আজিকার দিনে রাজনীতিতে আমরা কী প্রত্যক্ষ করিয়া থাকি? উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতির অবস্থাই-বা কী? সেই সকল দেশের রাজনৈতিক নেতারা কি সমাজের উন্নতিসাধনে নিবিষ্ট রহিয়াছেন, নাকি 'ক্ষমতার লোভের সাগরে' সাঁতার কাটিতেছেন মনের সুখে? এই সকল প্রশ্নের উত্তর রহিয়াছে সেইখানকার সমাজে প্রচলিত নানা হাস্যরসাত্মক কল্পকথার মধ্যেই; উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচনের সময় এক নেতা জনগণের উদ্দেশে আর্জি রাখেন, 'আমাকে ভোট দিয়া দেখেন, প্রত্যেকের মুখে হাসি ফুটাইব।' বলা বাহুল্য, জনতা তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া বসেন, 'কীভাবে, সবাইকে একটি করিয়া জোকসের বই দিবেন?'

সত্যি বলিতে, কোনো কোনো উন্নয়নশীল দেশে রাজনীতি যেন হইয়া উঠিয়াছে 'জোকস বা কৌতুক'! সেইখানকার রাজনীতিবিদদের আচরণ ও কর্মকাণ্ড যে এমন হইবে, তাহা সম্ভবত অনুধাবন করিয়াছিলেন খোদ ওয়েবারও; আর তাই উক্ত বক্তব্যের শেষাংশে তিনি আহ্বান জানাইয়াছিলেন এই বলিয়া যে, 'রাজনীতিবিদদের নৈতিক মেরুদণ্ড থাকা উচিত। তাহাদের প্রতিটি কার্যক্রমের সুস্পষ্ট লক্ষ্য থাকা উচিত এবং তাহারা যখন ইতিহাসের পরিবর্তনের দিকে আগাইবেন, তখন তাহাদের থাকিতে হইবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বিচার করিবার ক্ষমতা।'

লক্ষণীয়, এই সকল দেশে যখন যিনি বা যাহারা ক্ষমতার চেয়ারে বসেন, তখন তাহাদের ইচ্ছাই হইয়া উঠে 'শেষ কথা'। বিশেষ করিয়া, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অবস্থা এতটা বেগতিক হইয়া উঠে যে, দেশের নিয়মকানুন, কোর্টকাচারি, থানা-পুলিশ সকল কিছুই তাহাদের ইশারায় চলে! এমনও ঘটে, ক্ষমতার পালাবদলের পর এমন সকল নেতৃত্ব বা নেতার আবির্ভাব ঘটে, যাহার বা যাহাদের অতীত রেকর্ড সুখকর নহে! অর্থাৎ, তাহাদের বিরুদ্ধেও একসময় অভিযোগের স্তূপ ছিল, খুনখারাবি-দুর্নীতির মামলা ছিল-এমনকি অনেক অভিযোগ আদালতের বিচারে প্রমাণিত পর্যন্ত; কিন্তু নূতন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখে কোনো এক অদৃশ্য জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় তাহাদের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ রাতারাতি অদৃশ্য হইয়া যায়। উপরন্তু, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কোটিপতি বনিয়া যাওয়া একসময়কার ব্যবসায়ী-বণিক শ্রেণিরও প্রত্যাবর্তন ঘটে-যাহাদের বিরুদ্ধেও একসময় বহু গুরুতর অভিযোগের খড়ুগ ছিল!

এই সকল ভূখণ্ডে ক্ষমতায় থাকাকালে সকলেই যেন রাষ্ট্রযন্ত্রকে হাতের পুতুলের ন্যায় ব্যবহার করিতে চাহে! ফলে ক্ষমতায় আরোহণকালে হেন অন্যায়-অপকর্ম, অনাচার নাই, যাহা তাহারা করেন না। সবচাইতে বড় যেই কাজটি করেন, বিরোধী শক্তিগুলির উপর দমনপীড়ন চালাইয়া তাহাদের কার্যত পঙ্গু এবং ঘরছাড়া-এলাকাছাড়া করিয়া দেন। ফলে সেই সকল দলের নেতাকর্মীরা নূতন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পর আর রাজনীতি করিবার মতো পর্যায়ে থাকিবার ফুরসত পান না। প্রশ্ন হইল, যাহাদের বিরুদ্ধে একসময় অভিযোগ ছিল কিংবা যাহাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ একদা আদালতের রায়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিতও হইয়াছে, তাহারা রাতারাতি খালাস পাইয়া যায় কী করিয়া? আরো সাংঘাতিক বিষয়, 'সেই তাহাদের' হাতেই যদি ক্ষমতার চাবি চলিয়া যায়, সেই ক্ষেত্রে যে কী ঘটিতে পারে, তাহা বুঝিতে কি রাজনীতি বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন আছে?

এই সকল দেশের 'রাজনীতির আসল চিত্র' এবং রাজনীতিবিদদের এই কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যক্ষ করিয়া ধন্দে পড়িয়া যাওয়া জনতা সেই অবস্থায় কোনটিকে 'সত্য' বলিয়া গ্রহণ করিবে-সেই সকল নেতার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযাগ মিথ্যা? নাকি আদালত তাহাদের বিরুদ্ধে যেই রায় দিয়াছিলেন-তাহা মিথ্যা? উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতিতে এহেন বিতর্কিত, অমীমাংসিত এবং কৌতূহলোদ্দীপক প্রবণতাগুলির অবসান হওয়া প্রয়োজন। ইহার অবসান না হইলে ক্ষমতার পালাবদলে পর প্রতি বারই পূর্বের সকল 'মিথ্যা' যেন 'সত্য' হইয়া যাইবে আর 'সত্য'কে 'মিথ্যা' তকমা দেওয়ার পৌনঃপুনিকতা চলিতেই থাকিবে।

সূত্র, ইত্তেফাক