ফুটপাতে গাছের সঙ্গে আয়না বাঁধা সেলুনে এক লোক চুল কাটাচ্ছে। ঠিক ওই সময়ে এক প্রভাবশালী নেতা জাতীয় নির্বাচনী প্রচারণায় বের হয়েছেন। তার সঙ্গে স্থানীয় এক দল মস্তানও রয়েছে।
ফুটপাতে গাছের সঙ্গে আয়না বাঁধা সেলুনে এক লোক চুল কাটাচ্ছে। ঠিক ওই সময়ে এক প্রভাবশালী নেতা জাতীয় নির্বাচনী প্রচারণায় বের হয়েছেন। তার সঙ্গে স্থানীয় এক দল মস্তানও রয়েছে। পেশিশক্তি প্রদর্শনের নির্বাচনগুলোয় যেমনটা হয় আর কী। দলীয় এক কর্মী সেই চুল কাটানো লোকটার কাছে তার নেতার জন্য ভোট চাইল। তখন সেই লোক বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, দেখি তোমার নেতাকে চাকরিটা দেয়া যায় কিনা?
এ কথা শোনামাত্রই মস্তানদের একজন ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে মারতে উদ্যত হলো। এমন সময় প্রার্থী নিজে সেখানে হাজির হলেন। খুব শান্ত গলায় বললেন, আমরা তো আপনার কাছে ভোট চাইছি, চাকরি না। আপনি কোন চাকরি দেয়ার কথা বলছেন? তখন লোকটি বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন ‘কেন, দেশ চালানোর চাকরি!
বাস্তবে আমরা পিয়ন, চৌকিদার, দফাদার নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনেক বেশি সচেতন থাকি। নানা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু যারা দেশটা চালাবে তাদের নিয়োগ দেয়ার সময় প্রার্থীদের দেশপ্রেম, কমিটমেন্ট, শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনীতির দক্ষতা বা ভিশন সম্পর্কে আদৌ কোনো খোঁজখবর নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না। ওপরে বর্ণিত বিজ্ঞাপনটি সেই ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতেই নির্মিত হয়েছিল প্রতিবেশী এক দেশে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বোধহয় সর্বাধিক উচ্চারিত শব্দ হলো নির্বাচন। কিন্তু সাধারণ মানুষের এ ব্যাপারে সচেতনতা প্রকৃতপক্ষে কোন পর্যায়ে রয়েছে? আমরা ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনকে যদি গণতন্ত্রায়ণের পথে বড় এক টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে তিন যুগে এক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতি হয়েছে কি? তাছাড়া ৫ আগস্ট-পরবর্তী বহুল আকাঙ্ক্ষিত একটি ফ্রি-ফেয়ার ও ক্রেডিবল ইলেকশন করার জন্য যেসব বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য প্রস্তুতি দরকার—সেই পথে ঠিক কতটা এগোল বাংলাদেশ?
প্রথমত, এর আগে কেয়ারটেকার সরকারগুলোর মেয়াদ স্বল্প হলেও দাপট থাকত লক্ষণীয়। তাদের মেয়াদে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো নিজেদের বৈধ ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে পারত। ফলে প্রত্যেক এলাকার মস্তান, চাঁদাবাজ, দখলদার, দলীয় ক্যাডার ও সন্ত্রাসীরা আতঙ্কে থাকত। বিশেষত, ওই সময় ধরা পড়লে কেউ তাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসবে না—সেটা বুঝে তারা আপাতত গা ঢাকা দিত। তাদের বাহ্যিক উপস্থিতি সেভাবে লক্ষ করা যেত না। ফলে প্রশাসনের পক্ষে নিজেদের পরিকল্পনামাফিক মাঠ প্রশাসন ঢেলে সাজানো ও সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষা সহজ হতো।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১০ মাসে তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টির কোনো উল্লেখযোগ্য চেষ্টা বা লক্ষণ দেখা যায়নি। সেক্ষেত্রে তফসিল ঘোষণার পর পরই এ ফ্যাক্টরগুলো নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠলে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে তো? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীর সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের নিবিড় বোঝাপড়া না থাকলে নির্বাচনের আগে মারাত্মক চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে, কোনো ম্যাজিক দিয়ে কিন্তু রাতারাতি সেই সমস্যাগুলোর সমাধান করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক প্রস্তুতি ও ত্যাগী মনোভাবের লোকজন।
দ্বিতীয়ত, অনেকদিন হলো পূর্ণাঙ্গ ইলেকশন কমিশন গঠিত হয়েছে। কিন্তু কমিশনের প্রস্তুতি, সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো নিরসনে করণীয় নির্ধারণ, সক্রিয় অংশীজনদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। তাদের সততা, যোগ্যতা ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার মতো জটিল এক কার্যক্রমে তাদের যে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা নেই, সে ব্যাপারে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত।
এখন কথা হলো, বিশ্বকাপ ফুটবলের ম্যাচ পরিচালনাকারী রেফারি সেই পর্যন্ত পৌঁছার আগে কয়েকশ ম্যাচ পরিচালনা করেন। সেগুলো থেকে নানা শিক্ষা নিয়ে তিনি সমৃদ্ধ হন, ভুলের সংখ্যা হ্রাস পায়। তার পরই তেমন হাই প্রোফাইল ম্যাচে রেফারিংয়ের সুযোগ পান। আয়োজকদের এত সতর্কতার কারণ হলো—ফাইনাল ম্যাচে তার একটা ভুল পুরো টুর্নামেন্টকে ভণ্ডুল করে দিতে পারে!
ঠিক তেমনিভাবে, বর্তমান সরকার ও কমিশনের কর্মকাণ্ড থেকে অনুমান করা যায়, তারা সরাসরি জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার দিকে এগোচ্ছেন! আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে এটা ভয়াবহ এক এক্সপেরিমেন্ট বলে মনে হচ্ছে। ইউনিয়ন, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মতো একটি স্থানীয় নির্বাচন পরিচালনারও অভিজ্ঞতা ব্যতীত জাতীয় (বিশেষত আসন্ন) নির্বাচন পরিচালনার মতো জটিল এক কাজে মাঠে নামবেন—সেক্ষেত্রে ঝুঁকির মাত্রাটা অনুমান করাও কঠিন।
উক্ত আয়োজনে একটা ভুল বা অব্যবস্থাপনা পুরো জাতিকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে দেশে অরাজক ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। নির্বাচন ব্যবস্থাপনার মতো জটিল কার্যক্রমে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতি অবলম্বনের সুযোগ নেই। ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলগুলো আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাইবে না সেটা স্বাভাবিক। কারণ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও তাদের প্রার্থীরা বিশেষ সুবিধা পাবেন। কিন্তু জাতি হবে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
তাই নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে (পরীক্ষামূলকভাবে কিছু ক্ষেত্রে হলেও) ভাবা দরকার। কারণ আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ভণ্ডুল হলে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সারা জীবনে দুনিয়াব্যাপী যা অর্জন করেছেন—রাতারাতি তা ম্লান হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে হয়তো দেশের মাটিতে পা রাখতেও পারবেন না। এক ব্যর্থতা তাকে আমৃত্যু পীড়িত করবে। তাই তিনি এত বড় বাজি ধরবেন কিনা—সেটা তাকেই ঠিক করতে হবে।
তৃতীয়ত, প্রভাবশালী দলগুলোর নেতাদের মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেটা তাদের বিভিন্ন বক্তৃতা, হুমকি-ধমকি ও অন্যান্য কার্যক্রম থেকে পরিষ্কার। তারা অধিকাংশই পেশিশক্তির নির্বাচনে অভ্যস্ত। আসন্ন নির্বাচনেও সেটাই চর্চা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে অনুমান করা যায়। কিন্তু তাদের লাইনে আনা বা সিস্টেমে রাখার জন্য নির্বাচন কমিশন, মাঠ প্রশাসন, পর্যবেক্ষকরা ও বিভিন্ন প্রেসার গ্রুপ নানামুখী কাজ করার কথা।
সেক্ষেত্রে নীতিমালায় বড় পরিবর্তন আসা সময়ের দাবি। যেমন আগের দিনে নির্বাচনের তারিখের প্রায় দেড় দিন আগ থেকে ভোটারদের কাছে ভোট চাওয়া যেত না। এখন সোশ্যাল মিডিয়া ও মোবাইল ফোনের যুগে সেটা আটকাবেন কীভাবে? আবার তখন আগের রাতে নগদ টাকা ভোটারদের মাঝে বিলি করা হতো। এখন বিকাশের মাধ্যমে পাঠালে আপনি সেটা ঠেকাবেন কেমন করে? তাই যুগোপযোগী নির্বাচনী নীতিমালা হওয়া অত্যন্ত জরুরি। সে পথে কমিশন ঠিক কতটা এগোল তা এখনো স্পষ্ট নয়।
চতুর্থত, গত কয়েক দশকে গণমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু তাদের দায়বোধের জায়গা সেভাবে স্পষ্ট হয়নি। অনেকে তাদের মালিক পক্ষের প্রত্যাশামতো ক্ষমতাধরদের প্রচারণার ও প্রতিপক্ষের চরিত্র হননের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। সেই বলয় থেকে মুক্ত করতে সরকার ও কমিশনের যে ভাবনা দরকার ছিল, তাও সেভাবে দৃশ্যমান নয়। ফলে এমন বারোয়ারি এজেন্ডা-নির্ভর গণমাধ্যম দিয়ে পুরো জাতিকে সচেতন বা ঐক্যবদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার।
অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যম যে ম্যানিপুলেট করা যায় তা তো খোদ আমেরিকার নির্বাচনেও প্রতীয়মান হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনের আগের রাতে ইনফ্লুয়েন্সিয়াল এক বা দুজনের ভিডিও সামগ্রিক নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। ভুয়া আইডি বা পেজ থেকে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রপাগান্ডা ছড়ানো হতে পারে। এমনটা হলে তাকে প্রভাবমুক্ত নির্বাচন বলা যাবে কি? তাই এসব মাধ্যমের নানামুখী অপব্যবহার ঠেকাতে সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঠিক কীভাবে কাজে লাগাবে তারও কোনো নির্দেশনা এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।
পঞ্চমত, শুরু করেছিলাম যে বিষয় দিয়ে, সাধারণ ভোটার ও সংশ্লিষ্টদের সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ কারো পক্ষ থেকেই দৃশ্যমান হচ্ছে না। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, আজকাল পাড়ার চা দোকানদারও অনেক সচেতন। যদি নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন ধারণা সত্য হতো তবে প্রভাবশালী দলের রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসত, তাই না?
কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা সেই মান্ধাতা আমলের ধ্যান-ধারণা নিয়ে বসে আছেন। অনেকেই ভাবছেন, কলা গাছ দাঁড় করালেও তাদের প্রার্থী জিতে আসবে। তাদের দলীয় আদর্শ বা নির্বাচন উপলক্ষে বিশেষ কোনো মিশন, গোল, অবজেকটিভ নির্ধারণ করার আদৌ দরকার নেই! জনগণকে বোঝানোর কোনো দায় তাদের আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে, ভোটারদেরই দায় হলো কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে তাদের নির্বাচিত করা!
এমন মানসিকতা থাকলে সংস্কার বা পরিবর্তন আদৌ হালে পানি পাবে কি? কিছু শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ দিয়ে যে রিপোর্টগুলো লেখানো হচ্ছে তার সাহিত্য মূল্য হয়তো বেশি। কিন্তু সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া নিতান্তই অর্থহীন। সরকার, গণমাধ্যম, সংশ্লিষ্ট কমিশন বা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সেগুলোর ব্যাপক প্রচার ও জনগ্রহণযোগ্য করার উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। ওই ডকুমেন্টগুলো একাডেমিক থিসিস নয় যে সংশ্লিষ্টরা নিজ গরজে খুঁজে বের করে পড়বে। সেগুলো আম-জনতাকে সহজভাবে বোঝানো এবং তাদের সচেতন করা টেকসই পরিবর্তনের জন্য জরুরি। কিন্তু এ ব্যাপারে লক্ষণীয় উদ্যোগ বা তৎপরতা এখনো দেখা যাচ্ছে না।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। এখানে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পক্ষের স্টেক থাকবে। সেগুলো মোকাবেলা করে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্যও অনেক বেশি প্রস্তুতি দরকার। হাতে সময় এক বছরেরও কম। এখনই জোরেশোরে উদ্যোগগুলো নিলে হয়তো সামগ্রিক অর্জন সন্তোষজনক হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের প্রস্তুতি ও অংশীজনদের ইনভলভমেন্ট মোটেও আশাজাগানিয়া হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে চূড়ান্ত নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি লেজেগোবরে হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই সময় থাকতে, সাধু সাবধান!
ড. মো. আব্দুল হামিদ: সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেলের (আইকিউএসি) অতিরিক্ত পরিচালক।