গাজায় ইসরাইলের লাগাতার বোমাবর্ষণ, নতুন বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোয় সীমান্ত অতিক্রম করে হামলা আবারও পশ্চিমাদের দ্বিচারিতা উন্মোচিত করেছে। ওয়াশিংটন ও ইউরোপীয় রাজধানীগুলো শান্তি, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে কথা বলে চলেছে, অথচ ইসরাইলের অপরাধে তাদের নীরবতা বা প্রশ্রয় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ভণ্ডামিকেই প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি তথাকথিত শান্তি বৈঠকের সময় দোহায় যে হামলা চালানো হয়েছে, তা শুধু আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনই নয়, বরং স্পষ্টতই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ।

ফিলিস্তিনের ট্র্যাজেডির শিকড় এক শতাব্দীরও বেশি পেছনে প্রসারিত। ১৯১৭ সালে ব্রিটেন বেলফোর ঘোষণা জারি করে, যেখানে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি ‘জাতীয় নিবাস’ গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল আরব জনগোষ্ঠীর অধিকার সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হলোকাস্টকে অজুহাত বানিয়ে পশ্চিমারা ইসরাইল গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। ফলাফল ছিল ১৯৪৮ সালের নাকবা, যখন সাত লাখ পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিজ ভূমি থেকে উৎখাত হয়। পরবর্তী সময়ে ইসরাইল জাতিসংঘ-নির্ধারিত সীমানার বাইরে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল গাজা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, সিনাই ও গোলান দখল করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব ২৪২ অনুযায়ী দখলকৃত এলাকা থেকে প্রত্যাহারের আহ্বান জানালেও ইসরাইল তা উপেক্ষা করে। আজ পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে সাত লাখেরও বেশি অবৈধ ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারী বাস করছে, যা কার্যত এক ধরনের বর্ণবাদী বাস্তবতা প্রতিষ্ঠা করেছে।

সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো পশ্চিমাদের বাছাই করা নৈতিকতা। সিরিয়া, ইরান বা রাশিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘনে প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করা হলেও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের পরিকল্পিত নিধনকে ‘আত্মরক্ষা’ হিসেবে সমর্থন দেওয়া হয়। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪, ২০২১, ২০২৩ এবং চলমান ২০২৫ সালের অভিযানে ইসরাইল হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের বড় অংশ নারী ও শিশু। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করলে পশ্চিমারা কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। কিন্তু ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম দখল বা বসতি সম্প্রসারণ করলে তা ‘জটিল’ বা ‘আলোচনাযোগ্য’ বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। এ ধরনের দ্বিচারিতা সেই নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার প্রতি আস্থা নষ্ট করেছে, যার কথা পশ্চিমারা মুখে বলে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্র এখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। ওয়াশিংটন প্রতি বছর প্রায় ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেয় ইসরাইলকে। এই অস্ত্র শুধু গাজায় নয়, বরং লেবানন, সিরিয়া, এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে কাতারেও ব্যবহৃত হচ্ছে। যদি কোনো মুসলিম দেশ সীমান্ত অতিক্রম করে এভাবে হামলা চালাত, তবে তাকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। কিন্তু ইসরাইল করলে সেটিকে বলা হয়, ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান।’ গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্র একাই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলবিরোধী অন্তত ৪৫টি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। এই প্রস্তাবগুলোর বেশিরভাগই ছিল ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করা বা ইসরাইলি দখলদারি বন্ধ করার দাবি। এই ধারাবাহিক ভেটো কার্যত ইসরাইলকে আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছে।

গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। কেবল গত এক সপ্তাহেই ইসরাইলি বোমায় শত শত বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে এবং স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ ও ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো একে ‘সমষ্টিগত শাস্তি’ বলছে, যা সরাসরি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার একটিতে নির্বিচারে বোমাবর্ষণ কোনো সামরিক প্রয়োজন নয়, এটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ।

দোহায় হামলা আরো বিস্তৃত শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাজধানীতে, তাও শান্তি বৈঠকের সময় হামলা চালানো আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক নিরাপত্তাকে ভেঙে দিয়েছে। এটি অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার মৌলিক নীতিকে ধ্বংস করেছে। ফলস্বরূপ, শুধু ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুই নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে আগেই অবগত ছিল বা নীরব সম্মতি দিয়েছিল। ওয়াশিংটন অস্বীকার করলেও ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে, ইসরাইলকে রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করেছে।

এই প্রেক্ষাপটে ইউরোপ থেকেও নতুন সংকেত আসছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার সতর্ক করেছেন, যদি ইসরাইল গাজায় যুদ্ধ বন্ধ না করে এবং পশ্চিম তীর দখল অব্যাহত রাখে, তবে ব্রিটেন জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হবে। এটি একটি ঐতিহাসিক বিষয় হবে, কারণ যে দেশ একসময় বেলফোর ঘোষণা দিয়েছিল, সেই দেশই এখন ইসরাইলকে কূটনৈতিকভাবে চাপে ফেলতে পারে। প্রত্যাশিতভাবেই নেতানিয়াহু একে ‘হামাসকে পুরস্কৃত করা’ বলে সমালোচনা করেছেন। তার প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া মানেই ইসরাইলি দখলের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়া।

ব্রিটেনের পদক্ষেপ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশকেও প্রভাবিত করতে পারে। আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, স্পেন ও সুইডেন এরই মধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে বা দিচ্ছে। যদি ব্রিটেনের মতো বড় শক্তি এগোয়, তবে তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামগ্রিক নীতিতেও প্রভাব পড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রের একপক্ষীয় সমর্থনকে আরো বিচ্ছিন্ন করে তুলবে।

এদিকে মুসলিম বিশ্বে ক্ষোভ বেড়েই চলেছে। দোহায় অনুষ্ঠিত জরুরি সম্মেলনে ৫৫টিরও বেশি মুসলিম দেশ অংশ নেয়, যেখানে আরব লিগের মহাসচিব আহমেদ আবুল গেইত ঘোষণা করেন, ইসরাইলই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতার মূল কারণ। আরব ও ইরানের নেতারা সতর্ক করেছেন, কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সংঘাত আরো ছড়িয়ে পড়বে এবং কোনো পক্ষই নিরাপদ থাকবে না। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, মুসলিম নেতৃত্ব অনেক সময় বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ থাকে, কার্যকর পদক্ষেপে নয়। বড় প্রশ্ন হলো, তারা কি বিভেদ ভুলে বাস্তব চাপ সৃষ্টি করতে পারবে? অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক হাতিয়ার, যেমন তেলনীতি যদি সমন্বিতভাবে প্রয়োগ করা যায়, তবে তা পশ্চিমাদের জন্য বড় ধাক্কা হবে। ইরান ও মিসরের নেতৃত্বে ন্যাটোর মতো একটি আরব প্রতিরক্ষা জোট গঠনের প্রস্তাব সাহসী ও ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এটি সফল হলে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার কাঠামো মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি যৌথ প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। তবে দীর্ঘদিনের বিরোধ, বাইরের চাপ এবং পরস্পরবিরোধী এজেন্ডা এই উদ্যোগের বাস্তবায়নকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে। মুসলিম বিশ্বের জন্য প্রকৃত পরীক্ষাই হলো—তারা কি ইতিহাসের বিভাজন কাটিয়ে উঠতে পারবে এবং বক্তৃতাকে বাস্তব পদক্ষেপে রূপ দিতে সক্ষম হবে?

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের একপক্ষীয় ভেটো-নির্ভর কূটনীতি এখন ক্রমেই সমালোচনার মুখে পড়ছে। যদি ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করে, তবে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় রাশিয়া ও চীন নিজেদের মুসলিম বিশ্বের মিত্র হিসেবে উপস্থাপন করবে, যা বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

সবচেয়ে বড় ঝুঁকি আঞ্চলিক নিরাপত্তায়। ইসরাইলের আগ্রাসন অব্যাহত থাকলে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী এবং অন্যান্য প্রতিরোধ গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এতে গোটা মধ্যপ্রাচ্য অনিশ্চিত ও ব্যাপক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এ কারণে বর্তমান সংকট কেবল ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুই নয়, বরং বৈশ্বিক শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতারও প্রতিফলন। আগামী মাসগুলোয় পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা নির্ভর করবে মুসলিম বিশ্বের পদক্ষেপ, ইউরোপের কূটনৈতিক অবস্থান এবং যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত পরিবর্তনের ওপর।

ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান সামরিকভাবে সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার কূটনীতি, ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা। কিন্তু পশ্চিমারা ইসরাইলকে দায়মুক্তি দিয়ে আসছে বলেই সহিংসতার চক্র চলতে থাকে। ইউক্রেনে যা নিন্দিত, ফিলিস্তিনে তা-ই প্রশ্রয় পাচ্ছে। দ্বিচারিতা স্পষ্ট। এখনই সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভণ্ডামি পরিহার করে ইসরাইলকে তার অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি করা। ন্যায়বিচার ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে কোনো স্থায়ী শান্তি আসবে না।

সূত্র, আমার দেশ