গাজায় চলমান নৃশংসতাকে যদি আমরা এক কথায় বলতে চাই, তাহলে বলতে হবে—একটা দানব পুরো একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের হাতে রয়েছে বিশ্বের আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্র। তবু তারা সন্তুষ্ট নয়। এরা মানুষকে না খাইয়ে মারার প্রাচীন যুদ্ধকৌশল ব্যবহার করছে। কঠোর অবরোধের মধ্য দিয়ে তারা গাজার জনগণকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই দানবকে মোকাবিলা করার বদলে বিশ্ববাসী এই দানবটির কাছেই অনুরোধ করছে, যেন সে গাজায় কিছু খাবার-দাবার ঢুকতে দেয়। বিশ্ববাসী যেন মেনেই নিয়েছে, গাজার ভুক্তভোগীরা দুর্গম কোনো অঞ্চলে বসবাস করছে এবং সেখানে খাবার পৌঁছানো সম্ভব নয়।

মানবতার অমোচনীয় কলঙ্ক

আমরা দেখতে পাই, গাজার ওপর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান উড়ে যায় আর ইসরাইলের পাতা ফাঁদ কতটা কার্যকর তা পর্যবেক্ষণ করে। অথচ ওরা বলে, ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র স্থাপনের জায়গা বাছাই করতেই যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানগুলো গাজার আকাশসীমায় প্রবেশ করে। অথচ ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিডল ইস্ট প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফ কিছুতেই গাজার বোমা হামলা, দুর্ভিক্ষ আর স্নাইপিং করে মানুষ মারা বন্ধ করতে কোনো পদক্ষেপ নেয় না।

এই উইটকফ হচ্ছেন মৃত্যুর দূত। তিনি একদিকে ভুক্তভোগীদের ওপর দোষ চাপান, অন্যদিকে ইসরাইলের হাতকে শক্তিশালী করেন, যাতে এই দানব গাজাবাসীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। দানবটি যখন আরব রাষ্ট্রগুলোয় অবাধে বিচরণ করছে, তখন আমরা (আরব বিশ্বের জনগণ) নীরব দর্শকের ভূমিকায়। একদিকে আমরা ক্ষমতাহীন, অন্যদিকে আমাদের শাসকরা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তটস্থ।

বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলো যখন একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে নিউ ইয়র্কে আলোচনা করতে বসেছিল, তখনো ইসরাইল গাজা ও পশ্চিমতীরে ধারাবাহিকভাবে সন্ত্রাসী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। নিউ ইয়র্কের আলোচনার পর ঘোষিত সিদ্ধান্তকে হোয়াইট হাউস থেকে প্রত্যাখ্যান করা হলো। এর মধ্য দিয়ে হোয়াইট হাউস যেন বার্তা দিল, ফিলিস্তিনি জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা শুধু ইসরাইল দানবের হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছে। এদিকে গাজায় যা চলছে, তা কোনো হলিউড মুভি লেখকের পক্ষেও কল্পনা করা সম্ভব নয়। তার চেয়েও বীভৎস দৃশ্য সারা দুনিয়ার মানুষ সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে দেখছে।

অন্ধকারের মধ্যে আলো

এত হতাশার মধ্যেও কিছু আশার ঝলক রয়েছে। পুরো ইউরোপে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে জনমতের পরিবর্তন হয়েছে। সারা বিশ্বে ফিলিস্তিনের সমর্থনে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে ফিলিস্তিন এখন সাধারণ জনগণের নিজস্ব ইস্যু। এখন আর এটি দূরবর্তী কোনো জাতির নিজস্ব সমস্যা নয়।

গাজার প্রতি এই সহানুভূতি আসলে মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এতদিন ধরে মিডিয়ায় প্রোপাগান্ডা চালিয়ে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে রাখা হয়েছিল। ক্ষুধার্তদের গোঙানি আর মৃত্যুপথযাত্রীদের চিৎকারের মধ্যে ফিলিস্তিনের জন্য এটাই একমাত্র আশার আলো। হোয়াইট হাউসে বসে থাকা ইসরাইলের প্রভু মিটমিট করে জ্বলা এই আলোকে নিভিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তবু সেই সর্বাংশে সফল হচ্ছে না।

এদিকে গাজায় যখন এ অবস্থা, তখন তথাকথিত ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ব্যাকুল। তাহলে এই গণহত্যা থামবে কীভাবে? এই রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলকে নিজেদের বুকে টেনে নিচ্ছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদেরই ভূমিতে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি করে রাখার বৈধতা দিচ্ছে। আকাশ থেকে কিছু খাবারের প্যাকেট ফেলে দিয়েই এসব আরব রাষ্ট্র সন্তুষ্ট। এই মানুষগুলোকে মুক্ত করার ব্যাপারে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

কম প্রতিরোধ মানে বেশি লাশ

আমি বলছি না যে গাজায় সাহায্য পৌঁছানো নিরর্থক। কিন্তু আমরা যে এই দানবের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছি, তার ফলে শুধু লাশের সংখ্যাই বেড়ে চলছে। এভাবেই আমরা তাদের অপরাধের অংশীদার হয়ে উঠছি, তাতে আমাদের উদ্দেশ্য বা বুঝ-ব্যবস্থা যাই হোক। এর কারণ হলো, আমাদের আরব রাষ্ট্রগুলো বিশ্বাস করে প্রতিরোধহীন পথই সমৃদ্ধির পথ। কিন্তু তারা ভুলে যায়, গাজার শিশুদের লাশের ওপর দিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ গড়ে উঠতে পারে না।

ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার নগরীর রাস্তায়, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকেও লাখ লাখ মানুষ ফিলিস্তিনের পক্ষে মিছিল করছে। ‘ভিভা ফিলিস্তিনা’ এবং ‘আমার রক্ত ফিলিস্তিনি’ স্লোগানে তারা রাজপথ প্রকম্পিত করছে। ঠিক তখনই আরব রাজধানীগুলোয় এমন প্রতিবাদ নিষিদ্ধ। কিছু আরব রাষ্ট্রে ফিলিস্তিনের পতাকা ওড়ানো পর্যন্ত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আরবদের সাংস্কৃতিক ও সংগীত উৎসবগুলো থেকে ফিলিস্তিনের নামটিও প্রায় উধাও হয়ে গেছে। যে শিল্পীরা এখনো সংহতি প্রকাশ করেন, তাদের এর জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে।

আরব দেশগুলোর সার্থকতা যদি কিছু থাকে, তা হচ্ছে তারা তাদের জনগণকে হতাশায় নিমজ্জিত করতে পেরেছে। তারা নিজেদের সমাজে পরিবর্তন ঘটার ভয়ে তটস্থ থাকে। অথচ তাদের উৎখাত করার মতো কোনো বিরোধী শক্তি নেই বা থাকলেও তারা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এই রাষ্ট্রগুলো শুধু ওয়াশিংটনের কাছে জবাবদিহি করে, নিজেদের জনগণের কাছে নয়।

আরব মাতৃভূমি নামক বিভ্রান্তি

গাজার বিপন্ন মানুষ বেঁচে থাকতে অর্থ সাহায্য চেয়ে বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানাচ্ছে। অথচ তাদের চারপাশের আরব ভূমিতে প্রতিদিন বিপুল সম্পদ জমা হচ্ছে। আরবীয়দের ২২ মাসের আঁতাত আর নিষ্ক্রিয়তার পর ফিলিস্তিনিদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে, তাদের বৃহত্তর মাতৃভূমি আরব বিশ্ব আসলে মরীচিকা ছাড়া কিছুই নয়। একদিন আমরা (আরবরা) ঠিকই বিশ্ববাসীর জবাবদিহির মুখোমুখি হব।

যারা গাজার শিশুদের জীবন বাঁচাতে সামান্য অর্থ ব্যয়ে ভয় পায়; যেকোনোভাবে নিজেদের ‘সভ্য’ প্রমাণ করতে চায়, যারা ইসরাইলকে ভালোবাসে এবং জায়নবাদীদের অজুহাতগুলোর পক্ষে তোতাপাখির মতো সাফাই গায়, এমনকি চলমান বর্বরতাকে ‘ন্যায়সংগত’ প্রমাণ করতে চায়, তাদেরও একদিন জবাবদিহি করতে হবে।

এ অবস্থায় আমাদের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ নেই। ৬০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পর কিছু বিশ্লেষক আর রাজনীতিবিদের ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু কার্যকর প্রতিরোধ গড়তে আমাদের আর কতজনের রক্ত দরকার? আমাদের নিজেদের কার্যক্রমের পর্যালোচনা করতে হবে, যাতে বর্তমান সুযোগটা আমরা নষ্ট না করি। বিশ্বে একটি পরিবর্তন ঘটছে। এটি অস্বীকার করার উপায় যেমন নেই, তেমনি আমাদের নির্লিপ্ত থাকারও কোনো সুযোগ নেই।

আশা ছড়িয়ে দিতে হবে

অনেকেই করণীয় নিয়ে ভাবছেন, যা করণীয় তা আসলে কঠিন, কিন্তু আমাদের হতাশ হওয়া চলবে না। অনেকে ইতোমধ্যেই অনেক কিছু করছেন। তাদের সঙ্গে আমরা যোগ দিতে পারি। বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট এবং স্যাংশনস (বিডিএস) আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিতে হবে। এটি একটি কার্যকর ঐতিহাসিক কৌশল। অনুদান পাঠানো এবং সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়াসহ সক্রিয় অংশগ্রহণ করাও সমানভাবে জরুরি।

আমাদের বড় সমস্যাগুলোর একটি হলো, অনেকে আরব আছেন যারা ফিলিস্তিন সম্পর্কে নিতান্তই অজ্ঞ। এমনকি নিজ দেশের সমস্যা সম্পর্কেও অজ্ঞ। তারা বোঝেই না কী ঘটছে। এরা বিশ্বজুড়ে তরুণদের দ্বারা অনুপ্রাণিতও হয় না। অথচ বহু দেশের তরুণরা ফিলিস্তিনের ইস্যুতে কাজ করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞে পরিণত হয়েছেন।

একটি সচেতন প্রজন্মের সৃষ্টি হয়েছে, যারা আত্মসমর্পণ আর অপমানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। তারা শক্তি, সাহস, বোধ আর জ্ঞানের আলোয় পথ চলার চেষ্টা করছে। আমাদের পথ দীর্ঘ, কিন্তু আমাদের কর্তব্য হলো আশার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। কারণ পরাজয় আমাদের হতাশা আর আত্মবিশ্বাস হারানোর ভেতরেই নিহিত।

আমেরিকা আর ইসরাইল যা করছে, তা স্পষ্ট। তারা আমাদের বোঝাতে চায় : আমাদের অঞ্চল এখন ইসরাইলি প্রভাব বলয়ের মধ্যে রয়েছে। চলমান অপরাধ নিয়ে চুপ থাকা এবং নবী ইউসুফের ভাইদের মতো আচরণ করা ছাড়া আমাদের আর উপায় নেই। আর আমাদের মুক্তি নিহিত রয়েছে শুধু আত্মসমর্পণ আর আনুগত্যে।

কিন্তু আমেরিকা-ইসরাইলের এসব আবদার মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা শুধু দানবটাকেই আশকারা দিই। দানবটিও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ও আমাদের নিশ্চিহ্ন করার মধ্যেই সার্থকতা খুঁজে পায়।

নিউ আরব থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা

সূত্র, আমার দেশ