১৪ আগস্ট পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনালগ্ন হিসেবে পরিচিত। তবে এই আন্দোলনকে কেবল রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণ বা রাজনৈতিক লড়াই হিসেবে দেখলে তা অসম্পূর্ণ থাকে। ইতিহাসকে যথাযথভাবে বোঝার জন্য আমাদের দেখতে হবে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ভাঙন, কংগ্রেসের একদিক-দর্শিতা, মুসলিম লীগের জন্ম, কোলকাতা ও নোয়াখালী দাঙ্গা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রেক্ষাপট।

এসব ঘটনা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোর জটিলতা স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলে। মহাত্মা গান্ধী, আবুল কালাম আজাদ, নেহরু প্রমুখ অখণ্ড ভারতের ধারণা নিয়ে এগিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানের পরিচয়ের ভিত্তিতে দেশ ভাগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা উপমহাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে ধরা হয়।

মুসলিম লীগের নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান আন্দোলনের জন্য সংগ্রাম করলেও বৃহত্তর স্বার্থে ভারতের অখণ্ডতা বজায় রাখার প্রস্তাবও বিবেচনা করেছেন। এটি প্রমাণ করে যে পাকিস্তান আন্দোলন একটি একক রাজনৈতিক স্বপ্ন নয়, বরং তা প্রভাবিত ছিল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক উপাদান দ্বারা। একই সময়ে একে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ছিলেন। তারা দেখিয়েছেন যে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন করা ছাড়া ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার প্রাধান্যও বাঙালি মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাহমুদউল্লাহ খানসহ অন্যান্য নেতা পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ঢাকার নবাব পরিবারও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই ভিন্নমত ও নেতৃত্বের দ্বৈত প্রকৃতি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দেখায় যে রাষ্ট্র গঠন এবং জনগণের স্বকীয়তার লড়াই কখনো সরল বা একরূপ হয় না।

১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হলেও তা অসম্পূর্ণ ছিল। পাকিস্তান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের মধ্যে কাশ্মীর, সিলেট ও পাঞ্জাবের একাংশ হারিয়ে ফেলে। দেশভাগের সঙ্গে মাইগ্রেশন, সহিংসতা, পরিচয় পুনর্গঠন এবং সামাজিক নেটওয়ার্কের ধ্বংস জড়িত ছিল। পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানদের জন্য ১৯৪৭ ছিল এক ধারাবাহিক সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ মোড়। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ পূর্ব বাংলার জনগণের স্বকীয়তার দাবি চাপে ফেলেছিল, যা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার প্রকাশ। শহীদ ও আহত হন অনেক মানুষ। এটি কেবল ভাষাগত লড়াই ছিল না, বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতিবাদও ছিল। সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে এই আন্দোলন বোঝায় যে, রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে ক্ষমতার অসম বণ্টন identity-based mobilization বা স্বকীয়তার ভিত্তিক সামাজিক আন্দোলনের জন্ম দিতে পারে। Cedric Robinson-এর racial capitalism বা Subaltern studies-এর আলোকে ভাষা আন্দোলন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানরা শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, বরং সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক স্বকীয়তার জন্যও সংগঠিত হয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি মুসলমান জনগণের দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের শীর্ষবিন্দু। এটি কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার লড়াই নয়, বরং ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সামাজিক স্বকীয়তার রক্ষার লড়াই। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা ও প্রশাসনের সহিংসতা জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সংগ্রামকে আরও দৃঢ় করে। মুক্তিযুদ্ধ দেখায় যে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বৈষম্য, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বীকৃতির অভাব গণআন্দোলন ও প্রতিরোধের জন্ম দেয়। সমাজতত্ত্বে collective action theory অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি বৈষম্য ও স্বকীয়তার হুমকি জনগণকে সংগঠিত আন্দোলনের দিকে ঠেলে।

১৯৯০ সালের গণতান্ত্রিক আন্দোলন স্বৈরশাসক হোসেন মুহাম্মদ এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন দেখায় যে বাংলাদেশের নাগরিকরা এখনও অধিকার, গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং স্বকীয়তার জন্য লড়াই চালাচ্ছে। Historical institutionalism অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে পুরোনো নীতি ও ক্ষমতার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক আচরণকে প্রভাবিত করে। এই আন্দোলন পূর্ববর্তী আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রকে নাগরিকদের দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে বাধ্য করছে।

বিতর্কও প্রবল। এক পক্ষ পাকিস্তান আন্দোলনকে ঐতিহাসিক ভুল বলে আখ্যায়িত করে, অন্য পক্ষ তা গ্লোরিফাই করতে চায়। কোথাও দেখা যায়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মকে সরল করে ব্যাখ্যা করা হয়, ৪৭-৭১-এর ধারাবাহিক লড়াইকে উপেক্ষা করা হয়। সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন ওঠে: কেন ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী বয়ান, অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আধিপত্য এখনো বাংলাদেশের রাজনৈতিক চেতনায় প্রভাব ফেলে? ৪৭ থেকে ২৪ পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানদের সংগ্রামকে কীভাবে আরও সঠিকভাবে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়? কোন পর্যায়ে ধর্ম, ভাষা, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাত রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে?

পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন—এসব আন্দোলন বাঙালি মুসলমান জনগণের রাজনৈতিক চেতনা, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা এবং রাষ্ট্র-সংগঠনের ধারাবাহিক লড়াইকে তুলে ধরে। রাষ্ট্র এবং জনগণ পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা করে। পাকিস্তান আন্দোলনের ক্রিটিক্যাল পাঠ দেখায় যে, আধুনিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের সংকট এবং বাঙালি মুসলমান ও মজলুম জনগণের ধারাবাহিক সংগ্রাম একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

তাছাড়া ১৯৪৭ সালের দেশভাগ কেবল রাজনৈতিক সীমারেখা নয়, বরং বহুস্তরীয় ক্ষমতার লড়াই, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার প্রশ্নও অন্তর্ভুক্ত করে। পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র ও পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা আত্মপ্রতারনার এক রূপ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, এবং পূর্ব বাংলার স্বকীয়তার হুমকি মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য প্রাথমিক প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে।

ভারতের আধিপত্যবাদও এই প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে। অখণ্ড ভারতীয় ধারণা এবং হিন্দুত্ববাদী নীতি কেবল রাজনৈতিক সীমারেখা পুনর্গঠনের জন্য নয়, বরং আঞ্চলিক শক্তি ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে কাজ করেছে। কাশ্মীর, পাঞ্জাব, আসাম এবং পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান জনগণ ভারতীয় নীতির প্রভাবের মধ্যে পড়েছিল। সীমান্ত-সেনা, নদী ও পানি নিয়ন্ত্রণ, অভ্যন্তরীণ সংখ্যালঘু নীতিমালা—সবই পূর্বের দেশভাগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের ধারাবাহিকতার প্রতিফলন।

অতএব ১৯৪৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসকে পড়া গেলে বোঝা যায় যে রাষ্ট্র জন্ম নেয় কেবল রাজনৈতিক সীমারেখা আঁকার মাধ্যমে নয়; জনগণের সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বকীয়তার দাবির ধারাবাহিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান আন্দোলনের ক্রিটিক্যাল পাঠ আমাদের স্মরণ করায়, আধুনিক রাষ্ট্র এবং জাতীয়তাবাদী বয়ান, হিন্দুত্ববাদী প্রপাগান্ডা, এবং আওয়ামী রাজনীতির মধ্যবর্তী দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে বাঙালি মুসলমান ও মজলুম জনগণের ধারাবাহিক সংগ্রাম অপরিহার্য।

লেখক: শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

সূত্র, আমার দেশ