ফ্রান্স ও ব্রিটেন উভয়ই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও জি-৭-এর সদস্য। এরা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। গত বৃহস্পতিবার কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কারনি জানিয়েছেন, নিউ ইয়র্কে আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে তার সরকারও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। ক্রমেই আরো বেশি পশ্চিমা রাষ্ট্র একই অবস্থান গ্রহণ করছে।

এই সরকারগুলোর মধ্যে কারা আসলেই তাদের ঘোষিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। কারণ তারা তাদের পরিকল্পনার সঙ্গে নানা শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ দরকার পড়লে তারা যেন এই এসব প্রতিশ্রুতি থেকে পিছু হটতে পারে, সে পথও খোলা রাখছে। কয়েক দশক ধরে এই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো দুই-রাষ্ট্র সমাধানকে তাদের আনুষ্ঠানিক অবস্থান হিসেবে ঘোষণা করে আসছে। তবুও সেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে এত বিলম্ব কেন—সে প্রশ্ন রয়েই গেছে।

এখন যে তারা সম্মত হচ্ছেন, তার একটি কারণ হচ্ছে তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং পশ্চিমা জনমতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এই পরিবর্তন আসলে দীর্ঘ সময় ধরে ঘটেছে। অনেক ব্যক্তি ও সংস্থার নিরলস প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সরকারি নীতিতে পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। এসব প্রচারণার কারণেই গাজায় সংঘটিত গণহত্যা জনমনে খুব দ্রুত প্রভাব ফেলেছে। ১৯৬০ সালের শার্পভিল হত্যাকাণ্ডের পর দক্ষিণ আফ্রিকায় আর বর্ণবৈষম্য চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এবারের গণহত্যার পরেও তেমনি ইসরাইল আর ছাড় পাবে না।

গাজায় মানবিক সংকটের তীব্রতা বাড়তে থাকায় এবং জনগণের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পশ্চিমা সরকারগুলো কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের অনেকেই স্বীকৃতি দেওয়ার মতো সহজ ও প্রতীকী পথ বেছে নিয়েছে।

অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যিক অবরোধ, কিংবা কূটনৈতিকভাবে একঘরে করার মতো বাস্তব পদক্ষেপ এড়িয়ে চলার জন্যই তারা এ পথে হাঁটছে। তারা প্রমাণ করেছে, দীর্ঘমেয়াদি গণ-আন্দোলন ফলপ্রসূ হয়, আর সরকারও দাবি মানতে বাধ্য হয়। এই মুহূর্তে গণআন্দোলন তীব্রতর করার এখনই সময়। আগের কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে আন্দোলনের ন্যায্যতাও বেশি।

তাই এখনই পশ্চিমা সরকারগুলোকে বাধ্য করতে হবে যেন তারা শুধু প্রতীকী পদক্ষেপ না নিয়ে ইসরাইলের প্রতি তাদের সহযোগিতাও বন্ধ করে। তারা যেন আর ইসরাইলের জন্য দায়মুক্তির ঢাল না হয়ে থাকে, বরং প্রকৃত জবাবদিহিমূলক নীতি গ্রহণ করে। পশ্চিমা দেশগুলো যে ফিলিস্তিনকে এখন স্বীকৃতি দিয়েছে, তার আরেকটি কারণ হলো ইসরাইল নিজেই এমনসব কথাবার্তা ও কাজকর্ম করেছে যে, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া তাদের আর উপায় নেই। এই দেশগুলো দশকের পর দশক ধরে ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধান’ বা ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র’কে বাস্তব পদক্ষেপ হিসেবে না দেখে শুধু রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে দেখেছে। এর আড়ালে ইসরাইলকে ফিলিস্তিনি জমি দখল করে এর বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ইসরাইল এই সুযোগে ফিলিস্তিন নামের কোনো আলাদা রাষ্ট্রের অস্তিত্বই বিলীন করে দিতে চেয়েছিল।

ইসরাইল যতদিন ধরে এই ভান করত যে তারা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তি চায় এবং মাঝেমধ্যে ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধানে’ তাদের আগ্রহ প্রকাশ করত, ততদিন পর্যন্ত পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সহজেই এই চাপ এড়িয়ে যেতে পেরেছে। তারা বলত, ইসরাইলের দখলদারত্ব নিয়ে সোচ্চার হলে তা ইসরাইল-ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনায় বিঘ্ন ঘটাবে এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণেই তথাকথিত শান্তি আলোচনাকে যেকোনো মূল্যে জিইয়ে রাখা দরকার ছিল। ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করতে এটাকে একটা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

এদিকে ইসরাইল যতই কট্টর ডান পন্থার দিকে ঝুঁকেছে, ততই এই তথাকথিত শান্তি আলোচনার ছলছুতো আর কাজ করছে না। আর গাজায় গণহত্যার পর তা একেবারেই অসম্ভব। ইসরাইলের সব নেতাই এখন প্রকাশ্যে বলছেন, সব ফিলিস্তিনিকে গাজা থেকে জোর করে উচ্ছেদ করতে হবে। তারা পশ্চিম তীরকে পুরোপুরি দখল করতে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে চিরতরে নস্যাৎ করতে চান।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী কারনি বলেছেন, গাজা তো পরের বিষয়, শুধু পশ্চিম তীরেই ইসরাইল যা করছে তাতেই তারা ফিলিস্তিনের ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হয়েছেন। অন্য রাষ্ট্রগুলোর মতো কানাডাও বুঝতে পেরেছে, ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধান’ ও ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র’ বিষয়ক ফাঁকা স্লোগান এখন পুরোপুরি অর্থহীন এবং রাজনৈতিকভাবেও ক্ষতিকর। ইসরাইলি চরমপন্থা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সামনে কেবল দুটি পথ খোলা রেখেছে—ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া, অথবা ইসরাইলের দখলদারত্বকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করা।

গত বছর আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) উপদেষ্টার মতামতও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোকে প্রভাবিত করেছে। আইসিজে বলেছিল, দখলকৃত অঞ্চলে ইসরাইলের শাসন অবৈধ এবং যত দ্রুত সম্ভব এর অবসান হওয়া উচিত। এর ফলে ইসরাইলি দখলদারত্বকে বৈধতা দেওয়া আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার তৃতীয় কারণ হলো প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতা। সেবার ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে উপেক্ষা করে আরব-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প। আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের মাধ্যমে ইসরাইলকে একতরফাভাবে ফিলিস্তিন প্রশ্নের সমাধান করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এই ফাঁকে ফিলিস্তিনিদের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপের চেষ্টা চলছিল। তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর এই প্রচেষ্টা ভন্ডুল হয়ে যায়। অনেকের দাবি, হামাস সেদিন সৌদি-ইসরাইল চুক্তি ঠেকানোর জন্যই হামলা চালায়। এটি অবশ্য দুর্বল যুক্তি। তবে ২০২৫ সালের বাস্তবতা হচ্ছে, ফিলিস্তিনকে বাদ দিয়ে এখন আর কোনো আলাপই সম্ভব নয়। ঘটনার দুই বছর পরও ফিলিস্তিন এখনো পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হচ্ছে।

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা শুনে ইসরাইল ও তাদের সমর্থকেরা তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। তারা বলছে, এই স্বীকৃতি হলো হামাসের সন্ত্রাসবাদের জন্য উপহারস্বরূপ। এমনকি এটি নাকি আলোচনার টেবিলে হামাসকে আরো শক্তিশালী করছে। অবশ্য রাজনৈতিক সংকট ও সশস্ত্র সংঘাত অনেক সময় নীতি ও অবস্থানগত পরিবর্তন ঘটাতে পারে। ইতিহাসে এর বহু নজির আছে। অন্যথায় হো চি মিন শহর আজও ‘সাইগন’ নামে পরিচিত একটি আমেরিকান প্রশাসনিক এলাকাই থাকত। আলজেরিয়া আর জিম্বাবুয়ের ব্যাপারেও এ কথা সত্য। এসব দেশের যোদ্ধাদেরও সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ইসরাইল এখন সন্ত্রাসবাদের আলাপ আনছে। অথচ সে নিজেই ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় নিয়েছিল। গত শতকের চল্লিশের দশকজুড়ে জায়োনিস্ট মিলিশিয়ারা তাদেরই প্রভু ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। তারা শুধু সৈন্যই হত্যা করেনি, বরং দেশে-বিদেশে সাধারণ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদেরও হত্যা করেছে।

১৯৪৬ সালে তারা জেরুজালেমে কিং ডেভিড হোটেল উড়িয়ে দেয়। এই হোটেলেই ছিল ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যানডেট সরকারের প্রধান দপ্তর। এই বিস্ফোরণে প্রায় ১০০ জন নিহত হন। এই হামলার নেতৃত্বে ছিলেন মেনাচিম বেগিন ও ইতজাক শামির। দুজনই পরে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হন। সে সময় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাদের চিহ্নিত করেছিল ‘চিহ্নিত সন্ত্রাসী’ হিসেবে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এই সন্ত্রাসী আন্দোলনের ফলেই ব্রিটিশ ম্যানডেটের অবসান হয় এবং ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু ওই সন্ত্রাসবাদ ছিল ‘ভালো’ সন্ত্রাসবাদ!

এখন যারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির ঘোষণা দিচ্ছে, তারা সবাই বহু দশক ধরেই এই অবস্থানের পক্ষেই ছিল। তাহলে আসল প্রশ্ন হলো, কিছু দেশ কেন এখনো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। গ্লোবাল সাউথ বা উন্নয়নশীল বিশ্বের ব্যাপক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও কেন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশের তালিকা এত ধীর গতিতে বাড়ছে—এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, আমেরিকা ও ইসরাইলের রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেইলিং। আমেরিকা বারবার তাদের আর্থিক সক্ষমতা ব্যবহার করে স্বীকৃতি দিতে ইচ্ছুক রাষ্ট্রগুলোকে চাপে রেখেছে। আমেরিকার কূটনীতিক ও সিনেটররা প্রায়ই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিকে ইসরাইলের প্রতি শত্রুতা হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন।

আর ইসরাইল তো একদম পরিকল্পিতভাবে এমন কৌশল প্রণয়ন করেছে, যাতে কোনো রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরোধিতা করলেই ওই রাষ্ট্রকে শাস্তির আওতায় আনা যায়। জাতিসংঘে তাদের বিরুদ্ধে ভোট দিলে ইসরাইল প্রায়ই কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দেয়। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তাদের প্রভাবশালী লবিং নেটওয়ার্ক তো আছেই। যেসব সরকার তাদের পছন্দমতো কাজ না করে, তাদের ওপরই এরা চাপ সৃষ্টি করে। গণহত্যাকারী চরিত্র আড়াল করতে এরা নিজেদের ‘ইহুদিবিদ্বেষের শিকার’ একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে তুলে ধরছে। এই কৌশলের নাম ‘হাসবারা’।

তবে এখন আর এসব কৌশল আগের মতো আর কাজে দিচ্ছে না। আলোচনার দোহাই দিয়ে তারা আর দুই-রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারবে না। ফ্রান্স আর সৌদি আরবের নেতৃত্বে আরো ১৯টি রাষ্ট্রের অংশগ্রহণে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকেও এই দুই-রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়টি প্রস্তাব করা হয়েছে। জাতিসংঘেও প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। ফলে আগের মতো আর ‘মুখের কথায় চিড়ে ভেজানো’র অবস্থা নাও থাকতে পারে। ইসরাইলের ভয়টা এখানেই।

সূত্র, আমার দেশ