ইরান-ইসরাইলের মধ্যে শেষ মুহূর্তের সংঘর্ষ এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিবৃতির মধ্য দিয়ে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সোমবার সকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ১১ দিন ধরে চলা এ সংঘর্ষের ‘পূর্ণ এবং সর্বাত্মক অস্ত্রবিরতি’র ঘোষণা দেন।

ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের যেকোনো সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে গত ১৩ জুন ইসরাইল ইরানের ওপর আক্রমণ চালায়। ইরানের পরমাণু স্থাপনার পাশাপাশি সামরিক, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও হত্যা করে ইসরাইল। নিশানা থেকে বাদ পড়েননি ইরানের শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানীরা।

তেহরানও ইসরাইলের শহরগুলোয় ব্যালিস্টিক মিসাইল দিয়ে আক্রমণ চালায়। ইরানের দাবি, সে কোনো পারমাণবিক বোমাই বানাচ্ছে না। এ সংঘর্ষে ইরানের অন্তত ৬০০ এবং ইসরাইলের কমপক্ষে ২৮ জন নাগরিক নিহত হয়েছে।

নিঃসন্দেহে এই যুদ্ধে ইরানের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে ইরানের পারমাণবিক এবং সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ও শিক্ষা পাওয়া গেল। এ ছাড়া জাতিগতভাবে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অবস্থানও পরিষ্কার হলো।

পরমাণু কৌশল নিয়ে নতুন ভাবনা

মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ও পুরোনো যুদ্ধাস্ত্রের ওপর বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ এসলামি বলেছেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি যে বেশ ভালোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। মিডলইস্ট আইকে তিনি বলেছেন, ‘ইসরাইলের নিখুঁত আক্রমণে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর বেশ কিছু উপাদান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আরকের একটি ওয়াটার রিঅ্যাক্টর, নাতাঞ্জ এবং ফোর্দোর পরমাণু সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা আর ইসফাহানের কিছু গবেষণা ল্যাব।’

তিনি আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনাগুলো দশকের পর দশক ধরে চলে আসা সমন্বিত প্রচেষ্টার অংশ। প্রথমে ইসরাইল ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর ঠিক কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ইরানের কর্তাব্যক্তিরা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত এসব স্থাপনায় পারমাণবিক বিস্ফোরণজনিত কোনো দুর্ঘটনার খবরও পাওয়া যায়নি। তবে বেশ কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন।

এসলামি বলেন, একটা অবকাঠামো তৈরি করা অত কঠিন কাজ নয়। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্মের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা একদল দেশি পরমাণু বিজ্ঞানী তৈরি হয়েছিল ইরানে। নিহত বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়ার ফিজিকস, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সেন্ট্রিফিউজ ডিজাইনিংয়ে অত্যন্ত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছিলেন। এ রকম একটি প্রজন্ম গড়ে তোলা খুব কঠিন। ভবিষ্যতে ইরানের পরমাণু-কূটনীতি কেমন হবে, তা এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ওপর অনেক বেশি নির্ভর করবে।

আমেরিকার গোয়েন্দা তথ্যমতে, ইরান এখন পর্যন্ত পারমাণবিক বোমা বানানোর চেষ্টা করছে না। তা করতে চাইলেও ইরানের অনেক বছর লেগে যাবে। ইরান পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হলেও বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরমাণু সমৃদ্ধকরণের ব্যাপারে অনড়।

ধর্মীয় কারণে পারমাণবিক অস্ত্র বানানো সম্ভব নয় বলে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনি একবার ফতোয়া দিয়েছিলেন।

কিন্তু গত কয়েক দিনের অভিজ্ঞতার পর সাধারণ ইরানিরা পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। তাদের ধারণা, ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র থাকলে সে আর আক্রান্ত হবে না।

অস্ত্র বিশেষজ্ঞ এসলামির মতে, পারমাণবিক স্থাপনা থাকার পর কারো যদি পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে সেই স্থাপনা হাই-প্রিসিশন প্রযুক্তির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

তিনি মনে করেন, ‘ইরান যতই বলুক যে তার পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের উদ্দেশ্য নিতান্তই বেসামরিক, কিন্তু এ ধরনের সক্ষমতা অর্জন করতে গেলে শত্রুরা বিপন্ন বোধ করবেই। এ নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও স্বাভাবিক। ইরান যা করতে পারে তা হলো, পারমাণবিক সক্ষমতা সম্পর্কে একটা অস্পষ্টতা তৈরি করে রাখতে পারে। পরমাণু কর্মসূচি স্বীকার-অস্বীকার কোনোটাই না করাটা হবে ইরানের জন্য মঙ্গলজনক। এই কৌশল ইসরাইলের পরমাণু কৌশলের সঙ্গে মেলে। ইসরাইল এ বিষয়ে বরাবরই ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে রাখে এবং জনপরিসরে কখনোই তার পারমাণবিক অস্ত্রের কথা স্বীকার করেনি।

ইরান জবাব দিতে সক্ষম

ইরানের সামরিক অবকাঠামোতে আক্রমণ করেছিল ইসরাইল। দেশটির সামরিক সক্ষমতার উপাদান, বিশেষ করে মিসাইল লাঞ্চারগুলোর ওপর সরাসরি আক্রমণ করা হয়েছে। সম্ভবত ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইলের বড় মজুত ধ্বংস হয়ে গেছে। এগুলো আবার নতুন করে বানাতে হবে। বেশ ক্ষয়ক্ষতি হলেও ইরানি মিসাইলোর কার্যক্ষমতা বেশ চোখ ধাঁধানো ছিল। ইরানের মিসাইল ইসরাইল এবং তার মিত্রদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে দফায় দফায় সামরিক-বেসামরিক উভয় ধরনের টার্গেটে আক্রমণ করেছে।

ইরান প্রমাণ করেছে ক্ষমতা শুধু টিকে থাকার মধ্যে নয়, বরং আক্রান্ত হওয়ার পরে এমন জোরালো আক্রমণ করতে পারে যে শত্রুপক্ষ সমীহ করতে বাধ্য হয়। এই শক্তির প্রদর্শন আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইরানের অবস্থান বেশ পোক্ত করেছে।

তেল আবিব এবং হাইফার মতো শহরগুলোয় বড় ধরনের হামলা করতে সক্ষম হয়েছে ইরান। বহু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং এবং অন্যান্য স্থাপনা সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দিয়েছে মিসাইল। ইসরাইলকে গত দুই বছরে হামাস, হিজবুল্লাহ এবং হুতিদের মিসাইল ও রকেট আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু এই প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কোনো গ্রুপই আন্তঃসীমান্ত আক্রমণে ইসরাইলকে এতটা নাজেহাল করতে পারেনি।

লেবাননের নিরাপত্তা ও রাজনীতি বিশ্লেষক আলি রিজক মিডলইস্ট আইকে বলেন, ইরান তার আঞ্চলিক মিত্রদের দেখিয়ে দিয়েছে যে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষে জড়ানোর ক্ষেত্রে সে কতদূর যেতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইরান সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ কিছুটা এড়িয়ে চলেছে। এর বদলে সে তার মিত্র শক্তিগুলোর মাধ্যমে প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে গেছে।

আলি রাজাক কাতারে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ইরান আমেরিকার আক্রমণ নিয়েও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। যদিও এই আক্রমণ ছিল প্রতীকী, কিন্তু ইরান তা করছে। এর মাধ্যমে মিত্রদের বার্তা দিয়েছে ইরান প্রয়োজনে কতটা ঝুঁকি নিতে পারে।

ঐক্যবদ্ধ ইরানি জাতি

পারমাণবিক ও সামরিক হিসাবের বাইরে গত দুই সপ্তাহের সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা ছিল ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্র যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত টিকবে কি না। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশ ইঙ্গিত দিয়েছিল, এবারের আক্রমণের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইরানের পরমাণু সক্ষমতা ধ্বংসের পাশাপাশি শাসক পরিবর্তন বা রেজিম চেঞ্জ করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার উৎখাত ও শাসক পরিবর্তনের পক্ষে ইরানের রাস্তায় কাউকে নামতে দেখা যায়নি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্র ইরানে শাসক পরিবর্তনের চেষ্টা করছে না। ওয়াশিংটন মনে করে, ইরানের সরকার পরিবর্তনের মতো ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না।

কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইরানের অবস্থা খুব ভালো যাচ্ছে না। একদিকে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের পতন ঘটেছে, অন্যদিকে হিজবুল্লাহ অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। তা সত্ত্বেও নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের শাসক পরিবর্তনের ব্যাপারে রাজি করাতে পারেননি।

রিজক মনে করেন, ইসরাইলের এই আক্রমণের ফল হয়েছে উল্টো। না চাইতেও ইরানের জনগণ তাদের নেতাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এতে ইরানের অবস্থান আরও বেশি সংহত হয়েছে। আগে যারা ইসরাইলকে শত্রু মনে করতেন না, তারাও এখন করবেন। এমনকি সরকারবিরোধী অনেক মানুষ এখন সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। এটা নেতানিয়াহুর জন্য অনেক বড় কৌশলগত পরাজয়।

মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা

বিষয়: ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ

সূত্র, আমার দেশে