‘যাবতীয় যন্ত্রণার মধ্যে ছিল আমার বসবাস এবং আমি বারবার সম্মুখীন হয়েছি বেদনা ও শোকের। তা সত্ত্বেও, সত্যকে বিকৃত বা মিথ্যাচার ছাড়াই তুলে ধরতে আমি কখনো দ্বিধা করিনি। যারা আমাদের ওপর চালানো হত্যাকাণ্ড দেখে নীরব ছিল এবং যারা আমাদের নিশ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে, যাদের হৃদয় আমাদের নারী ও শিশুদের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখেও বিচলিত হয়নি এবং যারা দেড় বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের জনগণের ওপর চলা এই গণহত্যা থামাতে কিছুই করেনি, আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী থাকুন।’

আনাস আল-শরিফ এ কথাগুলো লিখেছিল তার অসিয়তনামা হিসেবে, শহীদ হওয়ার চার মাস আগে। সে নিহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটি পোস্ট করা হয়। গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের কাছে মিডিয়ার একটি তাঁবুতে ইসরায়েলি হামলায় আনাস, সাংবাদিক মোহাম্মদ কোরইকেহ, ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মদ নওফাল ও মোমেন আলিওয়া শহীদ হয়।

আনাস আল-শরিফ গাজার একজন বীর, সে নিঃসন্দেহে আমাদের সবার হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের একজন সাংবাদিক ছিল।

গাজার মানুষ সাধারণত গণমাধ্যমকে ঘৃণা করে। তারা সাংবাদিকদের দুটি ভূমিকায় দেখে: হয় তারা আমাদের অতিরঞ্জিতভাবে এমনভাবে তুলে ধরে—যেন আমরা অতিমানব, যারা অবিরাম বোমা হামলা, খাদ্য ও পানির অভাব এবং প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে; অথবা তারা আমাদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিত্রিত করে, যা আমাদের পরিবারের হত্যাকাণ্ড এবং আমাদের বাড়িঘর ধ্বংসের ন্যায্যতা দেয়।

আনাস ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। সে সত্যকে বিকৃত করেনি। সে ছিল আমাদেরই একজন। আমাদের শরণার্থীশিবিরেই তার বেড়ে ওঠা। বোমার নিচে ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় আমাদের সঙ্গে কষ্ট ভোগ করে, প্রিয়জনদের জন্য শোক করে এবং নিজ সম্প্রদায়কে ছেড়ে না গিয়ে সে বেড়ে উঠেছে। সে গাজাতেই থেকে গেছে, জলপাইগাছের মতো দৃঢ়ভাবে, একজন সত্যিকারের ফিলিস্তিনির জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে।

গণহত্যা শুরুর পর আনাস আল-শরিফ আল–জাজিরার জন্য রিপোর্টিং শুরু করে এবং দ্রুতই সে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠে। ক্রমাগত হুমকির মুখেও সে ও ইসমাইল আল-ঘুল উত্তর গাজা থেকে সম্প্রচার বন্ধ করেনি। তাদের উষ্ণ বন্ধুত্ব, আনন্দ ও দুঃখের মুহূর্তগুলো দুজনকে আমাদের কাছে আরও বেশি আপন করে তুলেছিল।

গত বছর ইসমাইল ইসরায়েলি হামলায় শহীদ হওয়ার পর (আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন) আমরা অনুভব করেছিলাম যে আমরা একজন প্রিয় ভাইকে হারিয়েছি এবং আমাদের কাছে কেবল আনাসই অবশিষ্ট ছিল।

গত মাসে যখন আনাস গাজার ওপর চাপিয়ে দেওয়া অনাহারের ওপর প্রতিবেদন করার সময় ক্যামেরার সামনে বেদনায় ভেঙে পড়েছিল, তখন মানুষ তাকে বলেছিল, ‘এগিয়ে যাও, আনাস। থামবে না, তুমিই আমাদের কণ্ঠস্বর।’ সত্যিই, সে আমাদের কণ্ঠস্বর ছিল। আমরা প্রায়ই কল্পনা করতাম যে এই গণহত্যার সমাপ্তি যখন আসবে, তখন আনাস আল-শরিফের কণ্ঠেই আমরা সেই ঘোষণা শুনব। বিশ্বের কোনো সাংবাদিকই সেই মুহূর্ত ঘোষণা করার জন্য আনাসের চেয়ে বেশি যোগ্য ছিল না।

আমার কাছে আনাস কেবল একজন রিপোর্টার ছিল না, সে ছিল একজন অনুপ্রেরণা। যখনই আমি লিখতে গিয়ে এ পরিস্থিতি পরিবর্তনের আশা হারিয়ে ফেলতাম, তখন আনাসই অনুপ্রেরণা হয়ে হাজির হতো এবং আমি আবার কলম তুলে নিতাম। আমি আনাসকে দেখেছি, অক্লান্তভাবে রিপোর্টিং করে যাচ্ছে—খেয়ে–না খেয়ে, গরমে বা শীতে, মৃত্যুর হুমকির মুখে বা ক্যামেরায় পরিবেষ্টিত অবস্থায়।

আমার বিশ্বাস ছিল, এই যে আমরা গণহত্যার বিষয়টি নথিভুক্ত করছি, তা গাজার বাইরে কাউকে প্রভাবিত করছে না। আনাসের দৃঢ়তা আমাকে এই বিশ্বাস থেকে সরে আসতে বাধ্য করে। আনাস আমাকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল যে আমাদের গল্পগুলো আমাদের সীমানা অতিক্রম করে সমুদ্রের পর সমুদ্র পেরিয়ে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছাতে পারে। আর তার প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে কাজ করার অদম্য শক্তি আমাকে আশাবাদী হতে বাধ্য করেছিল...এই আশায় যে যদি আমরা কথা বলতে থাকি, তবে হয়তো কেউ একজন শুনবে।

আজ আনাস আর নেই, আর আমার মনে হচ্ছে, আমি আশা করে ভুল করেছিলাম, এই পৃথিবীর ন্যায়বিচারের ওপর বিশ্বাস রেখে ভুল করেছিলাম। অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে বিশ্ববিবেকের কাছে আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু প্রমাণিত হলো, তারা কতটা সংকীর্ণ এবং কতটা পক্ষপাতদুষ্ট।

তারা তোমার অশ্রুর যোগ্য ছিল না, আনাস! আমাদের গল্প তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য তোমার আত্মত্যাগেরও তারা যোগ্য ছিল না। তারা শোনে না। কারণ, তারা শুনতে চায় না।

আনাস, তোমার রিপোর্টিং শেষ হয়েছে, কিন্তু এই গণহত্যা বন্ধ হয়নি। আজ আমরা অসহায়ভাবে দেখছি সেই ঘৃণ্য দখলদারিকে, যারা সারা বিশ্বের সামনে তোমাকে হামলার করা নিয়ে গর্ব করছে—সেই একই বিশ্বের সামনে, যাদের কাছে তুমি তোমার শেষনিশ্বাস পর্যন্ত আবেদন করেছিলে। সেই দেশগুলো এখনো নীরব; কারণ তাদের কাছে অর্থনৈতিক চুক্তি এবং রাজনৈতিক স্বার্থ মানুষের জীবনের চেয়েও মূল্যবান।

তুমি তোমার কণ্ঠ তুলে ধরেছিলে, আনাস। কিন্তু তুমি আসলে চিৎকার করেছিলে বিবেকহীনদের কাছে।

আমি চেয়েছিলাম, তোমার শহীদ হওয়ার আগেই যুদ্ধটা শেষ হোক, যাতে আমি গাজায় তোমাকে খুঁজে বের করে বলতে পারতাম যে আমাদের কণ্ঠস্বর সফল হয়েছে, সেগুলো বাইরের বিশ্বে পৌঁছেছে এবং পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আমি তোমাকে বলতাম যে তুমি ছিলে আমার আদর্শ এবং তোমার কাজই আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর সেই মুহূর্তে যদি তুমি হেসে আমাকে বলতে, ‘আমি তোমার সহকর্মী’, আমি আনন্দে কেঁদে ফেলতাম।

গাজায় ইসরায়েলের সৃষ্ট অনাহারের ভুক্তভোগী এক ফিলিস্তিনি মায়ের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন সাংবাদিক আনাস

গাজায় ইসরায়েলের সৃষ্ট অনাহারের ভুক্তভোগী এক ফিলিস্তিনি মায়ের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন সাংবাদিক আনাসছবি: এক্স (টুইটার) থেকে সংগৃহীত

আনাস, তোমার রিপোর্টিং শেষ হয়েছে, কিন্তু এই গণহত্যা বন্ধ হয়নি। আজ আমরা অসহায়ভাবে দেখছি সেই ঘৃণ্য দখলদারিকে, যারা সারা বিশ্বের সামনে তোমাকে হামলার করা নিয়ে গর্ব করছে—সেই একই বিশ্বের সামনে, যাদের কাছে তুমি তোমার শেষনিশ্বাস পর্যন্ত আবেদন করেছিলে। সেই দেশগুলো এখনো নীরব; কারণ তাদের কাছে অর্থনৈতিক চুক্তি এবং রাজনৈতিক স্বার্থ মানুষের জীবনের চেয়েও মূল্যবান।

তবু দখলদারি শক্তি আমাদের নীরব করতে পারবে না, আনাস। তারা চায়, আমরা কণ্ঠস্বর ছাড়াই মারা যাই। কারণ, আমরা যখন যন্ত্রণায় কাতরাই এবং সবকিছু হারিয়ে কান্না করি, তখন আমাদের সেই কণ্ঠ তাদের বিরক্ত করে, তাদের গণহত্যার উন্মত্ততাকে বাধা দেয়।

গাজা তোমার মতো আরেকজন আনাসের জন্ম দেবে না, জন্ম দেবে না লেখক ও কবি রিফাত আল-আরিরের মতো কাউকে কিংবা হাসপাতাল পরিচালক মারওয়ান আল-সুলতানের মতো কাউকে। দখলদারি শক্তি বেছে বেছে সেরা ও উজ্জ্বলতম মানুষদের টার্গেট করছে—যারা তাদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেছে এবং বিশ্বকে দেখিয়েছে যে মর্যাদা ও সততার অধিকারী ফিলিস্তিনিরা কী করতে পারে।

কিন্তু এই হিংসাত্মক হত্যাকাণ্ডের পর আমরা চুপ থাকব না। বিশ্ব শুনবে না, সেটি জানা সত্ত্বেও আমরা কথা বলতে থাকব। কারণ, এটিই আমাদের নিয়তি এবং এটিই আমাদের কর্তব্য। এই গণহত্যা থেকে আমরা যারা এখনো বেঁচে আছি, আমাদের শহীদদের উত্তরাধিকার বহন করতে হবে। আমার জন্য এর অর্থ হলো কথা বলা, লেখা এবং এই রক্তাক্ত ও বর্বরতার দখলদারির অপরাধগুলো প্রকাশ করে যাওয়া...সেই কাজ করে যেতে হবে, যতক্ষণ না তোমার স্বপ্নের সেই দিন আসে, আনাস আর সেটি হবে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এই গণহত্যার সমাপ্তির দিন। যেদিন তুমি আল-মাজদালের তোমার পূর্বপুরুষের বাড়িতে ফিরে যাবে এবং আমি ফিরে যাব আমার গ্রাম ইয়াবনাতে।

হাসান আবু কামার গাজার লেখক ও সাংবাদিক

আলজাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: রাফসান গালিব

সূত্র, প্রথম আলো