একটি সংবেদনশীল, সমতাভিত্তিক ও মানবিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিক্ষকের কাজ শুধু পাঠদানেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ন্যায় ও মানবিক বোধে বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে নৈতিক ক্যাম্পাসের ভূমিকা পালন করেন।
সম্প্রতি ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলের মহীয়সী শিক্ষক মাহেরিন চৌধুরীর আত্মত্যাগ আমাদের এই উপলব্ধি আরো দৃঢ় করে। এক প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে তিনি নিজেই প্রাণ হারান। এ ঘটনা যেমন আমাদের শোকাহত করে, তেমনি মনে করিয়ে দেয়—শিক্ষক শুধু পেশাজীবী নন, বরং দায়িত্বশীল অভিভাবক, সংগ্রামী মানবতাবাদীও।
মাহেরিন চৌধুরীর মতো শিক্ষক হয়তো অগণিত নন, তবে এখনো অনেক শিক্ষক আছেন, যারা তাদের দায়িত্বকে বৈষয়িকতার ঊর্ধ্বে স্থান দেন। তারা চান শিক্ষার্থীরা হোক বিবেকবান, যুক্তিনির্ভর ও নৈতিকভাবে দৃঢ়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ তাদের প্রতি যে ন্যায্যতা দেখায়, তা এই আত্মত্যাগের তুলনায় রীতিমতো অবমাননাকর।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) বলছে, দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি। অথচ নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, এই বিপুল শিক্ষা খাতের চালিকাশক্তি শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসরকালীন নিরাপত্তা এখনো রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারে নেই। তাদের অবসর সুবিধাপ্রাপ্তির প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও দীর্ঘসূত্রতার জালে আবদ্ধ। তারা সারাজীবন স্বল্প বেতনে জাতি গঠনের কারিগর হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। অথচ অবসরের পর তাদের ন্যায্যপ্রাপ্তির জন্যও বছরের পর বছর ধরে ধরনা দিতে হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। চাকরি জীবনে যে বেতন-ভাতা পান, তা দিয়ে টেনেটুনে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। সঞ্চয়ের ভাবনা অনেকের কাছেই নেহাত বিলাসিতা। ফলে অবসর শুরুর পর থেকে শুরু হয় নিদারুণ আর্থিক সংকট। তখন অবসর সুবিধার সামান্য কয়েক লাখ টাকা তাদের কাছে জীবনদায়ী অক্সিজেনের মতো। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, ২৮ লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচারের সুযোগ থাকলেও সম্মানিত শিক্ষকদের অবসর সুবিধার সামান্য কিছু টাকা আমরা যথাসময়ে দিতে পারি না।
বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান : ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড’ এবং ‘কল্যাণ ট্রাস্ট’। শিক্ষকরা তাদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ অর্থ (৬% বোর্ডে, ৪% ট্রাস্টে) নিয়মিত জমা দেন। অথচ চাকরি জীবন শেষে এই তহবিল থেকে পাওনা বুঝে পেতে তাদের অপেক্ষা করতে হয় চার-পাঁচ বছর।
একজন শিক্ষক সারাজীবন জাতি গঠনের কারিগর হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। অথচ অবসরের পর তাকে যখন নিজের প্রাপ্য অর্থের জন্য ঘুরতে হয়, অপমানিত হতে হয়, তখন সেটি তার একার দুঃখ নয়—তা গোটা সমাজের বিবেকহীনতার প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্র যদি শিক্ষকদের সম্মান ও ন্যায্যতা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে সেই রাষ্ট্রের শিক্ষা ও উন্নয়নকাঠামো কখনোই টেকসই হতে পারে না।
সর্বশেষ তথ্য বলছে, অবসর বোর্ডে প্রায় ৪৮ হাজার এবং কল্যাণ ট্রাস্টে ৪৩ হাজার আবেদন অনিষ্পন্ন রয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের তহবিলের সম্মিলিত ঘাটতি প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। প্রতি মাসে যে পরিমাণ আবেদন জমা পড়ে, নিষ্পত্তি হয় তার চেয়ে অনেক কম।
এই সংকট নিরসনে কিছু নীতিগত পদক্ষেপ জরুরি। প্রথমত, অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টকে একীভূত করে একটি স্বশাসিত ‘অবসর কল্যাণ কর্তৃপক্ষ’ গঠন করা উচিত। এতে প্রশাসনিক ব্যয় কমবে এবং শিক্ষকরা পাবেন এক জায়গায় সব সুবিধা। দ্বিতীয়ত, আবেদন যাচাই ও অনুমোদনের জন্য একটি সময়-নির্ধারিত (সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে) অনলাইন ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু করা। তৃতীয়ত, সরকারকে একটি কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার রিভলভিং তহবিল গঠন করতে হবে, যা থেকে সরাসরি শিক্ষকদের পাওনা পরিশোধ নিশ্চিত করা যাবে। এটি কোনো করুণা নয়, বরং জাতি গঠনে শিক্ষক সমাজের অবদানের স্বীকৃতি।
একটি মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণের পূর্বশর্ত হলো—একটি মানবিক শিক্ষাব্যবস্থা। আর সেই ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন শিক্ষক। তাই প্রয়োজন তাদের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও প্রাপ্য নিশ্চিত করা। অন্যথায় উন্নয়ন ও মানবিকতার সব উচ্চারণ শুধু কথার ফুলঝুরি হয়েই থাকবে।
লেখক: চিফ (ডিএলপি ডিভিশন), বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)