বিশ্ব কূটনীতির মঞ্চে ভারত বহুদিন ধরেই একধরনের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের অবস্থান নীতিগতভাবে নিরপেক্ষ, কিন্তু বাস্তবে অত্যন্ত বাস্তববাদী। আজ যখন ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে, জোটগুলোর চরিত্র বদলাচ্ছে, আর বিশ্বব্যবস্থা বিভিন্ন প্রভাব–বলয়ে ভেঙে পড়ছে; তখন ভারত আবারও নিজের অবস্থান নতুন করে ঠিক করার তীব্র চাপে পড়েছে।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্যে আছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের প্রধান নিশানাগুলোর একটি হয়ে উঠেছে ভারত।
ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্য সব বাণিজ্য অংশীদারের ওপর আরোপিত শুল্কের চেয়ে বেশি। এর বড় অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে। কারণ, গত বছর ভারতের মোট রপ্তানির ১৮ শতাংশ গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে।
তবে এটি কেবল বাণিজ্য–সম্পর্কিত বিষয় নয়, পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কৌশলগত সম্পর্ক গভীর করেছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ক্রমে শক্তিশালী হওয়া ভারতই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্যের ভূমিকা রাখতে পারে। তবে নতুন এই শুল্ক আরোপ বুঝিয়ে দিয়েছে, সবচেয়ে মজবুত সম্পর্কও একজন জনতুষ্টিবাদী নেতার খেয়ালের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে। এই শুল্ক কিছুদিনের জন্য অর্থনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি করতে পারে। তবে একই সঙ্গে এটি দুই দেশের সম্পর্কের ধরনকেও নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারে।
শুধু শুল্ক নয়, অন্যভাবেও ট্রাম্প প্রশাসন ভারতকে আহত করছে। বিশেষ করে, তারা পাকিস্তানের প্রতি বাড়তি উষ্ণতা দেখাচ্ছে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের উসকানিমূলক কথাবার্তা বলার দীর্ঘ ইতিহাস থাকার পরও ট্রাম্প তাঁকে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানিয়েছেন। আসিম মুনির যুক্তরাষ্ট্রে দাঁড়িয়েই ভারতে পারমাণবিক হামলার হুমকি দিয়েছেন ও কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘জীবনরেখা’ বলেছেন। কিন্তু এসব বক্তব্যের পরও যুক্তরাষ্ট্র কোনো সমালোচনা না করে নরম কূটনৈতিক আচরণ দেখিয়েছে। এটা স্পষ্ট করে যে ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি স্বার্থকেন্দ্রিক।
অবশ্য পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই আগ্রহ কৌশলগতভাবে ভারতের জন্য অস্বস্তিকর হলেও তা তার অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ আসলে ভারতের সঙ্গেই বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ভারতের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হলো এমনভাবে ভারসাম্য রাখা, যাতে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের অস্থায়ী ঘনিষ্ঠতা ভারতের নিরাপত্তার ক্ষতি না করে। বিশেষ করে কাশ্মীরের অস্থির নিয়ন্ত্রণরেখার (যেখানে গত এপ্রিলে পাকিস্তানি সন্ত্রাসীরা ঢুকে পর্যটকদের ওপর ভয়াবহ হামলা চালায়) নিরাপত্তা ঠিক রাখা ভারতের জন্য সবচেয়ে জরুরি।
পাকিস্তানের প্রতি চীনের সমর্থন ভারতের নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে। এপ্রিলের পাকিস্তানি সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ভারতের পাল্টা অভিযান ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ চীন পাকিস্তানকে তাৎক্ষণিক সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়েছে। শুধু তা–ই নয়, পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারীও চীন। এসব অস্ত্র পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করেছে।
ভারতকে সন্ত্রাসবাদ, সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক চাপের বিষয়ে নিজের সীমারেখা স্পষ্টভাবে টেনে তা কার্যকর করতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি, কূটনীতি ও প্রতিরক্ষা খাতে নিজস্ব সক্ষমতায় বিনিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে ভারতকে এমন একটি বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে থাকতে হবে, যা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নীতিনির্ভর ও গণতান্ত্রিক।
চীনের বিশাল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সবচেয়ে বড় প্রকল্প হলো চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি)। এটি পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমের গওয়াদার বন্দরকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে। এই প্রকল্প দেখিয়ে দিচ্ছে, চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক এখন শুধু সাময়িক বা কৌশলগত সহযোগিতা নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী ও স্থায়ী জোটে পরিণত হয়েছে।
তাই ভারতকেও বড় পরিসরে পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের অর্থনীতিকে আরও স্থিতিশীল করা, সীমান্তে সামরিক শক্তি বাড়ানো এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার মতো পদক্ষেপই হবে চীন-পাকিস্তান জোটের মোক্ষম জবাব।
চীন সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে সীমান্ত আগ্রাসনও চালিয়েছে। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের ভয়াবহ গালওয়ান যুদ্ধের ক্ষত আবারও দগদগে হয় ২০২০ সালে। ওই বছর চীনের সেনারা গালওয়ান উপত্যকায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) লঙ্ঘন করে এবং এক সংঘর্ষে সেখানে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন। এ ছাড়া চীন অরুনাচল প্রদেশ সীমান্তের পার্বত্য ভূমিতে সেনা মোতায়েন করে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এই অস্থির পরিস্থিতির মধ্যেও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দৃঢ় রয়েছে। শীতল যুদ্ধকালীন নিরপেক্ষ নীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মূলত দুই দেশের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
সব বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে মতের মিল না থাকলেও ভারত রাশিয়া থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ করে এবং এ বছর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নয়াদিল্লি সফরও নির্ধারিত রয়েছে। তবে এখানেও ভারতের উদ্বেগের যে কারণ আছে, সেটি হলো রাশিয়া যত বেশি চীনের ওপর নির্ভরশীল হতে থাকবে, ততই ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে।
বাড়তে থাকা ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় ভারত তার আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোকে বহুমুখী করছে। ইউরোপ যখন তাদের সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহব্যবস্থা নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করছে, তখন ভারত যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা বাণিজ্য আলোচনা নতুন করে শুরু করার সুযোগ দেখেছে।
ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশগুলো চীনের বিকল্প হিসেবে গণতান্ত্রিক ভারতকে গ্রহণ করতে আগ্রহী। ভারত আফ্রিকার সঙ্গেও পুরোনো সম্পর্কগুলোকে নতুন করে জোর দিচ্ছে। আফ্রিকার জনসংখ্যাগত সুবিধা ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য ভারতের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যেখানে চীন দীর্ঘদিন ধরে আফ্রিকায় সম্পদ আহরণমুখী নীতি অনুসরণ করেছে, ভারত সেখানে আফ্রিকার সঙ্গে পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্ক গড়ে তুলতে কাজ করছে। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও ডিজিটাল অবকাঠামোতে ভারতীয় বিনিয়োগও বাড়ানো হচ্ছে।
উপসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের স্বার্থ মানবিক ও কৌশলগত—দুই দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ৮০ লাখেরও বেশি ভারতীয় বসবাস ও কাজ করেন। তাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশে থাকা পরিবারগুলোর জন্য অর্থনৈতিক ভরসা। তবে গালফ দেশগুলো যখন তেলনির্ভরতা কমিয়ে অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করতে চাইছে, তখন ভারত তাদের প্রযুক্তি, দক্ষ জনশক্তি এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক কিছু দিতে পারে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ভারতের কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে। সৌদি আরবের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, এই সম্পর্কগুলো আর কেবল লেনদেনভিত্তিক নয়, বরং কৌশলগত গভীরতায় পৌঁছাচ্ছে।
এশিয়ার ভেতরে ভারত নিঃসন্দেহে প্রয়াত জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের নেতৃত্বের অভাব অনুভব করে। কারণ, আবে নিরাপত্তা খাতসহ দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরও গভীর করতে চেয়েছিলেন। ভারতের বর্তমান প্রত্যাশা, জাপান সরকার আবার সেই নীতি অবলম্বন করবে।
ভারতের শক্তি তার কৌশলগত নমনীয়তায়। কঠোর জোটের শিকলে বাঁধা না থেকে ভারত নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তাই প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে, জ্বালানি ও অস্ত্রে রাশিয়ার সঙ্গে, বাণিজ্য ও জলবায়ুতে ইউরোপের সঙ্গে, আর উন্নয়ন ও প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে আফ্রিকা ও উপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে সহযোগিতা করছে। তবে এই হিসাবি ও জটিল কৌশল স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দাবি করে।
ভারতকে সন্ত্রাসবাদ, সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক চাপের বিষয়ে নিজের সীমারেখা স্পষ্টভাবে টেনে তা কার্যকর করতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি, কূটনীতি ও প্রতিরক্ষা খাতে নিজস্ব সক্ষমতায় বিনিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে ভারতকে এমন একটি বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে থাকতে হবে, যা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নীতিনির্ভর ও গণতান্ত্রিক।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
শশী থারুর জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার-সেক্রেটারি-জেনারেল এবং ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বর্তমানে ভারতের কংগ্রেস পার্টির একজন এমপি।