সবশেষ এটিই সত্য, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওই দুই শিক্ষিকার এ আত্মত্যাগ সংজ্ঞায়িত করার কোনো ভাষা আমাদের জানা নেই। তবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুপ্রভাত কবিতার ক’টা লাইন বেশ জুতসই মনে হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
কেউ হয়তো স্বজন হারানোর বেদনা কেমন তা বোঝাতে শত শত পরিবারে আজীবনের কান্নার রোল ফেলে দিয়ে নিজেকে মহান ভাবেন। আবার কেউ কেউ বহু পরিবারের কান্না থামাতে নিজের পরিবারকে কান্নায় ভাসিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন। এরকম জীবন উৎসর্গ ও আত্মত্যাগের ঘটনা ইতিহাসে খুব কম আছে। আমি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী ও মাসুকা বেগম নিপুর কথা বলছি। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তারা যেভাবে আগুনে ঝলসে যাওয়া শিশুদের বাঁচাতে গিয়ে জীবন বিলিয়ে দিলেন তা ইতিহাসে লেখা থাকবে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে।
আমাদের মতো রাজনীতি শাসিত সমাজে ভোগবাদ যখন চরম আকার ধারণ করেছে, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’-এ মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিটি পরিবার যখন ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুননে ব্যস্ত কিংবা তারা যখন সন্তানদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য প্রতিযোগিতা করছেন; তখন ওই দুই শিক্ষিকার এ ধরনের আত্মদান এক বিরল ঘটনা। আমরা ফরাসি জাতির গৌরব জোয়ান অব আর্কের কাহিনী জানি। তিনি ফরাসি জাতির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে করতে ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। তারপর বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু মাইলস্টোনের ওই দুই নারী শিশুদের বাঁচাতে গিয়ে নিজেরা পুড়ে জীবন দান করে গেছেন। ইতিহাসে আরো অনেক মহীয়সী নারীর আত্মত্যাগের কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। তারা অবদান রেখেছেন নানাভাবে নানা ক্ষেত্রে। কিন্তু এ ধরনের জীবন দানের ঘটনা খুব কম আছে। তারা ওই সব মানুষের মতো না, যারা নিজের শোক কেমন তা বোঝানোর জন্য অন্যদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছেন; বরং তারা নিজেদের পরিবার-পরিজনকে নিদারুণভাবে শোকাহত করে অন্য অনেক পরিবারে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন।
মাহরীন ছিলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণীর সমন্বয়ক। মৃত্যুর পর জানা গেল, তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভাতিজি। কিন্তু বিশাল এক রাজনৈতিক পরিবারের ঐতিহ্য থাকলেও সে পরিচয় দিয়ে কখনো কোনো সুবিধা তিনি নেননি, যা বাংলাদেশের কোনো কোনো পরিবারের অতি দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় রাষ্ট্রীয় লুটের ভাগীদার হয়েছেন; বরং এখন বলা যায়, রাজনৈতিক পরিবারের বিরাট আঙ্গিনা ডিঙিয়ে মাহরীন নিজে এখন এক কিংবদন্তি নারীতে পরিণত হয়েছেন। কী অসাধারণ তার এ কীর্তিগাথা যা এখন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
সেদিন স্কাই নামে তৃতীয় শ্রেণীর যে কক্ষটিতে তিনি পড়াচ্ছিলেন সেখানে আছড়ে পড়েছিল প্রশিক্ষণ বিমানটি। দাউ দাউ করে জ্বলছিল আগুন। কক্ষটি পরিণত হয়েছিল একটি জ্বলন্ত চুল্লিতে। শিশুরা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল। সেটি ছিল বিভীষিকাময় এক দৃশ্য। মাহরীন জীবনের সব মায়া ত্যাগ করে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক এক করে শিশুদের বের করে আনছিলেন। এভাবে তিনি ২০টি শিশুর প্রাণ রক্ষা করেন। তারপর নিজে ভয়াবহভাবে দগ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তিনি নিজের জীবন, স্বামী, দুই সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রলুব্ধকর জাগতিক জীবনের মায়া-মমতা কিংবা মোহ কোনো কিছু তাকে ক্ষণিকের জন্যও দ্বিধান্বিত করেনি।
শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল তার। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, হাসপাতালে অন্তিম শয্যায় স্বামী মনসুর হেলালকে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা ছিল হৃদয়বিদারক। তিনি স্ত্রীর সাথে তার শেষ কথাগুলোর বিবরণ যখন সাংবাদিকদের দিচ্ছিলেন তখন সেখানে উপস্থিত কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
সাংবাদিকদের তিনি বললেন, লাইফ সাপোর্টে নেয়ার আগে সে আমাকে বলল, আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরো। কিন্তু ধরার উপায় ছিল না, ক্ষতবিক্ষত ছিল সে হাত। তারপর ক্ষীণ কণ্ঠে আমাকে বলল, তোমার সাথে আর দেখা হবে না। আমি তখন কাঁদছিলাম। আর কাঁদতে কাঁদতে বললাম, তোমারও তো দু’টি সন্তান আছে, ওদের এতিম করে চলে গেলে। একবারও তাদের কথা ভাবলে না। মাহরীন জবাবে বলল, ওরাও আমার সন্তান, ওরা পুড়ে মারা যাচ্ছিল। আর আমি যে ওদের রক্ষা করার শপথ নিয়েছিলাম। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের এ কথাগুলো মনসুর হেলালের হৃদয়ে কতটা বেদনার ঝড় তুলেছিল তা হয়তো কারো পক্ষে জানা সম্ভব হবে না। কিন্তু তার বাকি জীবন ওই মুহূর্তটুকু বারবার তাকে তাড়া করতে থাকবে।
একইভাবে মাসুকা বেগম নিপুর আত্মত্যাগ আমাদের হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। তিনিও তার ছোট্ট ছাত্রদের বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। নিপু যখন পড়াচ্ছিলেন তখন বিমানটি বিধ্বস্ত হয় সে ক্লাসটির উপরে। তার সহকর্মীদের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার সাথে সাথে তিনি জীবন বাঁচাতে দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সেই ভয়াবহ সময়ে শিশুদের রেখে তিনি পালিয়ে যাননি। তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল।
মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মাসুকা চলে গেলেন অসীম জগতে যেখান থেকে কেউ আর কখনো ফিরে আসে না। না হলো তার সংসার জীবন, না হলো বাকি কোনো স্বপ্ন পূরণ। অপার এক শূন্যতা নিয়ে মহাশূন্যে হারিয়ে গেলেন। কেন তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন এবং কেনই বা এভাবে জীবন উৎসর্গ করে পৃথিবী থেকে চলে গেলেন তা এক আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তবে তিনি যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা আমাদের এ বিবেকহীন সমাজের জন্য বিরাট একটি শিক্ষা।
সবশেষ এটিই সত্য, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওই দুই শিক্ষিকার এ আত্মত্যাগ সংজ্ঞায়িত করার কোনো ভাষা আমাদের জানা নেই। তবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুপ্রভাত কবিতার ক’টা লাইন বেশ জুতসই মনে হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।