আগামী ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন হবে—প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের এ ঘোষণা শুনে কল্পনায় ভেসে ওঠে একটি ছবি, ধোপদুরস্ত পোশাকে মন্ত্রী হিসেবে একদল নেতা বা সংসদ সদস্য শপথ নিচ্ছেন।
মনে প্রশ্ন জাগে, তাঁরা কারা হবেন? কোন বিশেষ যোগ্যতা তাঁদের? কেন তাঁরাই থাকবেন দলগুলোর পছন্দের তালিকায়? জনসমাজে কী কথা বলা হয় তাঁদের সম্পর্কে?
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনকে মাথায় রেখে সম্ভাব্য মন্ত্রীদের রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন ও সংস্কৃতি কী হবে, তা ভাবতেই মনে পড়ে কৈশোরের এক অভিজ্ঞতা।
একেকটি এলাকার বাসিন্দাদের ‘রিজিক’ (জীবিকা অর্থে) একেকজন বিশেষ ব্যক্তির অসিলায় নির্ধারিত হয় বলেই গভীর বিশ্বাস ছিল গ্রামের শ্রমজীবী মানুষ জলিশ খাঁর। ফসল কাটার মৌসুমে ব্যস্ত দিনের শেষে ‘বাংলাঘরে’ এক নৈশভোজের জমজমাট আড্ডায় তিনি দাবি করে বসেন, গ্রামের সেই ‘বুজুর্গ’ ব্যক্তিটি কে, তা তাঁর জানা।
ক্লান্ত, তবু কৌতূহলী কৃষিশ্রমিকেরা অনেক ‘গবেষণা’ করেও সেই রহস্যময় ব্যক্তির কূলকিনারা খুঁজে পেলেন না। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে গৃহস্থ বাড়ির এক শিক্ষিত যুবক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি মনে করো, তুমিই সেই ব্যক্তি?’ জবাবে আত্মবিশ্বাসী জলিশ খাঁ হুঁকায় লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘হ্যাআআ...।’
দিনমজুর জলিশ খাঁ কিন্তু নিজেকে ‘রিজিকদাতা’ দাবি করেননি। তবে পলাতক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাভাবিক গলায় বলেছিলেন, ‘রেহানা (ছোট বোন) আমাকে বলল, “তুমি ১৬ কোটিকে খাওয়াতে পারলে, ১০ লাখ (রোহিঙ্গা)–কেও খাওয়াতে পারবে।”’
দুই দফায় বিশ বছরের অধিক কাল বাংলাদেশ শাসন করা হাসিনা আমাদের কারও বাসায় ভাত–তরকারি পাঠিয়েছেন বলে শুনিনি। তবে সম্প্রতি কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের নেত্রী ও তাঁর দলবল-অনুসারীরা জাতীয় সম্পদের রক্ষক সেজে ভক্ষণ এবং যা খুশি তা-ই করার কাজটি ঠিকমতোই করেছেন।
হাসিনাকে কদমবুছি করা অযোগ্য ব্যক্তিরা এবং ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নানা অপকর্মে শরিকদের মন্ত্রিসভা ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে যথেচ্ছাচারে নিয়োগ দিয়েছেন। তাঁর ‘দেবত্ব’ জাহির করা সংস্কৃতির ইতি টানা ছিল জুলাই ২০২৪ বিপ্লবের অন্যতম উদ্দেশ্য।
নতুন বাংলাদেশে আমাদের চাওয়া, নির্বাচনে জয়ী হয়ে যাঁরা মন্ত্রিসভায় যোগদান করবেন, তাঁদের জনগণের নজরদারির মধ্যে থাকতে হবে। তাঁদের কর্মকাণ্ড নিয়েও অনেক বেশি সমালোচনা হবে, যদি সমাজে গণতন্ত্র কার্যকর থাকে।
পৃথিবীতে প্রচলিত প্রধান কোনো ধর্মই রিজিকদাতার উপাস্যকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বীকৃতি দেয় না, হোক না তিনি রাজা/রানি বা ভিন্ন ধাঁচের শাসক।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের হওয়ার কথা জনগণের পক্ষে ক্ষমতার হেফাজতকারী। রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রিসভা ও আমলাদের হওয়ার কথা জনসেবা প্রদানের খাদেম।
নতুন বাংলাদেশে আমাদের চাওয়া, নির্বাচনে জয়ী হয়ে যাঁরা মন্ত্রিসভায় যোগদান করবেন, তাঁদের জনগণের নজরদারির মধ্যে থাকতে হবে। তাঁদের কর্মকাণ্ড নিয়েও অনেক বেশি সমালোচনা হবে, যদি সমাজে গণতন্ত্র কার্যকর থাকে।
নির্বাচনে সম্ভাব্য বিজয়ী বা এমনকি পরাজিত দলও ভালোভাবে সংসদ-সরকার পরিচালনা ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির স্বার্থে নেতাদের মধ্য থেকে এবং দলীয় নীতি ও মতাদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যোগ্য ব্যক্তিদের একটি তালিকা (প্যানেল) প্রণয়ন ও প্রকাশ করতে পারে। আবার যদি তারা মনে করে মন্ত্রী বা ছায়ামন্ত্রীর ধারণা এখনই প্রকাশ করব না, তাহলে তারা তা না-ও করতে পারে।
তবে নির্বাচনের আগেই দলের হবু প্রধানমন্ত্রী (প্রাইম মিনিস্ট্রিয়াল ফেস) বা রাষ্ট্রপতি প্রার্থী এবং কোন মন্ত্রণালয় ও সেক্টরে কে নেতৃত্ব দেবেন, সেই ধারণা জনগণকে দেওয়া হলে, ওই দল প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে।
অবশ্যই আগামী সরকারের কাজ কঠিন হবে ফ্যাসিবাদ–পরবর্তী বাস্তবতার বাইরেও আরও অন্তত দুটি কারণে: (এক) জন-আকাঙ্ক্ষা ও সংস্কারের ভার এবং (দুই) শাসনপ্রক্রিয়ায় নতুন প্রজন্মের উপযোগী প্রমাণিত মডেল না–থাকা।
ওই অবস্থায় সংসদ সদস্য, বিশেষ করে মন্ত্রীদের ধারণা না-ও থাকতে পারে তাঁদের কী করা উচিত এবং তাঁদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল কী হতে পারে।
সে জন্য লাগবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতা এবং ইচ্ছাশক্তি থাকলে তাঁদের সামনে সুযোগও থাকবে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার, জনগণের দীর্ঘ হতাশা দূর করার।
নিশ্চিত থাকুন, রাজনীতিবিদদের সস্তা বুলি আওড়ানোর দিন ‘বাঘে খেয়েছে’ এবং নতুন প্রজন্ম রাজনীতির জটিল সমীকরণের দোহাই শুনে বছরের পর বছর ধৈর্য ধরতে রাজি হবে না।
অন্তর্বর্তী সরকার-গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নে অনীহা বা দ্বিধা থাকলেও পরবর্তী ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সংস্কারের দাবিকে অগ্রাহ্য করা সহজ হবে না। সংস্কারের ‘পদ্ধতিগত’ বেড়াজালে মন্ত্রীরা আটকে গেলেও সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি ব্যাহত হতে পারে।
এ ব্যাপারে সাবধান থাকতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের উচিত সরকার পরিচালনার জন্য সঠিক মানুষ বাছাই এবং সরকারিযন্ত্র ও জনকল্যাণ ভালো করে বুঝে পরিবর্তন আনার সাহস সঞ্চয় ও কৌশল ঠিক করা।
অন্যথায় নির্বাচনে বিজয়ী দল মন্ত্রিসভা (ক্যাবিনেট) গঠনের পর মন্ত্রীরা মন্ত্রণালয়ে ঢুকে পড়লেই পুরোনো আলসেমি (ল্যাথার্জি) ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বন্দী হয়ে যেতে পারেন।
তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো পেশাদার বিবেচনায় যোগ্য মানুষদের একটি প্যানেল তৈরি করতে পারে, যাতে মোটাদাগে সরকারের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোয় দক্ষতাসহকারে কার্যসিদ্ধির যথাযথ উপায় বের করা যায়। হোমওয়ার্ক করা দরকার কী কী হতে পারে নির্বাচিত রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়গুলো, যেমন:
(ক) জাতীয় নিরাপত্তা ও জন-অধিকার রক্ষা: বাংলাদেশ রাষ্ট্র সুসংহতকরণ এবং এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীকে সর্বোচ্চ ও সার্বিক নিরাপত্তা প্রদান সরকারের প্রশ্নাতীত দায়িত্ব। এটা করতে পারার মতো হিম্মত থাকা চাই মন্ত্রীপ্রত্যাশীদের। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অন্যতম হচ্ছে প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং টেলিযোগাযোগ।
(খ) অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ ও জনগণের সম্পদের ব্যবস্থাপনা: সমাজে সম্পদ ও সুযোগের সুষ্ঠু বণ্টন, ব্যক্তির উদ্যোগ ও সাফল্যের উপযোগী পরিবেশ ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সম্পর্কে ক্যাবিনেট সদস্যদের সুস্পষ্ট বোঝাপড়া ও নৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান না থাকলে শাসন ব্যাপারটি অত্যাচার বা ব্যর্থতায় পরিণত হতে বাধ্য। এই গুচ্ছের মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে থাকে অর্থ, কৃষি, শিল্প, পরিবেশ, যোগাযোগ ও পূর্ত।
(গ) মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ভঙ্গুর মানুষের সুরক্ষা: উচ্চশিক্ষিত, দূরদৃষ্টি ও মানবিক চেতনাসম্পন্ন এবং জাতি গঠনে দৃঢ়চেতা নেতা ছাড়া কাউকে এ ধরনের দায়িত্ব দেওয়া ছেলেখেলার শামিল। এ–জাতীয় কাজে প্রাসঙ্গিক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং সমাজকল্যাণ।
(ঘ) প্রশাসনিক সেবা, গণপ্রতিনিধি নির্বাচন ও ন্যায়বিচার প্রদান: সরকারের ক্ষমতা ও জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন হবে, সমাজে অন্যায়-অবিচারের ঘটনা ঘটলে মানুষ কীভাবে বিচার পাবে, এবং নির্বাচন ও নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে কী করে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া ও সংরক্ষণ করা যাবে, এসব বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য আইনের দর্শন ও রাজনৈতিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য এ রকম যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ আবশ্যক।
(ঙ) বৈশ্বিক সম্পর্ক ও জাতীয় স্বার্থ অর্জন: প্রযুক্তির বিস্ফোরণ, রাষ্ট্রবহির্ভূত সত্তার (নন-স্টেইট অ্যাক্টর) উত্থান এবং শক্তির ভরকেন্দ্র ও পরাশক্তিগুলোর মেরুকরণে চলমান পরিবর্তন বাংলাদেশের মতো দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তাই পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, নৌপরিবহন, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে নেতৃত্ব দিয়ে জাতীয় স্বার্থ উদ্ধার করতে সে রকম গতিশীল ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন মন্ত্রী বানানোর প্রয়োজন হবে।
(চ) জাতীয় ভাবনার বয়ান ও উন্নয়নের এজেন্ডা নিরূপণ: আমাদের জন্য ফ্যাসিবাদী আমলের শিক্ষা এই যে দুষ্ট শাসকের দুষ্ট এজেন্ডা নিয়ে রাষ্ট্রীয় আলোচনা জনগণকে গণতন্ত্রবঞ্চিত রাখে এবং দেশে-বিদেশে জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়, কিন্তু নাগরিকদের প্রতিবাদের সামর্থ্য শুকিয়ে যায়। সে জন্য রাষ্ট্র নিজেই তথ্য, পরিকল্পনা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীদের নেতৃত্বে জনস্বার্থ তুলে ধরতে ও জাতীয় সংহতি নির্মাণে বয়ান তৈরিতে পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে এবং তাতে নাগরিকেরাও মানবিক বিকাশের বিকল্প ধারণা উপস্থাপনের উৎসাহ পেতে পারে।
ইতিহাসের অগ্রযাত্রায় পুরোনো ব্যবস্থার সংস্কার এবং নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক উত্তরণের মুহূর্তে অভিজ্ঞতা ও নতুন চিন্তার কারণেই ভাবী মন্ত্রীদের বিষয়ে আমাদের কৌতূহল থেকেই যাবে।
তাহলে কে হচ্ছেন আগামী সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বা জনপ্রশাসন মন্ত্রী? এসব পদের জন্য দলীয় পছন্দ আগেভাগে জানতে পারলে ভোট দিতে জনগণের একটু সুবিধা হবে।
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক
*মতামত লেখকের নিজস্ব