৩৬ দিনের আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসের মোড় পরির্বতন করা এক রক্তাক্ত অধ্যায়। বর্ষাবিপ্লবের ধারাবাহিক বর্ণনা তুলে ধরা হলো আমার দেশ-এর পাঠকদের জন্য।
১ জুলাই :কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশে ছাত্রনেতারা ৪ জুলাইয়ের মধ্যে তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান।
২ জুলাই : আন্দোলনকারী ছাত্ররা এদিন বেলা পৌনে ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল করে নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও বাটা সিগন্যাল মোড় ঘুরে শাহবাগে শেষ করেন।
৩ জুলাই : এদিন আন্দোলনকারীরা ঢাকার শাহবাগ মোড় দেড় ঘণ্টার মতো অবরোধ করে রাখেন। একই দাবিতে আরও ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিক্ষোভ ও অবরোধ করেন।
৪ জুলাই : সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার বিষয়ে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ ‘নট টুডে’ বলে আদেশ দেন।
৫ জুলাই : ছুটির দিন শুক্রবারেও বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। চট্টগ্রাম, খুলনা ও গোপালগঞ্জে সড়ক অবরোধ করে ছাত্ররা।
৬ জুলাই : দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, ছাত্র ধর্মঘট এবং সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ডাক দেন। এর নাম দেওয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’।
৭ জুলাই : ছাত্রদের ঘোষিত বাংলা ব্লকেডে স্থবির রাজধানী। অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা।
৮ জুলাই : ঢাকার ১১টি স্থানে অবরোধ, ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ, ৩টি স্থানে রেলপথ অবরোধ এবং ৬টি মহাসড়ক অবরোধ।
কোটাবৈষম্যের বিরুদ্ধে ও স্থায়ী সমাধানের দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে ৬৫ সদস্যের সমন্বয়ক টিম গঠন।
৯ জুলাই : হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থীর আবেদন। পরদিন শুনানির ঘোষণা। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে পরদিন সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
১০ জুলাই : সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ আপিল বিভাগের।
১১ জুলাই : আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছেন। এটি অনভিপ্রেত ও সম্পূর্ণ বেআইনি। এ দিন পুলিশের বাধার মুখেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ পালন করেন আন্দোলনকারীরা।
১২ জুলাই : কোটা সংস্কারের দাবিতে শুক্রবার ছুটির দিনেও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
১৩ জুলাই : সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা।
১৪ জুলাই : গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই।’ একই দিনে পদযাত্রা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সব গ্রেডের কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন।
১৫ জুলাই : বেলা ২টায় রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
১৬ জুলাই : সারা দেশে দিনভর ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ। রংপুরে আন্দোলনকারী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের বুলেটে নিহত হওয়ার সচিত্র ভিডিও এবং ছবি প্রকাশ করা হয়।
১৭ জুলাই : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিতাড়ন করে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা।
১৮ জুলাই : দেশব্যাপী প্রতিরোধ, সহিংসতা, সংঘর্ষ ও গুলি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু লোক নিহত ও আহত হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশ ছিল অচল।
১৯ জুলাই : কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারীরা জানান, ৯ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত চলবে ‘শাটডাউন’।
২০ জুলাই : দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েন। সাধারণ ছুটি ঘোষণা।
২১ জুলাই : সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সামগ্রিকভাবে বাতিল (রদ ও রহিত) করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় প্রদান।
২২ জুলাই : কোটাপ্রথা সংস্কার করে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তৈরি করা প্রজ্ঞাপন অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে দেশ জুড়ে নিহত ও আহতদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
২৩ জুলাই : কোটাপ্রথা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি। এদিন বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে ১৯৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
২৪ জুলাই : ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আরও চারজনের মৃত্যু হয় । সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও পরবর্তী সংঘাতে এ নিয়ে ২০১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল।
২৫ জুলাই : অ্যামনেস্টি প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে পুলিশ। প্রধানমন্ত্রীর মেট্রো স্টেশন পরিদর্শন করে বলেন, আমি জনগণের কাছে বিচার চাইছি।
২৬ জুলাই : এলাকা ভাগ করে চলছে ‘ব্লক রেইড’। সারা দেশে অভিযান। নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
২৭ জুলাই : কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরও দুই সমন্বয়ককে হেফাজতে নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তারা হলেন সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ।
২৮ জুলাই : কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে হেফাজতে নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।
ডিবির হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলেছেন।
২৯ জুলাই : জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত ১৪ দলের বৈঠকে। ৬ সমন্বয়ক ডিবি হেফাজতে।
৩০ জুলাই : হত্যার বিচার চেয়ে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতি, স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের।
৩১ জুলাই : মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচির পর বৃহস্পতিবারের জন্য নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই দিনের কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’।
১ আগস্ট : গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার
২ আগস্ট : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জুমার নামাজের পর ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি পালিত হয়।
৩ আগস্ট : সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে উত্তাল বাংলাদেশ। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হন শিক্ষার্থীসহ হাজারো জনতা।
৪ আগস্ট : সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির প্রথম দিনে সারা দেশে ১৮ জেলায় ব্যাপক সংঘাতের খবর।
৫ আগস্ট : পদত্যাগ করে বিমানবাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে চড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এ খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে। দুপুরে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা। গণভবন, সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে অসংখ্য মানুষ। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের ভবনে আগুন, আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে আগুন। বিজয়সরণিসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শেখ মুজিবের মূর্তি ভেঙে ফেলে জনতা। গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জনতার দখলে।