আইন জালুতের যুদ্ধের কথা দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করছি। ১২৬০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বর্তমান ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের জিজরেল উপত্যকায় আইন জালুত নামক জায়গার কাছে মামলুক সালতানাত ও মঙ্গোল সাম্রাজ্যের মধ্যে ঐতিহাসিক লড়াই সংঘটিত হয়। মামলুক বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সুলতান কুতুজ ও সেনানায়ক বাইবার্স, আর হালাকুর মঙ্গোল বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কিতবুগা। এই যুদ্ধে মামলুকরা মঙ্গোলদের পরাজিত করে, যা ছিল মঙ্গোলদের প্রথম বড় ধরনের পরাজয়, যা প্রমাণ করে মঙ্গোলরা অজেয় নয়। এই বিজয়ের ফলে মঙ্গোলদের মধ্যপ্রাচ্যে অগ্রসর হওয়া থেমে যায় এবং কায়রো, মক্কা ও মদিনার মতো ইসলামি শহরগুলো রক্ষা পায়।

এই যুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। ঠিক তেমনি ইসরাইলে আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইরান পশ্চিমাদের বানানো বয়ান চুরমার করে দিয়ে ইসরাইলের শ্রেষ্ঠত্বকে ধুলায় মিশে দিয়েছে। এই রাষ্ট্রের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যে বয়ানগুলো মধ্যপ্রাচ্যের মানুষদের কালেক্টিভ কনসাশনেসের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে আসছিল, সেটাকেও চিরতরে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং বুঝিয়ে দিয়েছে ইসরাইলও অজেয় নয়।

এবার আসুন একটু ইতিহাসের ফ্লাশব্যাক থেকে ঘুরে আসি। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায়, ইরানে মানববসতি স্থাপনের সূত্রপাত নিম্ন প্যালিওলিথিক যুগে। এলামাইট সভ্যতা এই অঞ্চলের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর মধ্যে একটি, যা দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানে কেন্দ্রীভূত ছিল। এলাম প্রায় ২৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্ব লাভ করেছিল, যতক্ষণ না এটি খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত না হয়। প্রাচীন ইরানে মেদিস ও আকামেনিড সাম্রাজ্য ছিল। মেদিস ইরানি জনগণ তথা ইরানি মালভূমির উপজাতিদের একত্র করেছিল ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এবং অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের পতনে ভূমিকা পালন করেছিল। আর আকামেনিড সাম্রাজ্য (৫৫০-৩৩০ খ্রিষ্টাব্দ) সাইরাস দ্য গ্রেট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, যাকে বেশির ভাগ গবেষক জুলকারনাইন হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। তিনি ব্যাবিলন, লিডিয়া (তুর্কিয়ে) ও মিসর জয় করেছিলেন এবং বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলেন। তিনি ইয়াহুদিদের বেবিলনীয় নিদারুণ বন্দি দশা থেকে সালভেইশন দিয়ে আবার লেভান্থে পাঠান। এরপর ৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পারস্যের পতন ঘটালে তার লোকান্তর প্রাপ্তির পর ৩১২-২৪৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তার সেনাপতি সেলুসিড দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় হেলেনিস্টিক রাষ্ট্র। এরপর ক্রমান্বয়ে পার্থিয়ান সাম্রাজ্য ২৪৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ২২৪ খ্রিষ্টাব্দে যারা রোমের সঙ্গে অসংখ্য যুদ্ধ করেছে, তারা অশ্বারোহী ও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য পরিচিত। সাসানীয় সাম্রাজ্য (২২৪-৬৫১ খ্রিষ্টাব্দ) পার্সিয়ান পরিচয়, কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ও জরথুষ্ট্রবাদ পুনরুজ্জীবিত করে এবং বাইজেন্টাইনদের সঙ্গেও সংঘর্ষে জড়ায়, পরে ইসলামিক বিজয়ের কাছে পরাজিত হয়। ইসলামি যুগে (৬৫১-১৫০১) ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে রাশিদুন খিলাফত ইরানকে জয় করে এবং পরবর্তীকালে উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের অংশ হয়ে ওঠে।

ধীরে ধীরে ইসলামীকরণ করা হয়, যদিও ফার্সি সংস্কৃতি ও ভাষা টিকে থাকে। ইসলামি স্বর্ণযুগে বিজ্ঞান, সাহিত্য ও দর্শনে ফার্সি পণ্ডিতদের উন্নতি ঘটে। তবে স্বাধীন রাজবংশ হিসেবে তাহিরিদ, সামানিদ, বুয়িড, গজনভিদ প্রভৃতি ইরানের কিছু অংশ শাসন করে। তবে সেলজুকরা ১১ শতকে ফার্সি সংস্কৃতি গ্রহণ করে এবং ফার্সি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে। ১২২০ সালে চেঙ্গিস খান এবং তার উত্তরসূরিদের নেতৃত্বে ইরানে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালানো হয়। ইলখানাত তথা ইরান শাসনকারী একটি মঙ্গোল রাষ্ট্র (১২৫৬-১৩৫৩) ধীরে ধীরে পারস্যীকরণ করা হয়েছিল। ১৪শ-১৫শ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে তৈমুর পারস্যে শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।

সাফাভি সাম্রাজ্য (১৫০১-১৭৩৬) শাহ ইসমাইল প্রথম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। সাফাভিরা দ্বাদশ শিয়া ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে তোলে। একটি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত ইরানি রাষ্ট্র তৈরি করে। উসমানীয় ও উজবেকদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। আফশারদ, জান্দ ও কাজার রাজবংশ ১৮শ-২০শ শতাব্দী। সবশেষে পাহলভি রাজবংশের (১৯২৫-১৯৭৯) রেজা শাহ পাহলভি ইরানকে আধুনিকীকরণ করেছিলেন রাস্তাঘাট, শিক্ষা ও সামরিক ক্ষেত্রে, কিন্তু স্বৈরাচারীভাবে শাসন করেছিলেন। তার ছেলে মো. রেজা শাহ আধুনিকীকরণ অব্যাহত রেখেছিলেন এবং কর্তৃত্ববাদের জন্য সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এরপর ১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থান। সিআইএ এবং এমআই১৬ তেল জাতীয়করণকারী প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে উৎখাত করতে সহায়তা করেছিল।

ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের দিকে পরিচালিত করে। আদতে একটা জাতির হিস্টরিওসিটি ও হিস্টোরিওগ্রাফি বলে দেয় ওই জাতিটা কতটা মার্জিত, রুচিশীল পরিশীলিত, সংগ্রামী ও স্বাধীনচেতা। একটা জাতির ইতিহাস থেকেই তাদের জেনেওলজি, কাময়াবি, গালেবি ও যাত্র গড়ে উঠেছে।

এবার আসি মূল আলাপে। এ বছরের শুরুতে হিজবুল্লাহ সৈন্যদের পকেটে থাকা পেজার ডিভাইস দিয়ে অনেকের হাত-পা উড়িয়ে দেয় ইসরাইল এবং হিজবুল্লাহকে দুর্বল করে দেয়। পরে ইসরাইল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টকে দুটা পেজার উপহার দেয়। একটা সোনা দিয়ে বানানো আরেকটা রুপা। এই গিফট ইসরাইল পাঠায় যুদ্ধজয়ের সিম্বল হিসেবে। ট্রাম্প এই উপহার পেয়ে ঘাবড়ে যান এবং বিরক্তিবোধ করেন।

এ সময় ইসরাইল আমেরিকাকে জানায়, তারা ইরানের এই দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ নিয়ে তাদের পারমাণবিক চুল্লিতে আক্রমণ করতে চায়। অন্যদিকে আমেরিকার সিআইএ জানায়, ইরানে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র এখনো নেই এবং বানানোও হচ্ছে না। ট্রাম্প হিসাব করেন—‘ঠিক আছে, ইরান যেহেতু অনেক দুর্বল, ফুরসতটা কাজে লাগিয়ে ইরানের সঙ্গে একটা চুক্তি করে নেওয়া যাক।’ ইসরাইল জানায়, তারা একাই ঢুকে পড়তে প্রস্তুত যদি আমেরিকা না আসে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও সিআইএর পরামর্শ নেন এবং ধরে নেন ইরানে পরমাণু অস্ত্র নেই, তাই ঢোকার কোনো জরুরত নেই। ইসরাইল বেশি পীড়াপীড়ি করলে আমেরিকা জিজ্ঞেস করে, ইরানের ভেতরে না ঢুকে তারা কীভাবে চুল্লি ওড়াবে, তার কোনো উপায় তারা জানে কি না? এ সময় এপ্রিল মাসে ইসরাইল আমেরিকাকে প্রথম জানায়, ইরানের ভেতরেই তাদের লোক ঢুকে বসে আছে। আমেরিকা তখন নড়েচড়ে বসে, তবে পুরাপুরি বিশ্বাস করেনি। তা ছাড়া এ সময় আমেরিকা অনেক দূর এগোয় ইরানের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে আসার জন্য।

ইরানসহ সব আরব দেশের জন্য পারমাণবিক জ্বালানি একটা কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে দেওয়ার প্রস্তাব আমেরিকা দেয়। এই প্রস্তাব শুনে ইরানের আয়াতুল্লাহ খামেনি চুক্তিবিষয়ক আলোচনা বাতিল করে দেয়। অন্যদিকে আমেরিকা একটা দ্রুত চুক্তি করে ফেলতে পারে ভেবে ইসরাইল তড়িঘড়ি করে ইরানের চুল্লিতে আক্রমণ করে। বোধ করি ইরানের নেতারা আমেরিকার আলোচনা ও ইসরাইলের আক্রমণের প্রস্তুতি অনুধাবন করতে দেরি করে ফেলে। বিশেষ করে নিজের দেশের ভেতর যে বিদেশি গোয়েন্দা ঢুকে রেডি হয়ে আছে, এটা ইরান ধরতে পারেনি। এই গোয়েন্দারা প্রথম রাতেই ইরানে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংসলীলা চালায়। যুদ্ধে ইসরাইল এগিয়ে যায়, পরে অবশ্য ইরান ঘুরে দাঁড়ায়।

প্রাচীনকাল থেকে অস্ত্রের পাশাপাশি বচনও যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যা কদিন আগে থেমে যাওয়া পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধেও আমরা প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ দেখেছি। যুদ্ধে এখনো প্রোপাগান্ডা বড় ভূমিকা পালন করে, প্রচুর আধা সত্য মিসইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশন ছড়ানো হয় সমর্থকদের উজ্জীবিত রাখার জন্য। বলাবাহুল্য, সৈনিকদের পাশাপাশি দেশবাসীর মনোবলও যুদ্ধজয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। জনগণের মনোবল ধরে রাখার জন্য যুদ্ধের সাফল্য কিছুটা বাড়িয়ে প্রচার করা হয়। তবে প্রোপাগান্ডারও একটি সীমা থাকা উচিত, মাত্রাতিরিক্ত অপপ্রচারে জনআস্থা সংবাদমাধ্যমে পুরোপুরি বিনষ্ট হতে পারে।

চলমান ইরান-ইসরাইল যুদ্ধেও প্রোপাগান্ডা চলছে। বাস্তবতা হলো, যুদ্ধে ইরানের ক্ষতি অনেক হচ্ছে। ইরানের বড় বড় পরমাণুবিজ্ঞানী, সেনাপ্রধান, আইআরজিসির প্রধানসহ পদস্থ প্রায় ২০ সেনা কমান্ডারকে হত্যা করেছে ইসরাইল। কিন্তু প্রথম দিনের বিপুল ক্ষতির পর ইরান এভাবে প্রত্যাঘাত করতে পারবে, তা কেউ ভাবেনি। এতে ইসরাইলিদের মাঝে ব্যাপকভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

নেতানিয়াহু মনে করেছিলেন, প্রথম হামলার পর ইরানি জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসবে। তারা রাস্তায় নেমেছে বটে, তবে সরকারের পক্ষে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের কিছু মানুষ ও মিডিয়াও ইরানের ব্যাপারে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।

আমার ইউনিভার্সিটিতে আমার ডিপার্টমেন্টে বেশ কয়েকজন ইরানি বন্ধু আছেন। তাদের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, ইরান ১৯৯০ সালের যুদ্ধের পরে এত ইউনাইটেড কখনো হয়নি। এ যুদ্ধে সমগ্র ইরানি জাতি এক হয়ে গেছে এবং তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের কাছ থেকেও আমি একই কথা শুনেছি।

প্রোপাগান্ডার বিষয়ে চমেস্কি ও হারমেনর তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট তত্ত্বে বলেন, “গণমাধ্যমে ‘ফিল্টার’ প্রয়োগ করে খবর প্রচার হয়, যা ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক ও করপোরেট স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মিডিয়া এমনভাবে অপশন সাজায়, যেন দর্শক স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্র-সমর্থিত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়, যা আসলে প্রোপাগান্ডা।” যখন কেউ ইরান বা হামাসের পাশে দাঁড়ায়, তখন পশ্চিমা মিডিয়া দ্রুত তাকে হুমকি হিসেবে ফ্রেম করে। তার মানে ইসরাইল যা বলে তাই মূলধারার সত্য।

সংকটপূর্ণ মুহূর্তে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, আদর্শ, স্বার্থ প্রভৃতির ঊর্ধ্বে উঠে একসঙ্গে সবাইকে কাজ করতে হয় কমন বিষয়ে, যেটাকে গায়ত্রী স্পিভাক বলেছেন, ‘স্ট্র্যাটেজিকাল এসেন্সিয়ালিজম,’ ইরানে ঠিক সেটাই হয়েছে। পশ্চিমারা রাশিয়াতে আক্রমণের আগেও একই ন্যারাটিভ দিয়েছে যে, ‘আমরা রাশিয়াতে শাসন পরিবর্তন করতে চাই,’ কিন্তু ঘটেছে তার উল্টো। রেজিম আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছে।

যাহোক, এখন ইরানের পারমাণবিক চুল্লি কীভাবে ভাঙা হবে, তার কাজ শুরু হয়েছে। সবচাইতে প্রাধান্য পাচ্ছে একটা আমেরিকান কনভেনশনাল অস্ত্র, যেটা আগে কোনোদিন ব্যবহার করা হয়নি। এটার ওজন ৩০ হাজার পাউন্ড এবং একমাত্র আমেরিকান বি টু বিমান এটি নিয়ে উড়তে পারে। তবে এটাও খুব কঠিন কাজ, কারণ সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আমেরিকাকে তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ইরানে আগ্রাসন চালাতে দেবে না। তাহলে আমেরিকার হাতে এখন একটাই অপশন আছে, সেটা হলো ইউরোপের কোনো দেশ থেকে দূরপাল্লার মিসাইল অথবা ফাইটার জেট দিয়ে আক্রমণ করা, তবে তা অনেক ব্যয়বহুল।

আদতে সরাসরি যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন‍্য সহজ হবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ যুদ্ধের বিষয়ে তার ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন (মাগা)’ সমর্থক গোষ্ঠীর ভেতর এরই মধ্যে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে মধ‍্যবর্তী নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে বলে অনুমান করা যায়। আবার লবির পয়সা খাওয়া যুদ্ধবাজদের তরফ থেকে প্রচণ্ড চাপও রয়েছে, ফলে প্রেসিডেন্টের জন‍্য উভয় সংকট পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমেরিকান রাইট উইং ইরান যুদ্ধের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে আছে। এরা আমেরিকা ফার্স্ট ন্যাশনালিস্ট। এদের মধ্যে আছে লিবার্টারিয়ান, উগ্রপন্থি জাতীয়তাবাদী ও সাদা সুপ্রেমেসি গ্রুপ থেকে শুরু করে সেন্ট্রিস্ট আমেরিকানরা। এই কোয়ালিশনের ব্যাপক ভূমিকা ছিল ট্রাম্পকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে। এরা চায় না আমেরিকা আরো একটা মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে শামিল হোক। ইরান ও ইসরাইল এখন যে যুদ্ধটা করছে, এটাকে বলে, ‘ওয়ার অব অ্যাট্রিশন’, মানে, কার ভাণ্ডারে কত অস্ত্র আছে।

ইসরাইল গাজায় যেটা করতে পেরেছে, সেটা ইরানে কখনো করতে পারবে না। এটা ইসরাইলের একটা সীমাবদ্ধতা। ইরানের আল্টিমেট শক্তি হচ্ছে তার বিশাল ভূখণ্ড। কারো পক্ষে ইরান দখল করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এ কারণে ইরান টিকে থাকবে রাষ্ট্র হিসেবে। ইরান নিজেই একটা ন্যাচারাল দুর্গ, যাকে দখল করা অসম্ভব। সমরবিদরা বলে থাকেন, দুনিয়ায় গড গিফটেড পাঁচটি দেশ রয়েছে, যাদের যুদ্ধ করে হারানো খুবই কঠিন। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ইরান, রাশিয়া ও সুইজারল্যান্ড। বাংলাদেশকে বলা হয় ডিফেন্ডারস প্যারাডাইস, আফগানিস্তানকে বলা হয় গ্রেইভইয়ার্ড অব দ্য সুপার পাওয়ার। ইরান দেশটা প্রাকৃতিকভাবেই সুরক্ষিত। যুদ্ধ করে ক্ষতি করা বৈ হারানো সম্ভব হবে বলে বোধ করি না।

অন্যদিকে আমেরিকার অনেক বড় ঝুঁকিও রয়েছে। যদি আমেরিকা ইরানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কোনো চুক্তিতে আসতে পারে, এটি তাদের জন্য একটা ভালো বিষয় হবে; কিন্তু যদি যুদ্ধ করে ইরানকে না হারাতে পারে, তখন আমেরিকার বৈশ্বিক প্রভাব তথা মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিদায় নিতে হতে পারে। এর ফলে এ অঞ্চলে রাশিয়া, চীন ও ইরানের উপস্থিতি আরো বাড়বে। সর্বোপরি ইরান আরো শক্তিশালী হবে এবং বিশেষ করে সুন্নি দেশগুলোয়ও ইরানের জনপ্রিয়তা অনেক হারে বাড়বে।

পরিশেষে একটা বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। পোস্টমডার্ন যুগে আর ক্লাসিক যুদ্ধ হবে না। এখন হবে অ্যাট্রিশনের যুদ্ধ, সাইবার স্পাইং, ইনফো ওয়ার, ভয় তৈরি করা, ব্ল্যাকমেইল, পেজার ও রেডিও সিগন্যাল পাঠানোর মাধ্যমে। ডেভিড কিলকুলেন তার লেখায় কমপ্লেক্স হাইব্রিড থ্রেটসের কথা বলেন, যেখানে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাইবার কৌশল একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়। তার মতে, আধুনিক যুদ্ধ মানে শুধুই সামরিক সংঘর্ষ নয়; বরং ন্যারেটিভ বা গল্প তৈরি ও মিথ প্রতিষ্ঠা করাও যুদ্ধের অংশ। তাই বাংলাদেশ তথা মুসলিম বিশ্বকে অবশ্যই তথ্যপ্রযুক্তি, বিজ্ঞান গবেষণা ও ডিফেন্স সিস্টেমকে উন্নত করতে হবে, স্টেট অব আর্ট সম্পর্কেও ধারণা রাখতে হবে আগামীর বিশ্বে নিজেদের অস্তিত্ব কায়েম ও দায়েম রাখার জন্য।

লেখক : সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও গবেষক, ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন, জার্মানি

সূত্র, আমার দেশ