর্ঘকালীন শাসনও সম্ভব হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করলে নিজেকে দক্ষতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে ব্রিটিশ কমনওয়েল্থ নামে কার্যত একটি ইউনিয়নে রূপান্তরিত করে।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের পূর্বতন ঘোষণার ভিত্তিতে তার কয়েকটি মুসলিম-প্রধান বা মুসলিম-শাসিত রাজ্য নিয়ে কল্পিত একটি ইউনিয়ন হিসেবেই ‘পাকিস্তান’—আর, ঐতিহাসিক আর্যাবর্ত যেই ক্ষুদ্রতর মূল ভারত, তাকে-সহ, সেই ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের বাদবাকি রাজ্যগুলো নিয়ে ঘোষণা দিয়েই বৃহত্তর ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’ সৃষ্ট হয়। পরের বছর, অনেকটা একই আদলে, ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য থেকে কিছুকাল পূর্বে বের করে নেওয়া বর্মা রাজ্য, আর তার নিজের এক সাম্রাজ্য হিসেবে অতীতের অন্যান্য করদ রাজ্যসহ কয়েকটি রাজ্য নিয়ে সৃষ্ট হয় বর্মী ইউনিয়ন। কিন্তু এই তিনটি ইউনিয়নই অচিরেই নিজস্ব ঘোষিত বা কল্পিত ইউনিয়ন চরিত্র থেকে বিচ্যুত হয়ে কার্যত তিনটি সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়ে রাজনৈতিক উন্নয়নক্রমে উল্টো দিকে চলতে শুরু করে।

আধুনিক জাতি-রাজ্য বাংলাদেশ

এই উল্টো চলাটা রাজনৈতিক উন্নতির পরিবর্তে রাজনৈতিক অবনতি। তার ফলে এমন উল্টো পথে চলা রাজনৈতিক ব্যবস্থা, বা সাম্রাজ্য, ক্রমে ভঙ্গুরতর হয়ে ভেঙে পড়ারই কথা। এই ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কার্যকর ফলাফলসহ সূচিত হয় ১৯৭১-এ, তা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের নিজেকে, জাপানের পরেই, এশিয়ার দ্বিতীয় আধুনিক জাতি-রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে।

জাপানও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে জাতি-রাজ্য থেকে সাম্রাজ্যে অবনমিত হওয়ার পর, যুদ্ধের মাধ্যমে তার সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আবার জাতি-রাজ্য রূপে পুনর্বাসিত হয়ে রাজনৈতিক উন্নতির প্রক্রিয়ায় ফের অগ্রসরমাণ।

এভাবে, আজকের দুনিয়ায়, এশিয়ায় একমাত্র জাপান আর বাংলাদেশই রাজনৈতিক উন্নয়ন বিচারে সর্বাগ্রসর, সর্বোচ্চ পর্যায়ের উন্নত জাতি হিসেবে জাত-রাজ্যের মর্যাদায় আসীন।

বাংলাদেশের জনগণ এ বিষয়ে সচেতন না হলেও, এ এক বিরল সম্মানের বিষয়। রাজনৈতিক উন্নয়নে এর পরবর্তী পর্যায় হবে বাংলাদেশের উদ্যোগে বা নেতৃত্বে এমন একটি ইউনিয়নের দিকে অগ্রসর হওয়া, যেখানে ইউনিয়নে যোগ দেওয়া ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত, বা ভবিষ্যতে যোগ দেওয়া ছোট-বড় সব জাতি-উপজাতি একে অন্যের দ্বারা শাসিত না হয়ে প্রতিরক্ষা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা, পররাষ্ট্র ও বিদেশিদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং মুদ্রার মতো মৌলিক স্পর্শকাতর কিছু বিষয় ছাড়া বাকি বিষয়াদিতে সমতা ও স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে পারস্পরিক সহায়তায় ঐক্যবদ্ধ থাকবে।

লেখক : হার্ভার্ডের সাবেক ছাত্র ও শিক্ষক। তিনি রাজনৈতিক অর্থনীতি ও উন্নয়ন তত্ত্বে উচ্চতর অধ্যয়নপূর্বক যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি থেকে পিএইচডি করে এমআইটিতে উন্নয়ন-বিষয়ক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা, গবেষণা ও উপদেষ্টার ভূমিকায় অবদান রাখেন। তিনি মৌলিক তাত্ত্বিক হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন।

সূত্র, আমার দেশ